X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের প্রতি দৃষ্টি রাখুন

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
০৩ নভেম্বর ২০১৬, ১৩:৩৩আপডেট : ০৩ নভেম্বর ২০১৬, ১৩:৩৭

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী জাতিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত ওল্ডটেস্টোমেন্টের চেয়েও প্রাচীন। মিয়ানমারের অধিকাংশ লোক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। রোহিঙ্গারা মুসলমান। রোহিঙ্গারা বসবাস করে আকিয়াব ডিভিশনে। এলাকাটা বাংলাদেশ সংলগ্ন। বার্মার সামরিক সরকার বার্মার নাম পরিবর্তন করে মিয়ানমার করেছে আর আকিয়াব ডিভিশনটাকে করেছে রাখাইন প্রদেশ।
পূর্বে এ এলাকাটায় ছিল রোসাং রাজের রাজত্ব। রোসাং রাজার সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ ছিল। তার রাজসভায় কবি ছিলেন মাগন ঠাকুর, আলাউল। তারা উভয়ে ছিলেন বাঙালি। মাগন ঠাকুরের বাড়ি ছিল চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানায়। আর কবি আলাউলের বাড়ি ছিল হাটহাজারী থানায়। এখনও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বপাশে আলাউলের দীঘি মসজিদ আছে। শেষ বয়সে আলাউল হাটাহাজারীতে ভিক্ষাবৃত্তির ওপর নির্ভর করে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন।
সম্ভবতো রোসাং রাজার কোনও সমৃদ্ধ ভাষা-সাহিত্য ছিল না।  যে কারণে তার রাজসভায় বাংলা সাহিত্য চর্চার আসর জমেছিল। আলাউল পদ্মাবতী রচনা করেছিলেন রোসাং রাজসভায় বসে।
১৯৩৬ সাল পর্যন্ত মিয়ানমার ভারত উপ-মহাদেশের অংশ ছিল। ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশ সরকার মিয়ানমারকে বিচ্ছিন্ন করে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র বার্মা প্রতিষ্ঠা করেছিল। অবশ্য বার্মা প্রাচীনকাল থেকে কখনও দিল্লি কেন্দ্রীক কোনও শাসকের অধীন ছিল না। স্বতন্ত্র রাজবংশ বার্মা শাসন করতো। ১৮৫৭ সালের মহা বিদ্রোহের পর মুঘলের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে ব্রিটিশেরা মায়ানমারের প্রাচীন রাজধানী মান্দালয়ে নির্বাসনে পাঠিয়ে ছিলেন। তিনি বন্দী জীবনে তার সমাধি ফলক লিখে গিয়েছিলেন। ভারতের বিষয়ে তার অনুশোচনা রয়েছে ওই ফলকে। তিনিও মিয়ানমারকে তার নিজস্ব ভূমি বলে বিবেচনা করেননি। তার ফলকটায় লিখা ছিল। ‘কিতনা বদ নসিব হ্যায় জাফর, দাফনে কে লিয়ে দু গজ জমিন ভি না মিলি কু ইয়ার মে।’ তার আক্ষেপ ছিল প্রিয় ভূমিতে দুগজ কবরের জায়গা না পাওয়ার আক্ষেপ। তিনি মিয়ানমারকে তার প্রিয় ভূমি মনে করেননি। কারণ তা কখনও দিল্লির শাসনাধীন ছিল না।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ছাড়া ১৩৫ টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে। কারও সঙ্গে তাদের ভালো সম্পর্ক নেই। সবাই বিদ্রোহী। মিয়ানমারের লোকেরা বলে রোহিঙ্গারা সবাই নাকি বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে প্রবেশ করেছে।
মিয়ানমারের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ইরাবতী নদী। ইরাবতীর উভয় তীর খুবই উর্বরা। ধান হয় প্রচুর। খাদ্যে মিয়ানমার স্বয়ং সম্পূর্ণ। উৎবৃত্ত খাদ্যশস্য বিদেশে রফতানি করে। মিয়ানমারের পুরুষেরা নিকর্মা, মেয়েরাই সব কাজ করে। পূর্বে মেয়েরা শুধু খোয়াকির জন্য যতটুকু জমি চাষ করতে হত তাই করতো। চট্টগ্রামের লোক গিয়েই আবাদের কাজ শুরু করে। এক সময়ে বৃহত্তম চট্টগ্রাম, বৃহত্তম নোয়াখালীর লোকেরা একচেটিয়াভাবে (বার্মায়) মিয়ানমারে চাষাবাদের কাজ করতো। তাদের জমির মালিকানাও ছিল। বোম্বাইয়্যা এসে রাইস মিল প্রতিষ্ঠা করে। গত শতাব্দীর প্রথম দশকে মিয়ানমার চাল রফতানি আরম্ভ করে। সুদীর্ঘ সময় ব্যাপী এ ব্যবস্থা বহাল ছিল।

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও মিয়ানমারের লোক ধর্মের প্রতি উদাসীন ছিল। চট্টগ্রাম আর নোয়াখালীর হাজার হাজার লোক মিয়ানমারের মেয়ে বিয়ে করেছে। চট্টগ্রাম এমন কোনও বাড়ি ছিল না যে বাড়িতে দু একজন বার্মার মেয়ে বউ হয়ে আসেনি। আমার চট্টগ্রামের বাড়িতেও বার্মার মেয়ে ছিল। আমরা কড়ি কুড়িয়ে দিয়ে তাদের থেকে বার্মার ভাষা শিখতাম।

গত শতাব্দীর ছয় দশক থেকে তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ শুরু করে। মিয়ানমারেও সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল। সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করে সব বিদেশিকে বিতাড়িত করে দেয়। বাঙালি, গুজরাটি, বোম্বাইয়্যা কেউ বাদ যায়নি। সবার সব সহায় সম্পদ সরকার-রাষ্ট্রায়াত্ব করে নেয়। কাউকেও কোনও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। এক কাপড়ে বিতাড়িত করেছিল। সেই থেকে রোহিঙ্গা সমস্যার উদ্ভব।

সরকার রোহিঙ্গাকে বার্মার নাগরিক হিসাবে মেনে নিতে চাননি। তামিলদেরকে ব্রিটিশেরা শ্রীলংকার চা বাগানে কাজ করার জন্য নিয়ে গিয়েছিল। তারা চ্যানেলের অপরদিকের তামিলনাড়র লোক। সুতরাং শ্রীলংকার সরকার তামিলদেরকে শ্রীলংকার লোক নয় বলার পেছনে যুক্তি থাকতে পারে কিন্তু রোহিঙ্গাকে কোনও প্রয়োজনে ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশ থেকে আকিয়াবে নিয়েছিল বলে কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। মূলত তারা আকিয়ারেই  লোক। পুরুষানুক্রমে তারা আকিয়াবের বসবাস করে আসছে। তামিলদেরকে শ্রীলংকার মানুষ না হওয়ার পরও শ্রীলংকা সরকার তাদের থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেনি। তামাম জাফনার উপকূলে তামিলরা বসবাস করে। শ্রীলংকার রাষ্ট্রীয়সভায় তাদের প্রতিনিধিও রয়েছে।

গত শতাব্দীর সাত দশকে রোহিঙ্গাদের নেতা ছিল (স্বঘোষিত) মেজর জেনারেল কাসেম রাজা। কাসেম রাজাকে পাকিস্তান সরকার নাকি অস্ত্র আর টাকা দিয়ে সাহায্য করতো। কাসেম রাজা আকিয়াবে থাকতে পারতেন না। পরিবার পরিজন নিয়ে চট্টগ্রামে থাকতেন। গোলাপ সিং লেনের মুখে তার একটা আবাসিক হোটেল ছিল। তার হোটেলের নাম ছিল ইউনাইটেড হোটেল। তখন আমি থাকতাম পাশ্ববর্তী হরিষদত্ত লেনে। কাসেম রাজার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ কথা বার্তা হত। তার মুখে শুনেছি রোহিঙ্গারা নাকি সংখ্যায় ১০ লাখ। ৪৫/৪৬ বছর পরে এখন শুনি রোহিঙ্গারা নাকি ১১ লাখ।

এত কম হওয়ার কারণ সংখ্যায় বাড়লেও তারা বিভিন্ন জায়গায় নিরাপত্তার জন্য চলে গেছে। নৌকায় করে পালাতে গিয়ে গত ৪৫/৪৬ বছরে ২/৩ লাখ রোহিঙ্গার বঙ্গপোসাগরে সলিল সমাধি হয়েছে। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান গিয়েছিলাম। করাচির লিয়াকতাবাদে ছিলাম। সেখানে সব কাপড়ের মিল। ৮ লাখ বাঙালি চাকরি করতো। তখন বহু রোহিঙ্গাকেও সেখানে দেখেছি। বাংলাদেশ  স্বাধীন হওয়ার পর বাঙালিরা চলে আসলেও রোহিঙ্গারা নাকি আসেনি। মধ্যপ্রাচ্যেও বহু রোহিঙ্গা রয়েছে। সৌদি আরবে সবচেয়ে বেশি। সবার পাসপোর্ট নাকি বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি। বিভিন্ন সময়ে উৎপীড়িত হয়ে বহু রোহিঙ্গা বাংলাদেশেও এসেছে। এখনও কক্সবাজারে তাদের শরণার্থী ক্যাম্প রয়েছে।

জিয়াউর রহমান যখন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট তখন মারমা, লারমা, চাকমারা বান্দারবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ছেড়ে ভারতে চলে গিয়েছিল কারণ বাঙালি বসতি স্থাপনের বিষয়ে আপত্তি করায় দুইশতাধিক হেড ম্যানকে দাওয়াত দিয়ে এনে হত্যা করা হয়েছিল। ভীত হয়ে উপজাতিরা চলে গিয়েছিল। তারা শান্তিবাহিনী গঠন করে স্বশস্ত্রও হয়েছিল। উৎপাতও কম করেনি। কিন্তু ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার পর বাস্তুত্যাগী নেতা সন্তু লারমার সঙ্গে চুক্তি করে তাদেরকে ফেরৎ এনেছিলেন এবং প্রত্যেক পরিবার পিছু ৫০ হাজার টাকা পুনঃবাসনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রদান করেছিলেন।

এটি ছিল শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ দূরদর্শিতা। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া এবং গোলাম আজম সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে লং মার্চ করেছিলেন। খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে সমাবেশ করে বেগম জিয়া বলেছিলেন, সরকারের এ চুক্তির ফলে ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে। যাক, রোহিঙ্গারাও উৎপীড়িত হয়ে বাংলাদেশে এসেছে কিন্তু মিয়ানমার সরকার এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মতো তাদেরকে ফেরৎ নেওয়ার কোনও উদ্যোগই গ্রহণ করেননি। অবশ্য এতদিন সামরিক সরকার ছিল। খুবই আশার কথা যে অং সাং সুচির দল সরকার গঠন করার পর সুচি রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আনান কমিশন গঠন করেছেন। দেখা যাক আনান কী রোয়েদাদ প্রদান করেন।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে এ লেখা লিখেছি সংবাদপত্রে একটা রিপোর্ট দেখে। গত ৯ অক্টোবর মংড়ুতেতে বার্মার তিনটা পুলিশ চেকপোস্টে হামলা চালিয়ে ৯ জন পুলিশ হত্যা করেছে জঙ্গিরা। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট তিন কিয়াও এ হামলার জন্য আকায়ামুল মুজাহিদীনকে দায়ী করে একটা বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি তার বিবৃতিতে বলেছেন যে, পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করে এ হামলা চালিয়েছে।

কিন্তু রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সৈন্যরাও এর আগে অভিযান চালিয়েছে এবং রোহিঙ্গা নারীদের বন্দুকের মুখে ধর্ষণ করেছে। রোহিঙ্গা নারীরা রয়টার্সের কাছে সাক্ষাৎ প্রদান করে এ অভিযোগ করেছে। মানবাধিকার সংস্থা এ বিষয়ে স্বাধীন তদন্তের দাবিও তুলেছে।

রোহিঙ্গাদের সমস্যার আশু সমাধানের প্রয়োজন তা নিয়ে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকারের আলোচনা করা দরকার। না হয় পাকিস্তানের আইএসআই এতে ঢুকে যাবে এবং মধ্যপ্রাচ্যের আইএস-ও আসবে। তখন বিষয়টা মিয়ানমার, বাংলাদেশ আর ভারতের জন্য এক কঠিন সমস্যার সৃষ্টি করবে।

লেখক: রাজনীতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চীনে রুপা জিতে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সুকান্ত ও নয়ন
চীনে রুপা জিতে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সুকান্ত ও নয়ন
বাংলাদেশ ব্যাংকে সংবাদকর্মীদের প্রবেশে বাধা: উদ্বিগ্ন টিআইবি
বাংলাদেশ ব্যাংকে সংবাদকর্মীদের প্রবেশে বাধা: উদ্বিগ্ন টিআইবি
আপাতত গরমেই খেলতে হচ্ছে সাবিনা-সানজিদাদের
আপাতত গরমেই খেলতে হচ্ছে সাবিনা-সানজিদাদের
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ