X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিদ্যুৎ চাই তবে...

লুৎফুল হোসেন
২৮ আগস্ট ২০১৬, ১৬:৫৪আপডেট : ২৮ আগস্ট ২০১৬, ১৭:০৫

লুৎফুল হোসেন বিদ্যুতের ঘাটতি যতদিন আছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জোর তাগিদ ততদিনই বিদ্যমান থাকবে। সেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হলে কোথাও না কোথাও ভূমি অধিগ্রহণও যেমন করতে হবে, তেমনি  কিছু মানুষের বাসস্থান ও পেশাগত বিপত্তিও ঘটতে পারে। এ ক্ষেত্রে বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্রতর স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতেই হয়।
বিশ্বের জনবহুল এ ছোট্ট দেশটায় খাদ্যঘাটতি কাটিয়ে উদ্বৃত্তের দেখা পেতে ভূমির জোগান কিন্তু বাড়েনি। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদবিহীন এই সেই দেশ, যে দেশকে একদা ওষুধ আমদানি করতে হয়েছিল বিনিময় প্রথায় (বার্টার সিস্টেমে)। আজ সেই দেশটাই ওষুধ রফতানিতে বিশ্বের কাছে চেনা এক নাম। ত্রাণের দিকে চেয়ে থাকা সেই বটমলেস বাস্কেট দেশটাই আজ বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় গড়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। উন্নয়ন ঘটিয়েছে কৃষির পাশাপাশি শিল্পখাতেও।
এদেশের তৈরি পোষাকশিল্প আজ বিশ্বের সব নামি-দামি ব্র্যান্ডের প্রস্তুতকারক। পণ্যের পাশাপাশি জনশক্তিও নীরবচ্ছিন্নভাবে অর্থনীতিতে জোগাচ্ছে প্রবৃদ্ধি। ফলে দ্রুত বাড়ছে জীবনযাত্রার মান। বাড়ছে পণ্য ও সেবার চাহিদা। সব কিছু মিলিয়ে বিদ্যুতের চাহিদা তাই এদেশে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এমনকী শিল্প-কল-কারখানা স্থাপন এবং উৎপাদনও আটকে থাকছে এই বিদ্যুতের অভাবে।
আজ পর্যন্ত আমাদের দেশে কেবল ৭৪% মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে। বাকিরা এখনও বঞ্চিত। আমরা এখনও বিশ্বে সর্বনিম্ন হারে বিদ্যুৎ খরচ করি; যা ঘণ্টাপ্রতি মাত্র ৩৭১ কিলোওয়াট। বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১০ হাজার ২৮৩ মেগাওয়াট। ঘাটতি ১৫০০ মেগাওয়াট। পাশাপাশি অনুমিত চাহিদা অনুসারে ২০২১ সালের উৎপাদন লক্ষ্য ২০ হাজার মেগাওয়াট।
গত কয়েক বছরের তুলনায় সম্প্রতি  লোডশেডিং কিছু কমেছে মানে এই নয় যে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। আর তাই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, এদেশের কারও কোনও দ্বিমত নেই।
স্বাধীনতার পর থেকে সারা দেশে অনেক ছোট-বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে এবং হচ্ছে। তার কোনওটি নিয়েই সে রকম কোনও মত-দ্বিমতের ঝড় হয়নি। তর্ক-বিতর্ক যা কিছু আজ হচ্ছে তা শুধু রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নিয়ে। এমন না যে কয়লাভিত্তিক তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র এদেশে আর একটিও নেই।
যৎসামান্য হলেও এদেশের আড়াই শতাংশের কাছাকাছি পরিমাণ বিদ্যুতের জোগান কয়লাভিত্তিক প্রকল্প থেকে। প্রশ্ন থাকে, তাহলে সমস্যাটা কোথায়!
২০১০ সালের ধারণাগত ব্যুৎপত্তিটি ‘মৈত্রী সুপার থার্মাল প্ল্যান্ট’ নামে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে চুক্তিবদ্ধ কার্যকরী পদক্ষেপের মুখ দেখে ২০১৬ সালের মাঝামাঝি এসে। এর আগে ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি ভারতের এনটিপিসি ও বাংলাদেশের বিপিডিবি এ দুয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সম্পন্ন হয়। পরের বছর এজন্য পত্তন ঘটে নতুন কোম্পানি Bangladesh India Friendship Company Limited (BIFPCL) এর। ১৩২০ মেগাওয়াটের জন্য ৬৬০ মেগাওয়াটের দুটি স্থাপনা মিলিয়ে এই আয়োজনটি বাগেরহাট জেলার পশুর নদীর তীরে। ১৮৩৪ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ করে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। যার অবস্থান সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে।

আবার বিআইএফপিসিএল-এর উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী এই ১৪ কি.মি. দূরত্ব হলো সুন্দরবনের শেষ সীমানা থেকে এবং ইউনেস্কো ঘোষিত ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর চহ্নিত সীমানা থেকে রামপাল প্রকল্পের দূরত্ব আসলে ৬৯ কিলোমিটার। তবে দীর্ঘ মেয়াদে যদি আমরা ভাবি, তাহলে আমেরিকা বা চীনে এর ক্ষতিকর প্রভাব বলয়ের বৃত্তটি যে আসলে প্রায় ৫০ কি.মি. ব্যাসার্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে, তা ঠিক উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

ভারতেও ঘটেছে ফ্লাই-অ্যাশ নিয়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের ঘটনা। তাইওয়ান ও ভিয়েতনামের ঘটনা বিবেচনায় আনলে সামান্য বিপত্তিতে নদী দূষণের মাত্রা যে কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে, তা বিবেচনায় না আনার দুঃসাহস শুধু কথা আর কাগুজে, তথ্য উপাত্তে আদৌ বাস্তবসম্মত নয়। এসব শঙ্কা যদি সত্য হয়, তবে যে বিশাল পরিধিতে কৃষি-মৎস্য এবং ভূমি-জল ও জীব বৈচিত্র্যের বিপর্যয় ঘটবে তা ধারণার অতীত।

এ বিষয়ে রামপালের পক্ষে বিশেষজ্ঞদের তথ্য-উপাত্ত ভিত্তিক উপস্থাপনা যদি সাধারণের মাঝে বিদ্যমান সংশয়গুলো দূর করতে সোচ্চার ও সচেষ্ট হতেন, তবে তা হতো দেশের জন্য উত্তম। দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ অপরিহার্য। আর সেটা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটা ‘অপারচিউনিটি কস্ট' আমাদের মানতেই হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট-এর সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূরত্ব আর তাকে ঘিরে পরিবেশগত ক্ষতি নিয়ে বিবিধ শঙ্কা এ উদ্যোগের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বিদ্যুৎ সমস্যার ভুক্তভোগী এদেশেরই অধিকাংশ মানুষকে। অথচ যথাযথ সমাধানমুখী অগ্রগতির বদলে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রকৃত তথ্যের বিপরীতে নানান তথ্য বিভ্রান্তিজনিত জটিলতা।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ‘ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশন অ্যাক্ট' অনুযায়ী ন্যাশনাল পার্ক ও রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে ১৫ কিলোমিটার সীমার ভেতরে তাপ-বিদ্যুৎ বা সেরকম কোনও স্থাপনা তৈরিতে নিষেধাজ্ঞা ছিল। সেই হিসেবে বিপিডিবির হাতে নিজ দেশের নির্দেশনা লঙ্ঘিত হচ্ছে রামপালে মাত্র এক কিলোমিটার দূরত্বের জন্য। আর এনটিপিসির দেশ ভারতের এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট এসেসমেন্ট (ইআইএ) গাইডলাইন ২০১০-এ বলা হয়েছে, No power plant can be built within 25 Kilometers of forests. Locations of thermal power stations are avoided within 25 kilometers of the outer periphery of the following: metropolitan cities; national park and wildlife sanctuaries; ecologically sensitive areas like tropical forest, biosphere reserve, important lake and coastal areas rich in coral formation.

আর ঠিক এই কারণে এবং আনুষাঙ্গিক আরও বিষয় মিলিয়ে এনটিপিসি তার নিজ দেশেই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চার চারটি কয়লাভিত্তিক তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে অনুমতি পায়নি। যদিও ভারতের ৬৮% বিদ্যুৎ কয়লা থেকেই উৎপাদিত হচ্ছে। আর দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো মিলে ২০২০ সাল নাগাদ কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ থেকে আরও ২০৫ গিগাওয়াট সরবরাহ নিশ্চিত করার প্রস্তুতি নিয়েছে। যা সর্বকালের সর্ববৃহৎ কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদন লক্ষ্য বলে বিবেচ্য।

সাউথ আফ্রিকায় কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনের হার সর্বাধিক। তাদের মোট বিদ্যুতের ৯৩ শতাংশ। চীনে ৭৯ শতাংশ; অস্ট্রেলিয়ায় ৭৮, জার্মেনিতে ৪১, আমেরিকায় ৪০ এবং যুক্তরাজ্যে ৩০ শতাংশ।

এ তথ্যে আরও একটা বিষয় পাশাপাশি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে যে, বিশাল ভূখণ্ডের অধিকারী দেশগুলোতেই কয়লা বিদ্যুৎ ব্যবহারের আধিক্য বিদ্যমান। কারণ তারা তুলনামূলকভাবে সহজে একটা বিস্তীর্ণ এলাকা এ কাজের জন্য বরাদ্দ দিতে পারে নিজ জনসাধারণের বিপত্তির বড় কারণ না ঘটিয়ে। যা আমাদের মতো জনবহুল ও ভূমি অপ্রতুল দেশে কখনও সম্ভব নয়। তার ওপর আছে পরিবেশে বৈরী প্রভাবে এদেশের দক্ষিণাঞ্চল সমুদ্র গর্ভে বিলীন হওয়ার আগাম সতর্কতা বাণী।

এই অবকাঠামোগত সামর্থ্য দেশের শিল্পোন্নয়ন, কর্মসংস্থান, মাথাপিছু আয় এসব বাড়াতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। এটুকু নিশ্চিত। কিন্তু রামপালের ক্ষেত্রে অপরচিউনিটি কস্টগুলো কী? অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আজ দূষণ নির্গমণ কমিয়েছে বটে, তবে তা মোটের ওপর একটা সামান্য অংশে মাত্র। তাই দূরত্বের বিচারে রামপাল সুন্দরবনের জন্য একটা ভীষণ রকম হুমকি—এমন ভাবনাটাকে অনেক মানুষই উড়িয়ে দিতে পারছেন না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদ্যমান অবস্থার প্রতি জনগণের এক ধরনের অনাস্থা; যা তৈরি হয়েছে বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে।

সুন্দরবনে তেলবাহী জাহাজ ডুবে পরিবেশ বিপন্ন হওয়া থেকে সম্প্রতি সময়ে সার কারখানায় অ্যামোনিয়া ট্যাঙ্ক বিস্ফোরণ ঘটে। এমন বিপর্যয় সামাল দিতে সন্তোষজনক ব্যবস্থা গ্রহণে কর্তৃপক্ষের সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা; সেই সঙ্গে সত্যিকারের আন্তরিক মোকাবিলার মানসিকতার অনুপস্থিতি। এমন বিবিধ বিষয়কে ঘিরেই জনসাধারণের এই আস্থাহীনতা। যার পরিবর্তন ঘটাতে 'seeing is believing'-এর চাইতে ভালো কোনও পথ বা পন্থা আছে বলে মনে হচ্ছে না।

বিদ্যুৎ চায় এদেশের সব মানুষই। অথচ কিছু মানুষ জোর বিরোধিতা করছে রামপালের। তাই এই প্রতিবাদকারীদের ঘিরে একটা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে অন্যদের কাছে। এরা কি শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করছে নাকি তাদের তথ্য উপাত্তে সত্যতা কম-বেশি আছে!

আমি আসলে এই প্রতিবাদকারীদের নিয়ে এক রকম আনন্দিত ও গর্বিত। কারণ দেশপ্রেম থেকেই তাদের এ উৎকণ্ঠা উৎসারিত। তারা মরিয়া হয়ে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের জন্যেও উদ্যোগ নিয়েছে। এদের এ প্রেমকে যথার্থ সন্মান দেখিয়ে তত্ত্ব ও তথ্যগত ব্যাখ্যা নিয়ে তাদের বোঝাবার প্রচেষ্টাটি যেমন একদিকে অনুপস্থিত ছিল সরকারের পক্ষ থেকে; তেমনি অন্যদিকে প্রায় পরিপক্ক একটা অবস্থায় বিরোধী দলের এ বিষয় নিয়ে মাঠে নামাটা এক রকম হঠকারিতা বৈ অন্য কিছু নয়।

প্রতিটা বিরোধী দলেরই একটা ছায়া সরকার থাকার কথা, সত্যিকারের দেশপ্রেম যদি তাদের রাজনীতির মূলসূত্র হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে রামপালের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে আলাপের তাগিদটা বিরোধী দলগুলোর কোথায় লুকিয়ে ছিল এত কয় বছর!

মাঝখান থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জনতার আন্তরিক প্রতিবাদ ঘিরে সাফল্য সম্ভাবনার ‘বাড়া ভাতে ছাই’ পড়ার দৃশ্যটিই নির্মমভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে।

এতসব তর্ক-বিতর্কের অবতারণা না করে স্রেফ কয়েকটা প্রশ্ন বা সংশয়ের জবাব আসলে আমাদের খুঁজতে হবে।

এক. আমাদের ৭২ সালের বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ রক্ষা বিষয়ক উদার (কারণ তখনও গোটা বিশ্ব কয়লাভিত্তিক তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্রের নেতিবাচক দিকগুলো চিহ্নিত করে উঠতে পারেনি) আইনটুকুও কেন লঙ্ঘিত হলো?

দুই. ভারতের ইআইএ নির্দেশনা মোতাবেক ২৫ কিলোমিটারের খড়্গ যে এনটিপিসি তার নিজ দেশে এড়াতে পারেনি, সে কেন নৈতিকতায় তার পাশের দেশে এসে সেই নীতির লঙ্ঘন ঘটাতে সচেষ্ট হলো?

তিন. এদেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বিচারে কম মূল্যে বিক্রয়যোগ্য  কয়লা বিদ্যুৎ ও অন্যান্য প্রকল্পগুলোকে ফাইলবন্দি রেখে অধিক বিক্রয়মূল্যের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন নিয়ে এমন ব্যস্ততা কেন?

চার. পশুর নদী ও সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্যের নিশ্চয়তা অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে ও দৃশ্যমান সামর্থ্যের বিচারে কী করে আমরা মোকাবিলার নিশ্চয়তা দিতে পারছি?

পাঁচ. এর ব্যর্থতার দায় (কোনও কারণে সত্যিই তেমনটা ঘটলে) আগামীতে কে কিভাবে নেবে?

ছয়. বিনিয়োগ ও মালিকানা সমান সমান হলে ৭০ ভাগ ঋণভিত্তিক বিনিয়গের ঝুঁকি ও দায় কি শুধুই বাংলাদেশের?

সাত. ভূমি অধিগ্রহণ ও পরিবেশগত প্রভাবে কৃষি, মৎস্য, আবাসন, উৎপাদন ঘিরে ক্ষতি এবং নদী ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ব্যয় মিলিয়ে আমাদের সার্বিক ক্ষতির পরিমাণ কী দাঁড়ায়?

আট. রেন্টালের ছোট ছোট প্রকল্পগুলোর মতো সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি বা বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কেন্দ্রগুলো চালু করার উদ্যোগ কেন নেওয়া হচ্ছে না?

নয়. অন্য অনেক প্রস্তাবিত প্রকল্পের চেয়ে অধিক ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ার পরও এটার জন্য মরিয়া হতে হবে কেন? রামপালের পক্ষের যুক্তি ও তথ্যগুলো যথার্থ ও সঠিক হলে তা জনতাকে বোঝানোর যৌক্তিক প্রচেষ্টাটি অনুপস্থিত কেন?

খোলা মনে সব বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর সুবিধা-অসুবিধা, লাভ-ক্ষতি বিচার বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে মত ও সিদ্ধান্ত ঠিক করার আয়োজনটি করা হলে আরও আগেই, এমনকি ভূমি অধিগ্রহণের আগেই এর ভালো-মন্দ সুবিধা-অসুবিধার বিচার্য বিষয়গুলো সঠিক সমাধানে পৌঁছে যেত। এত হৈ-হট্টগোলও হতো না।

যখন কোলেটারেল আমাদের, তখন কোলেটারেল ড্যামেজও আমাদের। পূর্ববর্তী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ৩.৮০ টাকা বা ৪.০০ টাকার বদলে ৮.৮৫ টাকায় বিদ্যুৎ কিনতে হবে এই আমাদেরই। তখন প্রশ্ন করার অধিকার যেমন মানুষের থাকবেই, সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায়ও সরকারের থেকেই যায়। বর্তমান বাজারে কয়লার এফওবি মূল্য টনপ্রতি ৩৫ ডলারেরও  কম। পরিবহন ব্যয় ১১ ডলারের কম। তাতে ল্যান্ডেড কস্ট টনপ্রতি দাঁড়ায় ৪৬ ডলার। খুব উৎকৃষ্ট মানের কয়লা হলে তার দাম পড়বে ৭০ থেকে ৭৫ ডলার। এর বিপরীতে রামপালের জন্য কয়লার মূল্য ধরা হয়েছে টনপ্রতি ১৪৫ ডলার। কয়লা যা লাগবে রামপালে তাও তো যৎসামান্য নয়, বছরে আনুমানিক ৪.৭২ মিলিয়ন টন।

অন্য সব ক্ষয় ক্ষতি যেমন তেমন সুন্দরবন আজ যখন গোটা বিশ্বের সম্পদ বলে চিহ্নিত ও সুপরিচিত তখন প্রমাণিত তথ্য-উপাত্ত ছাড়া সুন্দরবনকে ঘিরে কোনও ধরনের ঝুঁকি অগ্রহণযোগ্য। তদুপরি এটা আমাদের দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষাকারী বিশাল এক প্রাকৃতিক বাঁধ। আয়লার ছোবলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সময়ের বিস্তারিত তথ্য যাদের জানা আছে তারা খুব ভালো জানেন, সুন্দরবন না থাকলে ওই দুর্যোগে ক্ষয়-ক্ষতি আরও কতটা ভয়াবহ হতে পারতো। সেই রক্ষাবাঁধটিকে হুমকির মুখে ফেলার মতো দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে কী কী যুক্তি আমাদের আছে?

বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রচেষ্টাকে থমকে দেওয়াই কি সব বিরোধিতাকারীর আসল উদ্দেশ্য? নাকি দেশ ও দেশের মাটিকে ভালোবাসা? বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ৪০ চল্লিশ ভাগ যেখানে কয়লা বিদ্যুৎ সেখানে আমাদের দেশে নগণ্য আড়াই শতাংশ। আমরা পৃথিবীর পক্ষে প্রকৃতির পক্ষে বলেই প্রতিভাত হচ্ছিল। এই সত্যের পাশাপাশি আরও বিচার্য এই যে, পুরো পৃথিবী আজ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে যখন হ্রাস টানতে তৎপর হচ্ছে, ঠিক তখনই আমরা বৃহদাকারে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে হাত দিচ্ছি।

ভারত স্থির করেছে এ বছর যে, কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং উৎপাদন আর বাড়তে দেবে না, বরং পাঁচ বছরের ভেতর কমাতে শুরু করবে। শুধু ভারত নয়, গত এক বছরে ইন্দোনেশিয়া কমিয়েছে ৮ গিগাওয়াট, ভিয়েতনাম ২৩ এবং চীন হ্রাস টেনেছে ১০৫ গিগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক তাপ-বিদ্যুৎ উৎপাদনে।

সারা পৃথিবী এ ব্যাপারে ক্রমান্বয়ে সজাগ ও সোচ্চার হচ্ছে যখন, ঠিক তখনই আমরা এক শতক পুরনো পদ্ধতির ওপর আধুনিক হওয়ার ভরসায় হাত দিচ্ছি প্রকৃতিবিরোধী প্রকল্পে। ২৭৫ মিটার উঁচু চিমনির কথা বলি আর আলট্রা সুপার টেকনোলজির কথা বলি, দূষণ আসলে কমবে কতটুকু?

আগের কয়লা বিদ্যুৎ প্রযুক্তির তুলনায় সর্বোচ্চ দশ শতাংশ মাত্র। এ সুবিধাটুকু নিশ্চিন্ত নিরাপদ ভাবার সমান মাত্রা কী? সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইড বা অন্যান্য ক্ষতিকর উদগীরণ ২৭৫ মিটার চিমনির বদৌলতে যদি এদেশের মাটিতে কোথাও এসে না পড়ে, তবে তা নিশ্চিত আমাদের প্রতিবেশী দেশের মাটিতেই গিয়ে পড়বে। বাস্তবে কি বাতাসের এই ক্ষতিকর উপাদানগুলো আসলেই আমাদের দেশকে রেহাই দিয়ে অত দূরে গিয়ে পড়বে! তা আদতে না হলে এবং সেই প্রকল্পে কোনও প্রকার বিপত্তি ঘটলে, তা সামাল দেওয়ার মুরোদ আমাদের কি আদৌ আছে?

এত কিছু পরও আমি বলব রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি হোক। কারণ বিদ্যুৎ যে আমার চাইই চাই! অনুরোধ শুধু এই, তার আগে তাকে ঘিরে উত্থাপিত সব প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তরগুলো দেশপ্রেমিক জনতা যেন পেয়ে যায়। আর বিনীত জানতে চাই,  সুন্দরবনকে ঘিরে যত ভয় সংশয় তার কিছুটাও যদি সত্যি হয়ে দেখা দেয় অনাগত দিনে, তবে আজকের রামপাল প্রকল্পের পক্ষের লোকেরা কে এর কতটুকু দায় নেবেন এবং কিভাবে সে দায় ঘোচাবেন?

লেখক: কথাসাহিত্যিক

আরও খবর: প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন: প্রশ্নোত্তর পর্বে যা বলেছেন সাংবাদিকরা

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ