X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পাকিস্তানকে না বলুন

প্রভাষ আমিন
১১ জুন ২০১৬, ১২:৪০আপডেট : ১১ জুন ২০১৬, ১৩:৪২

প্রভাষ আমিন ক্রিকেট ইতিহাসে কয়েকজন সেরা ফাস্ট বোলারের জন্ম পাকিস্তানে। সর্বকালের সেরা পেসারদের খুব সংক্ষিপ্ত তালিকাতেও ঠাঁই দিতে হয় ইমরান, ওয়াসিম, ওয়াকার আর শোয়েবকে। এই তালিকায় না থাকলেও, ম্যাচ পাতানোর দায়ে জেল খেটে ক্রিকেটে ফেরা মোহাম্মদ আমির প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের দুঃস্বপ্নেও হানা দেন। সর্বকালের নয়, তবে সমসাময়িকদের মধ্যে অন্যতম সেরা আমির। বাংলাদেশের উত্থানের আগে বিশ্ব ক্রিকেটে আমার পছন্দের তালিকায় এক নম্বরে ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ভয়ঙ্কর সব খুনে বোলারদের খনি ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ। আমার দ্বিতীয় পছন্দ ছিল ভারত। ভারতের জয় চাইতাম বটে, কিন্তু নিজেদের মাটিতে স্লো পিচ বানিয়ে প্রতিপক্ষকে ডেকে এনে স্পিনের মায়ায় কাবু করাটা আমার ভালো লাগতো না। বরং পরপর দুই বলে দ্রাবিড় আর শচিনের স্ট্যাম্প উপড়ে ইডেন গার্ডেনে শোয়েব আখতারের উড়ন্ত ঈগলের মতো সেলিব্রেশনের দৃশ্য এখনও চোখে লেগে আছে।

পাকিস্তান ক্রিকেটের পেসার সাপ্লাই লাইনটা বরাবরই খুব শক্তিশালী। এই লাইনেরই অন্যতম সেরা আকিব জাভেদ। কিন্তু বেচারা আকিব জাভেদ ভুল সময়ে জন্মেছিলেন। ওয়াসিম আর ওয়াকারের দীর্ঘ ছায়ায় ঢাকা পড়েছিলেন বরাবরই। তারপরও যখনই সুযোগ পেয়েছেন, নিজের জাত চিনিয়েছেন। এই আকিব জাভেদই হঠাৎ বাংলাদেশ ক্রিকেটে আলোচিত নাম। হিথ স্ট্রিক ছিলেন বাংলাদেশের পেস বোলিং কোচ। তার সময়েই বাংলাদেশ পেস বোলিংয়ে সেরা সময় পার করেছেন। এমনিতে ভারতের মতো বাংলাদেশেরও মূল শক্তি ছিল স্পিন। কিন্তু গত বিশ্বকাপে বাংলাদেশ পেস বোলিং দিয়ে চমকে দেয় বিশ্বকে। মাশরাফির নেতৃত্বে রুবেল আর তাসকিন আতঙ্ক ছড়ায় প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের মনে। আর গতবছর ভারতের বিপক্ষে চার পেসার নিয়ে খেলতে নেমে তো রীতিমতো ইতিহাস সৃষ্টি করে বাংলাদেশ। মুস্তাফিজ তো এখন শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বেরই বিস্ময়। গতি দিয়ে প্রতিপক্ষকে কাবু করার মধ্যে যে ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য্য তার তুলনা কিছুতে নেই। মুস্তাফিজের বল খেলতে গিয়ে যখন ব্যাটসম্যান ক্রিজে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বোল্ড হন, সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এই সাফল্যের সময়েই হঠাৎ করে পদত্যাগ করে বসেন স্ট্রিক। দ্রুতই নতুন পেস বোলিং কোচের সন্ধানে নেমে পড়ে বাংলাদেশ। পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে কয়েকটি নাম- আকিব জাভেদ, চামিন্দা ভাস, ভেঙ্কটেশ প্রসাদ, চম্পাকা রামানায়েকে।

কিন্তু গত ৬ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন জানিয়ে দেন, বাংলাদেশ পেস বোলিং কোচ হিসেবে আকিব জাভেদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে বিসিবি। দুয়েকদিনের মধ্যেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। কিন্তু সেদিনই আকিব জাভেদ পাকিস্তানে সাংবাদিকদের জানিয়ে দেন তিনি বাংলাদেশের কোচ হচ্ছেন না। পাপন যখন আকিব জাভেদের নাম ঘোষণা করেন, তখনই আমার মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছিল। আমি মনেপ্রাণে চাইনি, পাকিস্তানের কেউ বাংলাদেশের কোনও কিছুর সঙ্গে জড়িত থাকুক। কিন্তু আকিব জাভেদের প্রত্যাখানের খবর শোনার পর অস্বস্তিটা পরিণত হয়েছে ক্ষোভে। যেহেতু বিসিবি সভাপতি শুধু আকিব জাভেদের নামই বলেছিলেন, তাই আমরা ধরেই নিয়েছি, আকিব জাভেদের প্রাথমিক সম্মতির পরই তিনি তা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু পাপনের প্রেস কনফারেন্সের দিনেই আকিবের অসম্মতির খবর আমাদের অপমানিত করে। অন্তত পাকিস্তানের কাউকে অসম্মতি জানানোর অহমিকা দিতে প্রবল আপত্তি আমার। সম্মতি ছাড়াই যদি বলতে হবে, তাহলে শুধু একজনের নাম বলা হলো কেন? বিসিবি সভাপতি তো প্রাথমিক তালিকায় থাকা সবার নামই বলতে পারতেন।

অবশ্য সম্মত হলেও আকিব জাভেদ বাংলাদেশ ক্রিকেটের কোচিং স্টাফ দলের প্রথম সদস্য হতেন না। এর আগে বাংলাদেশ ক্রিকেটের উত্থানপর্বে মূল কোচ ছিলেন মুদাসসর নজর। কদিন আগেও স্পিন বোলিং কোচ ছিলেন সাকলাইন মুশতাক। তাদের পারফরম্যান্স নিয়ে আমার কোনও মতামত নেই। ভালো-মন্দ যাই হোক, তারা চুক্তি অনুযায়ী কাজ করেছেন। কিন্তু বিশ্ব ক্রিকেটে তো অনেক ক্রিকেটার বা কোচ আছেন, যারা বাংলাদেশেকে কোচিং করাতে পারেন। তবে আমাদের পাকিস্তানের কাছে হাত পাততে হবে কেন?

একসময় এই ভূখণ্ড পাকিস্তানের অংশ ছিল। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছিল অদ্ভুত এক রাষ্ট্র- পাকিস্তান। ২৩ বছরের অত্যাচার, নির্যাতন, বঞ্চনার পর একাত্তরে নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামে আমরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি। তারপর বদলে গেছে দুই রাষ্ট্রের দিক নির্দেশনা। সামরিক শাসনের যাতাকলে পিষ্ট হতে হতে পাকিস্তান একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আর বাংলাদেশ এখন সারাবিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। সব সূচকে অনেক আগেই পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। শুধু ক্রিকেটটাই বাংলাদেশের চেয়ে ভালো খেলতো পাকিস্তান। কিন্তু এখন পাকিস্তানকেও বাংলাদেশ রীতিমতো বলে কয়ে হোয়াইটওয়াশ করে। এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম বহুদিন। এখন আমরা বুক ফুলিয়ে চলি, বলি, ‘ছ্যা’ পাকিস্তানকে আমরা পাত্তাই দেই না। কিন্তু আকিব জাভেদের প্রত্যাখানের দুঃসাহস আমাদের সেই অহং-এ আঘাত করে। কোনও পাকিস্তানিদের কাছে সামান্যতম পিছিয়ে থাকাটাই সহ্য হয় না আমার।

আমি জানি পাকিস্তান ক্রিকেটের অনেক সমর্থক আছেন বাংলাদেশে। তাদের অনেকেই হৃদয়ে পাকিস্তান ধারণ করেন, পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে মাঠে যান, ‘ম্যারি মি আফ্রিদি’ বলে প্ল্যাকার্ড তুলে ধরেন। আবার অনেকে আছেন, যারা ভালো ক্রিকেটের জন্যই পাকিস্তানকে সমর্থন করেন। তারা সবসময় বলেন, ভাই খেলার সঙ্গে রাজনীতি মেলাবেন না। কিন্তু ভাই আপনারা পারেন, আমি পারি না। এটা আমার সীমাবদ্ধতা হতে পারে, কিন্তু আমি পাকিস্তানকে কোনওভাবেই সহ্য করতে পারি না। এমনিতে আমি জাতি-ধর্ম-বর্ণ সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে বিবেচনা করি। বাংলাদেশকে অনেক ভালোবাসি, কিন্তু অন্য কোনও দেশ বা জাতিকে হেয় বা খাটো করে নয়। কিন্তু পাকিস্তানের ব্যাপারে আমি এই সূত্রগুলো কাজে লাগাতে পারি না। পাকিস্তান আমার কাছে চির ঘৃণার দেশ। বিশেষ করে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর পর থেকে পাকিস্তান যেভাবে বারবার ঔদ্ধত্য দেখিয়ে আসছে, তাতে পাকিস্তানকে ঘৃণা করার যুক্তি তারাই তুলে ধরছে প্রতিদিন। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে যেভাবে পাকিস্তানে শোকের মাতম ওঠে তাতে আমরা বুঝি, বিচার ঠিক লোকেরই হচ্ছে। পাকিস্তান এখন একাত্তরের গণহত্যার দায় অস্বীকার করছে। তারা আমাদের পাওনা সম্পদ বুঝিয়ে দেয়নি। আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেয়নি। তাই দাবি উঠেছে, পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার, অন্তত ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনার। এই যখন দেশপ্রেমকি সাধারণ মানুষের আবেগ, তখন পাকিস্তানের কারও কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অপমানটা বড় বেশি বুকে বাজে।

ক্রিকেট এখন বাংলাদেশের ঐক্যের প্রতীক। দল-মত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই ক্রিকেট প্রশ্নে এক। ক্রিকেটের প্রশ্নে কোটি মানুষ দাঁড়িয়ে যায়। এই যে ক্রিকেটের জন্য মানুষের এত ভালোবাসা, এত আবেগ, এত উন্মাদনা; সেকি শুধুই ক্রিকেট বা মাশরাফি, সাকিব বা মুস্তাফিজের জন্য? তেমনটা ভাবলে ভুল করবেন। ক্রিকেটের কিছুই বোঝে না, কিন্তু মাঠে গিয়ে গলা ফাটান, এমন লোকের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। তারা আসলে যতটা না ক্রিকেটকে ভালোবাসেন, তার চেয়ে অনেক ভালোবাসেন বাংলাদেশকে। ক্রিকেট বাংলাদেশকে ঊর্ধ্বে তুলে বলেই আমরা ক্রিকেটারদের পাশে দাঁড়াই। তাই যতই বলুন, ক্রিকেটের সঙ্গে রাজনীতিটা কিন্তু চলেই আসে। এখন বিশ্ব ক্রিকেটে আমাদের পছন্দ-অপছন্দ নির্ভর করে বাংলাদেশের বিবেচনায়। যারা ক্রিকেটে বাংলাদেশের বন্ধু, তারা রাজনীতিতেও আমাদের বন্ধু। যারা ক্রিকেটে আমাদের শত্রু, তারা কূটনীতিতেও আমাদের শত্রু। সেই সূত্রে যারা রাজনীতিতে আমাদের শত্রু, তারা ক্রিকেটেও আমাদের শত্রু।

পাকিস্তান আমাদের রাজনীতিতে শত্রু, কূটনীতিতে শত্রু, ক্রিকেটেও শত্রু। বাংলাদেশের পেস বোলারদের সাফল্যে আমি গলা ফাটাবো। কিন্তু তার পেছনে যদি কোনও পাকিস্তানির অবদান থাকে, আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুবে না। তাই বিসিবির কর্তাদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা আমাদের আবেগটা মাথায় রাখবেন। কোচ বিশ্বের যেখান থেকে ইচ্ছা আনুন, পাকিস্তান ছাড়া। সব ক্ষেত্রেই পাকিস্তানকে না বলুন।

লেখক: অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

[email protected]

আরও পড়তে পারেন: আকিব জাভেদের প্রত্যাখান, বাকি তিনজনে চোখ বিসিবির

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ