X
বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪
২৫ বৈশাখ ১৪৩১

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম বদল হোক

আনিস আলমগীর
১৮ অক্টোবর ২০১৬, ১৭:৪৬আপডেট : ১৮ অক্টোবর ২০১৬, ১৯:০৭

আনিস আলমগীর ঘোড়দৌড়ের মাঠটাকে অপরূপ সাজে সাজাচ্ছে আওয়ামী লীগ তার ২০তম ত্রিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন উপলক্ষে। ঘোড়দৌড়ের মাঠ বা রেসকোর্স ময়দান বললে এ প্রজন্মের লোকদের চিনতে কষ্ট হবে। কারণ, তারা এই ময়দানকে চিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হিসেবে। অনেকে জানে না, এটি আগে রমনা রেসকোর্স ময়দান নামে পরিচিত ছিল। এক সময় ঢাকায় অবস্থিত ব্রিটিশ সৈন্যদের সামরিক ক্লাব এখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল। পরবর্তীতে এই মাঠটিকে রমনা রেসকোর্স এবং তারপর রমনা জিমখানা হিসেবে ডাকা হত।
অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম এই ময়দানকে নিয়ে একটা লেখা লিখব। আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। তাদের কাছে এটি পেশ করা যায়। কারণ, তারাই কথা শোনার যথাযথ কর্তৃপক্ষ। প্রবীণরা সবাই জানেন, আগে এ ময়দানে ঘোড়াদৌড়ের বাজি হতো। ঘোড়াদৌড়ের বাজি নাকি এক রকম জুয়া খেলা। ধর্মমতে জুয়া হারাম। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু জাতিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি ক্ষমতায় গেলে মদ-জুয়া বন্ধ করে দেবেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তখন তিনি মদ-জুয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তখন ঘোড়দৌড়ও বন্ধ হয়ে যায়। মাঠটি পরিত্যক্ত হয়।
বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছানুসারে সিটি করপোরেশন (তখন পৌরসভা) তাতে উদ্যান সৃষ্টি করার উদ্যোগ নেয় এবং তা এখন পরিপূর্ণ উদ্যান। বঙ্গবন্ধু এ উদ্যানের নামকরণ করেছিলেন সোহারাওয়ার্দী উদ্যান। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রিমিয়ার এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির দীক্ষাগুরু। বঙ্গবন্ধুর স্কুলজীবন থেকে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে পরিচয়। ইসলামীয়া কলেজে বঙ্গবন্ধু যখন লেখাপড়া করছিলেন তখন তিনি সোহরাওয়ার্দীর সহাচর্যে থেকেই রাজনীতির পাঠ নিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্পর্কের কারণে তিনি ঘোড়দৌড়ের মাঠের নামকরণ করলেন ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান’।  কিন্তু বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে এ ময়দানটার একটা ঐতিহাসিক সংযোগ রয়েছে। এ সংযোগের কথা বিবেচনায় এনে ময়দানটার নামকরণ পুনর্বিন্যাস করলে ভুল হবে বলে মনে হয় না।

মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে ‘কায়দে আজম’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল। গান্ধীজী তার এক চিঠিতে জিন্নাহকে ‘কায়দে আজম’ সম্বোধন করেছেন। আর গান্ধীকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাও তার এক চিঠিতে মহাত্মা সম্বোধন করে। চিত্তরঞ্জন দাসকে কংগ্রেস অধিবেশনে এক বক্তা ‘দেশবন্ধু’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। এ সবই ছিলো ব্যক্তিগত পর্যায়ে, যদিওবা উপাধিগুলো তাদের নামের পূর্বে ব্যবহার হতে হতে সর্বজনীনভাবে পরিচিতি লাভ করেছে।

কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়েছিলেন বাঙালি জাতির প্রতিনিধিত্বকারী ময়দানে উপস্থিত ১০/১২ লাখ লোক। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের পর এ ময়দানে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। ওই সভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বসম্মতিক্রমে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে উপাধি প্রদানের ঘটনাটা হচ্ছে এ ময়দানে অনুষ্ঠিত প্রথম ঐতিহাসিক ঘটনা।                                          

১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কনস্টিটিউশন অ্যাসেম্বলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছিল। এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্কস (এলএফও)-এর অধীন। কারণ, তখন দেশে কোনও শাসনতন্ত্র বলবৎ ছিলো না। কথা ছিল নির্বাচিত সংসদ শাসনতন্ত্র রচনা করবে এবং শাসনতন্ত্র রচনার দায়িত্ব সম্পাদনের পর ওই শাসনতন্ত্রের অধীন ওই সংসদ জাতীয় সংসদ হিসেবে পরবর্তী পাঁচ বছর বহাল থাকবে। সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া দল সরকার গঠন করবে।

ইতিহাস বলে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়ার পর পাকিস্তানি চক্র ষড়যন্ত্র শুরু করে। সংসদে মোট আসন ছিলো তিন শ’। আওয়ামী লীগ আসন পেয়েছিলো ১৬০ আসন। জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি পেয়েছিল ৭৮ আসন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সংসদ অধিবেশন প্রথমে ডেকেছিল কিন্তু ষড়যন্ত্রের নীলনকশা অনুসারে অধিবেশন বন্ধ করে দেয়। তখন বাংলাদেশে ব্যাপক আন্দোলন আরম্ভ হয় এবং বহুলোক হতাহত হন।

৭ই মার্চ ঘোড়দৌড়ের মাঠে বঙ্গবন্ধু জনসভা আহ্বান করেন। ওই জনসভায় ১০/১২ লাখ লোক উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর তার ভাষণে ঘোষণা করেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এ জনসভায় তিনি তার অনুপস্থিতিতে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার গাইড লাইনও জাতির কাছে পেশ করেছিলেন। এই ঘটনাটি এই ময়দানের দ্বিতীয় ঐতিহাসিক ঘটনা।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাত্রে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সে রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায় এবং বাংলাদেশে মিলিটারি অপারেশন শুরু করে। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ এর মধ্যরাত থেকে বাংলাদেশের বিদ্রোহী মানুষ, পুলিশ, বিডিআর আর বাঙালি সামরিক বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করার পর পাকিস্তান বাহিনী ১৬ই ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল মিয়াজী আত্মসমর্পণ করেছিলেন এ ঘোড়দৌড়ের মাঠেই। এটি এই ময়দানের তৃতীয় ঐতিহাসিক ঘটনা।

বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির পরাধীনতার পাপ মোচনের জন্য ক্রুশবিদ্ধ হওয়া অবধারিত ছিল। দীর্ঘ দশ মাস তিনি পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন। তার ফাঁসির আদেশও হয়েছিল কিন্তু ভাগ্যের ফেরে তিনি বেঁচেছিলেন এবং ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। বাঙালি জাতির এ মহান বীরকে সেদিন জাতির পক্ষ থেকে বীরোচিত সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছিলো এ ঘোড়দৌড়ের মাঠেই। এটা চতুর্থ ঐতিহাসিক ঘটনা।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের মধ্যরাতে পাকিস্তানিরা মিলেটারি অপারেশন আরম্ভ করেছিল বাংলাদেশে। তখন পাকিস্তানি মিলেটারির অত্যাচারে ১ কোটি বাঙালি বাস্তুত্যাগী হয়ে ভারতে চলে গিয়েছিল। ভারত দীর্ঘ নয় মাস এক কোটি লোককে শুধু আশ্রয় দিয়েছিল তা নয় তাদের খাওয়ারও ব্যবস্থা করেছিল এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়েছিল। চূড়ান্ত যুদ্ধে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধও করেছিল।

আসলে মুক্তিবাহিনী আর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যৌথ অভিযানেই ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ হানাদার মুক্ত হয়েছিল। মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর এ অভিযানের সময় ১৪ হাজার ভারতীয় সৈন্য প্রাণ হারায়। মূলত: মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত রক্তস্রোতের ওপর দিয়েই বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। এই মহীয়সী নেত্রীর আন্তরিক সহযোগিতা না পেলে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে সুদীর্ঘ সময় যুদ্ধ করতে হতো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ মহিয়সী নেত্রী বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছিল এ ঘোড়দৌড়ের মাঠেই। এটা এই মাঠের সর্বশেষ ঐতিহাসিক ঘটনা।

স্বাধীনতা সংগ্রামের সব কিছুই আবর্তিত হয়েছে এ ময়দানকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এ ঘোড়দৌড়ের মাঠটার নাম ‘স্বাধীনতা উদ্যান’ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। যদিওবা ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না। এ ময়দানের সব ঘটনাই ঐতিহাসিক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে নিয়ে আবর্তিত। ইতিহাস তা সংরক্ষণের দায়িত্ব নেবে। তবুও ময়দানটার নাম ‘স্বাধীনতা উদ্যান’ হলে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হতো। আমার নাম পাল্টানোর প্রস্তাবটা ইতিহাসের অবলুপ্তি নয়, ইতিহাসের সফস্টিকেশান।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকেও অবমাননা করা যাবে না। তিনিও আমাদের জাতীয় নেতা সুতরাং রমনা পার্ক-এর নাম তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হিসাবে নামকরণ করা যেতে পারে। তার নামে এর চেয়ে বড় কিছুও করা যেতে পারে। জেনারেল নিয়াজী যে স্থানে আত্মসমর্পণ করেছিলেন সে স্থানে একটা মনুমেন্ট তৈরি করে নাম দেওয়া যেতে পারে ‘বাংলাদেশ মনুমেন্ট’। এখন যে গ্লাস টাওয়ার করা হয়েছে সেটাকে যদি এর বিকল্প ভাবা হয় নতুন মনুমেন্টও প্রয়োজন নেই। তবে সবকিছু মিলে এখনও ময়দানটি পরিকল্পিত ব্যবহার হতে দেখা যাচ্ছে না। পাকিস্তানে দেখেছি ১৯৪০ সালে ২৩শে মার্চ লাহোরের যে স্থানে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিলো সেখানে পাকিস্তান মনুমেন্ট তৈরি করে ইতিহাসের যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তারা।

গবেষক ছাড়া সাধারণ মানুষ যাদুঘরেও যায় না, আর্কাইভেও যায় না- তাই সাধারণ মানুষের জন্য দৃশ্যমান স্মৃতিস্তম্ভ প্রয়োজন এবং তা থেকেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানুষ অনুপ্রেরণা লাভ করে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কিছু স্থাপনা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু, ‘শিখা চিরন্তন’ ছাড়া অন্যসব স্থাপনা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মতো। সাধারণ মানুষ তার কিছুই বোঝে না। ‘শিখা চিরন্তন’ উদ্বোধনের অনুষ্ঠানটা ছিলো খুবই স্মরণীয়। স্বাধীনতা ২৫ বছর উদযাপনে এই উদ্যানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্ববরেণ্য নেতা নেলসন মেন্ডেলা, ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রামের নেতা ইয়াসির আরাফাত, তুরস্কের সাবেক প্রেসিডেন্ট সুলেমান ডেমিরেল উপস্থিত ছিলেন।

আশা করি সরকার রেসকোর্স ময়দানকে ঘিরে স্বাধীনতার স্মৃতিগুলোকে দৃশ্যমান করবে এবং এই উদ্যানের নাম পরিবর্তন করে ‘স্বাধীনতা উদ্যান’ করবে।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মঙ্গোলিয়ার দাবাড়ুকে হারিয়ে ফাহাদের মুখে হাসি
মঙ্গোলিয়ার দাবাড়ুকে হারিয়ে ফাহাদের মুখে হাসি
চেয়ারম্যান হলেন ৯ এমপির স্বজন, হেরেছেন দুজন
চেয়ারম্যান হলেন ৯ এমপির স্বজন, হেরেছেন দুজন
পিছিয়ে পড়েও জোসেলুর জোড়া গোলে ফাইনালে রিয়াল
চ্যাম্পিয়নস লিগপিছিয়ে পড়েও জোসেলুর জোড়া গোলে ফাইনালে রিয়াল
চেয়ারম্যান হলেন এমপির ছেলে ও ভাই
চেয়ারম্যান হলেন এমপির ছেলে ও ভাই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ