X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পড়াশোনাটা যেন আনন্দের হয়, আতঙ্কের নয়

প্রভাষ আমিন
০৪ অক্টোবর ২০১৬, ১৪:২১আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০১৬, ১৪:২৯

প্রভাষ আমিন সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে পড়াশোনা নিয়ে আমার একটি লেখা প্রকাশের পর থেকে প্রচুর প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি। অনেকেই অনুরোধ করেছেন যে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন পদ্ধতি নিয়ে যেন লেখি। বাংলাদেশের শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে গত কয়েক বছরে এত বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে যে, নিয়মিত পরীক্ষার্থী ও শিক্ষক ছাড়া আর কারও পক্ষে তাল মেলানো সম্ভব নয়। খোঁজ নিয়ে জানলাম, এতদিন ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্ন ছিল ৬০ নম্বর, আর এমসিকিউ ছিল ৪০। এবার সেটা পরিবর্তন করে এমসিকিউ নম্বর করা হয়েছে ৩০, আর সৃজনশীল বাড়িয়ে করা হয়েছে ৭০। শিক্ষার্থীদের আপত্তি সেখানেই। তারা আগের নিয়মই বহাল চান।
তাদের দাবি- ৬টা সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দিতেই তারা হিমশিম খেয়ে যান, সেখানে ৭টা প্রশ্নের উত্তর দিতে সময়ে কুলাবে না। শিক্ষার্থীরা ইতিমধ্যে রাস্তা অবরোধ করে তাদের দাবি জানিয়েছে। না মানলে হুমকি দিয়েছে, লাগাতার কর্মসূচির। তবে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার সাংবাদিকদের বলেছেন, প্রশ্ন পদ্ধতি বদলের সাথে সাথে সময়ের বরাদ্দও বদলানো হয়েছে। আগে ৬টি সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তরের জন্য বরাদ্দ ছিল ২ ঘণ্টা ১০ মিনিট সময়। এখন সেটা বাড়িয়ে করা হয়েছে আড়াই ঘণ্টা। আর এমসিকিউর জন্য থাকছে ৩০ মিনিট। আগে এই দুই প্রশ্নের মাঝে ১০ মিনিট বিরতি ছিল, এখন সেটা থাকছে না। আর ওএমআর শিট পূরণসহ অন্যান্য প্রস্তুতিমূলক কাজের জন্য পরীক্ষা শুরুর আগেই ১০ মিনিট সময় বরাদ্দ থাকবে। তার দাবি, শিক্ষার্থীরা হয়তো বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে পারেনি।
তবে শিক্ষার্থীদের দাবি, নির্ধারিত সময়ে ৬টি প্রশ্নের উত্তর দিতেই তাদের হিমশিম খেতে হয়। সেখানে ৭টি প্রশ্নের উত্তর দিতে তাদের অতিমানব হতে হবে। তবে অফ দ্যা রেকর্ড কয়েকজনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে জেনেছি, এমসিকিউতে ৪০এ ৪০ই পাওয়া সম্ভব। কিন্তু সৃজনশীল যত ভালোই হোক, ১০-এ ১০ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাদের মূল আপত্তিটা এখানেই। আমি অবশ্য এমসিকিউ কমিয়ে সৃজনশীল বাড়ানোর পক্ষে। কারণ এমসিকিউ দিয়ে পাশের হার বাড়ানো গেছে, জিপিএ-৫এর ঢল নেমেছে। তবে প্রকৃত শিক্ষা কতটুকু হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ যে কোনও পরীক্ষা কেন্দ্রের প্রায় সবাই এমসিকিউতে একই রকম নম্বর পায়। এমসিকিউর জন্য শিক্ষার্থীদের নানা ইশারা ইঙ্গিত আছে। শিক্ষকরাও সহযোগিতা করেন। সত্যিকারের সৃজনশীল প্রশ্ন বরং শিক্ষার্থীদের অনেক বেশি জ্ঞানা অর্জনে উৎসাহিত করতে পারে। তবে প্রশ্ন আছে সৃজনশীল প্রশ্নের সৃজনশীলতা নিয়েও।

প্রশ্ন সৃজনশীল হলেও শিক্ষক এবং প্রশ্নকর্তারা এখনও ততটা সৃজনশীল হতে পারেননি বলেই অভিযোগ। তাই তারা প্রশ্ন করেন সৃজনশীল গাইড বই থেকে। ভাবতে হবে এটা নিয়েও। স্ববিরোধিতা মনে হতে পারে। তবে আমি এমসিকিউ কমানোর পক্ষে হলেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে সহমত পোষণ করছি। কেন? তার উত্তর দিচ্ছি এক অভিভাবকের মন্তব্য থেকে। নাজনিন সুলতানা নামের এই অভিভাবক আমার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এসএসসি/এইচএসসি পরীক্ষার আগে, ওদের প্রাক-নির্বাচনি হয়ে যাওয়ার পর, তারা যখন চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তত, তখন জানা গেল, নম্বর বন্টন পালটে গেছে। এখন ওদের সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ৩০ আর রচনামূলক ৭০ মার্কের হবে, আগে যা ছিল ৪০ ও ৬০! নির্ধারিত সময়ে ওরা ৬টা সৃজনশীল লিখতেই সময়ে কুলাতে পারতো না। সেখানে কিভাবে ৭টা উত্তর লিখবে? আর দুই বছর এক ভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার পর এখন শেষ সময়ে কেন এই ছেলেখেলা? এটা আগামীবার থেকে করলে কি শিক্ষা ব্যবস্থা এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হত, যে এবারই তা কার্যকর করতে হল?’

আমিও এই অভিভাবকের সঙ্গে একমত। এবার শিক্ষার্থীরা যখন দুই বছর ধরে একভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে, তখন শেষ মুহূর্তে এক্সপেরিমেন্ট করলে তাদের মনের ওপর সাংঘাতিক চাপ পড়ে। এসএসসি/এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছেলেমেয়েদের যে ভঙ্গুর মানসিক গঠন, তাতে তাদের ওপর এই চাপ দেওয়াটা অন্যায়, ভীষণ অন্যায়। সরকার হয়ত ভালোর জন্যই শিক্ষা নিয়ে নানা এক্সপেরিমেন্ট চালান। কিন্তু আমি বারবার বলি এক্সপেরিমেন্ট সরাসরি পরীক্ষার্থীদের ওপর না চালিয়ে, এটা নিয়ে নানা আলোচনা, গবেষণা করে পরে তা চূড়ান্ত করা উচিত। আর শিক্ষার্থীরা যেন সারাবছর একভাবে পড়াশোনা করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। মাঝখানে যেন আমরা তাদের গিনিপিগ না বানাই। এ বছর পিইসি পরীক্ষা হওয়া না হওয়া নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভা যে ছেলেমানুষি করেছে, তা বড় বেশি দুঃখজনক। শিশু-কিশোরদের শিক্ষাজীবন নিয়ে বড়দের এই ছেলেমানুষি বড় বেশি অমানবিক।

তবে এবারের যে ব্যাচটি এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে, তারা বড়ই দুর্ভাগা। কেউ কেউ বলেন কুফা ব্যাচ। সব ধরনের এক্সপেরিমেন্টের চাপে পিষ্ট তারা। আরেক অভিভাবক কাশিনাথ দাস লিখেছেন, ‘২০১৭-তে যারা এইচএসসি দেবে, তারা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী থেকেই শিক্ষা ব্যবস্থার এক্সপেরিমেন্টের শিকার। বাবা হিসাবে সন্তানের কষ্ট দেখছি, আর আফসোস করছি, কেন এক বছর আগে জন্ম দিলাম না?’ এই অভিভাবকের কষ্টটার যুক্তি আছে। ২০০৯ সালে এই ব্যাচের মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী বা পিইসি নামের অভিশাপের। প্রথমবার পিইসি পরীক্ষা হয়েছিল দিনে দুটি করে। পরে সবার দাবির মুখে সেটা বদলানো হলেও এই ব্যাচটি সেই স্টিম রোলারের চাপ সামলেই এখন কলেজে। সব মহলের আপত্তি সত্ত্বেও এখনও বহাল আছে এই অর্থহীন প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী। পিইসির শুরুর সিদ্ধান্তটাও হয়েছিল বছরের মাঝপথে, এবারের সৃজনশীল বাড়ানোর মতো। আর ২০১৫ সালে এই ব্যাচটি এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল বিরোধী দলের টানা অবরোধ আর আগুন সন্ত্রাসের সময়। তখন প্রতিদিন পরীক্ষার রুটিন বদলাতো, আর পরীক্ষা হতো শুক্রবারে।

এভাবে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের নিয়ে বড় মানুষদের এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ করা দরকার। পড়াশোনাটা যেন তাদের কাছে আনন্দের হয়, আতঙ্কের নয়।

লেখক: অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাফায় আবারও ব্যাপক হামলা ইসরায়েলের
রাফায় আবারও ব্যাপক হামলা ইসরায়েলের
স্ত্রীকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছেলে, রান্নাঘরে পুড়ে মারা গেলেন মা
স্ত্রীকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছেলে, রান্নাঘরে পুড়ে মারা গেলেন মা
২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
কুমিল্লা শিক্ষা প্রকৌশল কার্যালয়ে ঠিকাদারকে মারধর২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ