X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

১০ টাকার চালে নয়ছয় কেন?

শুভ কিবরিয়া
২৩ অক্টোবর ২০১৬, ১৬:৫৫আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০১৬, ১২:৩৬

শুভ কিবরিয়া হতদরিদ্রদের জন্য সরকারের খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির অধীনে ১০ টাকা কেজি দরে চলে বিতরণে বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাটের অভিযোগের খবর প্রতিদিনই সংবাদপত্রে আসছে। ১০ টাকা কেজি দরে পাওয়া চাল খোলাবাজারে বেশি দামে বিক্রি করে মুনাফা করছেন একশ্রেণির মানুষ। এই চাল সরবরাহের ক্ষেত্রে নানারকম অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষত চাল দেওয়ার জন্য হতদরিদ্র মানুষদের যে তালিকা তৈরি হয়েছে, তাতেই রয়েছে গলদ। প্রকৃত গরিবদের বদলে সামর্থ্যবান মানুষরা এই তালিকাতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। এই তালিকা তৈরিতে প্রভাব রেখেছেন যারা, তারাই এর সুবিধাভোগী হয়েছেন। বিশেষত সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা প্রভাব খাটিয়ে এই তালিকায় নিজেদের লোক ঢুকিয়েছেন। নিজ দলের সরকার ক্ষমতায় থাকলে একটা রাজনৈতিক দল এ রকম কিছু সুবিধা নেবে, সেটা খুব অস্বাভাবিক কোনও বিষয় নয়। তবে দেখার বিষয় যাদের জন্য এই সহায়তা, তালিকায় সেই হতদরিদ্র মানুষের বদলে দলীয় পরিচয়ে অধিকতর সামর্থ্যবান, সচ্ছল মানুষ ঢুকে পড়ছেন কিনা? সেটাই ঘটেছে এই চাল বিতরণের তালিকায়। তালিকা তৈরিতে আশ্রয় নেওয়া হয়েছে নানা জালিয়াতি ও স্বেচ্ছাচারিতার। ধনী, সচ্ছল ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দেওয়া হয়েছে চালপ্রাপ্তির কার্ড। যে কারণে প্রকৃত হতদরিদ্ররা বঞ্চিত হচ্ছেন। অন্যদিকে এই চালের ডিলারশিপও পেয়েছেন রাজনৈতিক ক্ষমতাধররা। ফলে অনেক ডিলার নামমাত্র পরিমাণে চাল বিতরণ করে বাকি চাল বিক্রি করে দিচ্ছেন খোলা বাজারে। অনেক জায়গায় কার্ডধারীরাও চাল না পেয়ে ভগ্ন মনোরথে ফিরে গেছেন।
অর্থাৎ ১০ টাকার চাল বিতরণ কর্মসূচিটি ব্যাপকতর অনিয়ম ও দুর্নীতির মধ্যে পড়েছে। যে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের এটি মনিটরিং করার কথা, সেই জেলা বা উপজেলা বেসামরিক প্রশাসন সেই তদারকি করতেও ব্যর্থ হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রিতিনিধি ও সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে মিলেমিশে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন ১০টাকা মূল্যে হতদরিদ্রদের জন্য চাল বিতরণ কর্মসূচিটির এমন একটা অবস্থা তৈরি করেছে, তাদের পক্ষেও স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতাধরদের কোনও অনিয়ম-দুর্নীতি রোখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কেননা হয় তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর আর্থিক বেনিফিশিয়ারি হয়েছেন, নয় রাজনৈতিকভাবে তারা এতটাই পক্ষপাতদুষ্ট যে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সীমারেখা মাড়িয়ে তারা দলীয় ক্যাডারের চেহারাই নিয়ে ফেলেছেন। তারা যে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী এই সত্যটা এখন আর তারা বিশ্বাসও করেন না, কর্মেও তার আঁচড় নেই।
ফলে, ১০ টাকা দরে প্রকৃত হতদরিদ্রদের হাতে চাল যাওয়ার সুযোগটুকু তারা নিশ্চিত করতে পারেননি।
০২ .
খোলা বাজারে চালের দাম বেড়েছে। দেড় মাস ধরে মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি ৮ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। অন্যান্য চালের দামও কেজিপ্রতি কয়েক টাকা বেড়েছে। বাজারে চালের দামের এই বাড়তি ধারা লক্ষ করে সরকার খোলা বাজারে ন্যায্যমূল্যে ১৫ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির উদ্যোগও নিয়েছে। আমন ধান না ওঠা পর্যন্ত ঢাকা মহানগর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগীয় শহরে ১৫ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে, খোলা বাজারে চালের দাম বাড়তির দিকে। এই সুযোগটাকেও কাজে লাগিয়েছে ১০ টাকা দরে হতদরিদ্রদের চাল বিতরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব মহল। ১০ টাকা কেজি দরের হতদরিদ্রদের জন্য দেওয়া চাল যেন খোলা বাজারে বিক্রি না হতে পারে, এ জন্য কোনও ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। সরকারদলীয় মুনাফাখোর দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে প্রশাসনের দলদাস ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের আঁতাত এই গরিবঘেঁষা অসাধারণ ভালো সরকারি উদ্যোগকেও ব্যর্থ করে দিয়েছে।
০৩.
বলা চলে রাষ্ট্র, রাজনীতি ও প্রশাসনে এখন দৃশ্যমান সুশাসন নেই। বিশেষত ক্ষমতাধররা এখন সুশাসনের আওতামুক্ত। তারা এক ধরনের আইনি ও রাষ্ট্রনৈতিক দায়মুক্তি পেয়ে গেছেন। দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর ন্যায্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো কার্যকর রাখা যায়নি।  দুর্নীতিবাজদের অর্জিত অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফিরিয়ে আনার কোনও ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি। এ সমস্যার কারণে দুর্নীতি এবং সুনীতি বিষয়ে জনধারণার ব্যাপকতর পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ ভাবে যে দুর্নীতি করে, সে ক্ষমতাবান। সমাজ দুর্নীতিবাজদের এখন সম্ভ্রম ও ভয়ের চোখে দেখে। যারা দুর্নীতি করে, তারা এখন আর লোকলজ্জার ভয় করে না। ছিঁচকে দুর্নীতিবাজ থেকে শীর্ষ ক্ষমতাধর দুর্নীতিবাজ—সবাই দুর্নীতি করে আনা টাকা দেশে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে রাখতে পারে। অথবা বিদেশে সহসাই পাঠিয়ে দিতে পারে। দুর্নীতির টাকা দেশে অথবা বিদেশে নিরাপদ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনও আইনি ভয়, সামাজিক ভয়, লোকলজ্জা, রাষ্ট্রিক ভয় আর এখন নেই। রাষ্ট্র, রাজনীতি, আমলাতন্ত্র দুর্নীতি বিষয়ে একটি শক্তিমান সিন্ডিকেট গড়ে  তুলেছে। সে কারণেই মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বিদেশি বন্ধুদের সম্মানজনক পদকে সোনার বদলে খাদ মিলিয়ে দিলেও এখন আর আমাদের আপত্তি নেই। আবার এই অপকর্মের জন্য যারা দায়ী, তারাও শাস্তির আওতায়মুক্ত থেকেছেন নির্বিঘ্নেই। দুর্নীতি, ক্ষমতা ও সামাজিক আচরণের এই নির্বিকারত্ব এক ভয়াবহ নির্লিপ্ততা তৈরি করেছে।
০৪.
সেই নির্লিপ্ততা আর লজ্জাহীনতা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার একটা কাহিনি বয়ান করি। সংবাদপত্রে এই খবরটি বেরিয়েছে।
২০১৭ সালের  ১ থেকে ৫ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) ১৩৬তম সম্মেলনের । নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ এ ব্যাপারে সরকারের প্রস্তুতির বিষয়টি ২৩ অক্টোবর ২০১৬ জেনেভায় অনুষ্ঠেয় আইপিইউর ১৩৫তম সম্মেলনে লিখিতভাবে উপস্থাপন করা হবে।  আইপিইউ সম্মেলনকে সফল করতে সংসদ সচিবালয়ের সচিবের নেতৃত্বে একটি সাংগঠনিক এবং ২৪টি উপকমিটি গঠন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইপিইউ সম্মেলন উদ্বোধন করবেন। সম্মেলনে ১৭০টি দেশের ৫৫ জন স্পিকারসহ তিন হাজারের বেশি সাংসদের অংশ নেওয়ার কথা। বিভিন্ন দেশের আইনসভার কর্মকর্তাদের নিয়ে সম্মেলনে তিন হাজারের বেশি লোক অংশ নেবেন। রাজধানীর ২৭টি হোটেলে অতিথিদের রাখা হবে।
অতিথিদের আবাসনে কত খরচ হবে, তার একটি দরতালিকা পাঠানো হয়েছে আইপিইউর সদর দফতরে সম্মেলনের আবাসন উপকমিটির পক্ষ থেকে। এই দরতালিকায় কাওরান বাজারের হোটেল লা ভিঞ্চির দিনপ্রতি ভাড়া ১৬০ ডলার প্রস্তাব করে আইপিইউর সদর দফতরে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু আইপিইউ কর্তৃপক্ষ অনলাইনে পরীক্ষা করে জানতে পারে, লা ভিঞ্চির ভাড়া মাত্র ৯০ ডলার। বিষয়টি তারা সংসদ সচিবালয়কে জানালে এ নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
এ ঘটনায় আলী আশরাফ নামের এক কর্মকর্তাকে আবাসন উপকমিটির সদস্যপদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর্থিক স্বচ্ছতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হিসাব ও নিরীক্ষা নামের একটি নতুন উপকমিটি গঠন করা হয়েছে।
০৫.
একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজক দেশের পক্ষে এ রকম জুয়াচুরির ঘটনা দেশের সম্মানকে কোথায় নামিয়ে দেয়। অথচ এতবড় নিন্দনীয় এবং দেশের জন্য অসম্মানজনক ঘটনা ঘটানোর শাস্তিই বা কী হহো?  বড় জায়গা থেকে সায় না থাকলে একজন সাধারণ কর্মকর্তার পক্ষেই কি এ রকম বড় দুর্নীতির ঘটনা ঘটানো সম্ভব! এ সব ঘটনা প্রমাণ করে দুর্নীতিবাজ আর দুর্নীতি প্রতিরোধকারীদের একটা পারস্পরিক সম্মিলন ঘটে গেছে দেশে। কোনও পক্ষই এ রকম দুর্নীতি আর জোচ্চুরির ঘটনা ঘটিয়ে অপরাধবোধে ভোগে না। অপরাধ করে শাস্তি পাবে সেই ভাবনা এখন দূরহস্ত । ফলে দুর্নীতির এই অসুখ ক্ষমতাবানদের সুখের বিষয়ে পরিণত হয়ে গেছে।
এই সামাজিক ও রাজনৈতিক রোগ না সারালে সরকার যতই জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপ নিক না কেন, দুর্নীতিবাজরা তা মাঝপথেই খেয়ে ফেলবে। যাদের জন্য এই সুবিধা তৈরি করা হোক না কেন, তারা কখনোই এসব পদক্ষেপের সুফল পাবে না। ১০ টাকা কেজি দরে হতদরিদ্র মানুষদের জন্য নেওয়া প্রকল্পও এই রোগে আক্রান্ত।
রক্ষক ও ভক্ষকের অসাধু মিলন চালু থাকলে দরিদ্র জনমানুষের জন্য নেওয়া কোনও কল্যাণকর সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রকল্পই আর সফল করা যাবে না।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
বিক্রির জন্য সবজি কিনে ফেরার পথে দুই ব্যবসায়ী নিহত
বিক্রির জন্য সবজি কিনে ফেরার পথে দুই ব্যবসায়ী নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ