X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিশুদের জন্য চারপাশ কি অজানাই রয়ে যাবে?

ফারহানা মান্নান
০৬ নভেম্বর ২০১৬, ১২:৫৯আপডেট : ০৬ নভেম্বর ২০১৬, ১৩:১৭

ফারহানা মান্নান পরিবেশ সম্পর্কে শিক্ষা ঠিক কখন থেকে শুরু করা উচিত? তৃতীয় শ্রেণি? প্রথম শ্রেণি? নাকি প্রাথমিক পর্যায় থেকেই? উত্তর হলো আরও অনেক আগে থেকে। পরিবেশ সম্পর্কিত শিক্ষা যা জীবন ঘনিষ্ট তা আসলে শুরু করা উচিত জীবনের প্রথম বছরের সময় থেকেই। এই ধরনের শিক্ষা জীবনকে সাজাতে, মূল্যবোধ সৃষ্টিতে, পরিবেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শিশুরা আসলে পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা লাভ করে পরিবেশের সঙ্গে একাত্মতা লাভের মাধ্যমেই। তাই প্রত্যেক অভিভাবকেরই উচিত তাদের সন্তানদের নিয়ে পরিবেশ অন্বেষণের জন্য বেশ কিছু সময় কাটানো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য পরিবেশকে অনুসন্ধান করার সুযোগ আমাদের ছেলেমেয়েরা খুব কমই পায়। ছেলেমেয়েরা তাদের বেশিরভাগ সময়ই এমন সব কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত থাকে যা তাদেরকে প্রকৃতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এই যেমন ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেলিভিশন দেখা, মোবাইলে গেমস খেলা।
শহরের শিশুদের জন্য পরিবেশটা এমন তৈরি হয়েছে যেখানে বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরা চলাফেরার ক্ষেত্রে হাঁটার চাইতে যানবাহনের ব্যবহারটাই করে বেশি। ফলে চারপাশে তাকিয়ে দেখার সুযোগ কোথায়? হয় তারা বসে সময় কাটায় আর নয়তো বন্দী থাকে গৃহে বা কোনও প্রি-প্রাইমারি পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। আর ফলাফল স্বরূপ পরিবেশ সম্পর্কে শিশুদের মধ্যে কোনও প্রকার আবেগ বা ইতিবাচক আচরণ তৈরি হয় না। তারা তাদের আশপাশের পরিবেশ সম্পর্কে থাকে অন্ধ।
প্রাক-শৈশব পর্যায়ের পরিবেশগত শিক্ষার ভিত্তি দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এক- শিশুদের জন্মের প্রথম কয়েক বছরের মধ্যেই পরিবেশগত শিক্ষা দিতে হবে তা না হলে ভবিষ্যতের জন্য বড্ড দেরী হয়ে যাবে। দুই- শিশুর স্বাস্থ্যসম্মত বিকাশের পথে এ শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে তার জন্য পরিবেশকে বুঝতে এর কাছাকাছি যেতে হবে। যদি কোনও শিশু ইতিবাচকভাবে পরিবেশের সঙ্গ লাভ করে তবে এ শিক্ষা তার সারাটা জীবনের শিক্ষা হয়েই রয়ে যায়। যে সকল অভিভাবকেরা তাদের শিশুদের ক্ষেত্রে উপরের দুটি বিষয়ের ওপরে গুরুত্বারোপ করেন এবং শেখার ক্ষেত্রে কেবলমাত্র বই বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর না করে শিশুদের শিক্ষাকে বাস্তবমুখী করতে প্রকৃতি ও পরিবেশের কাছাকাছি নিয়ে যায় তাদের সন্তান আশপাশ সম্পর্কে মুক্ত ধারণা নিয়েই বড় হয়। যা পরবর্তীতে শিশুর সাধারণ জ্ঞানের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। তাই পরিবেশ সম্পর্কে আশ্চর্য অনুভূতি তৈরি করতে আনন্দের সঙ্গে অনুসন্ধিৎসু মানসিকতাও তৈরি করতে হবে।

শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তারা পৃথিবী নামক এই গ্রহটির ভবিষ্যত নেতা। কাজেই তাদের মধ্যে এই গ্রহ সম্পর্কে ধারণা দিতেই হবে যাতে করে তাদের মধ্যে তা রক্ষা করার একটা প্রবণতা জন্ম নেয়। অভিভাবক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো একটি নিরাপদ বিশ্ব তৈরিতে প্রয়োজনীয় জ্ঞান আমাদের সন্তানদের মধ্যে প্রবাহিত করা। আমাদের সন্তানদের শৈশব থেকেই শেখাতে হবে যে পরিবেশ বান্ধব হয়ে গড়ে ওঠাটা কোন ইচ্ছা-নির্ভর বিষয় নয়, কর্তব্যের বিষয়। আধুনিক সমাজে শিশুরা এত বেশি গৃহমুখী যে তারা আশেপাশের পরিবেশটা সবুজ থাকার গুরুত্বই অনুধাবন করতে পারেন না। আমরা যদি সন্তানদের পরিবেশ বান্ধব হয়ে ওঠার শিক্ষা না দেই তবে তারা এর গুরুত্ব অনুধাবন করতেই পারবে না। ফলাফল স্বরূপ একটা প্রজন্ম পরে দেখা যাবে পরিবেশটা মানুষের বসবাসের জন্য অনপযুক্ত হয়ে পড়েছে। কাজেই শিশুদেরকে বেশি বেশি বাইরের পরিবেশে নিয়ে যেতে হবে। তাদের নিয়ে বহিরঙ্গন কার্যক্রম করতে হবে- নতুন কিছু দেখা, মাটি বা বালি নিয়ে মাখামাখি করা, গাছ লাগানো, বাগান করা, সমুদ্রের পাশে ঘুরে বেড়ানো যদি সম্ভব হয়, খামার করা, বিড়াল বা অন্য কোনও প্রাণীর যত্ন নেওয়া ইত্যাদি।

সাধারণত শিশুদের পরিবেশের প্রতি একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকে। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে শিশুরা মুক্ত পরিবেশে খেলতেই বেশি পছন্দ করে। মুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠা একটা শিশুর বুদ্ধিগত ও শারীরিক বিকাশের ক্ষেত্রে বড় রকমের ভূমিকা রাখে। বাইরের পরিবেশে খেলাধূলা করলে শিশুদের আচরণে স্বাভাবিকভাবেই সামাজিকরূপ প্রকাশ পায়, তাদের কাজের প্রতি একাগ্রতাও তৈরি হয়। এমনকি গবেষণায় পাওয়া গেছে যে শিশুর বাড়ির চারপাশে যদি সবুজের সমারোহ থাকে তবে তা তার বিকাশের ক্ষেত্রে টনিকের মতো কাজ করে। গবেষণায় আরও পাওয়া গেছে বিদ্যালয়ের একটি খেলার মাঠ শিক্ষার্থীদের ফলাফলের ওপরে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

প্রকৃতি শিশুদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয়। পরিবেশের নানা উপাদান এবং তার ভূমিকা সম্পর্কে কৌতূহলী করে তোলে। শিশুদের মধ্যে গবেষণার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠার বীজ বপন করে। শিশু সামাজিক জীব হয়ে ওঠে। শিশুর মধ্যে সচেতনতা জন্ম নেয়। শিশুর মন ও মেজাজেও একটা ফুরফুরে ভাব প্রকাশ পায়। সর্বোপরি শিশু তার জানা বা শেখাকে বাস্তব জগতের সাথে মেলানোর অমৃত সুযোগ লাভ করে।   

কাজেই শিশুর শৈশবে বাবা-মায়ের দায়িত্ব হলো সুযোগ হলেই শিশুকে বাইরে কোথাও নিয়ে যাওয়া। সবসময় সম্ভব না হলেও মাঝেমাঝে নেওয়া যেতেই পারে! তাদের নিয়ে বাসার টবে গাছ লাগানোও একটা দারুণ কাজ। শিশু বড় হয়ে স্কুলে গেলে এমন কোথাও দেওয়ার চেষ্টা করা যেখানে মাঠ আছে। খেলার মাঠ কেবল শিশুর বর্ধনকেই নয় বিকাশকেও নিশ্চিত করে। আর সব থেকে দারুণ ব্যাপার হলো একজন শিশু অন্য আরও বহু শিশুদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে আমাদের ঢাকা শহরের বেশিরভাগ স্কুলেই খেলার কোনও মাঠ নেই। তাহলে উপায়? এটা আসলে ভাবনার বিষয়। কারণ পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে হলে চাই মুক্ত পরিবেশ। যা শিশুকে দিতে হবে। এজন্য অভিভাবক হিসেবে সচেতনতা থাকতেই হবে। প্রয়োজনে বাড়ির ছাদে শিশুর খেলার জন্য তারা পরিবেশ তৈরি করে দেবেন। একটা এপার্টমেন্টের ছাদে অনেক পরিবার একত্রিত হয়ে গাছ লাগাতে পারেন। ছোট টাবে মাছ পালন করাও সম্ভব। আবার তারা অনেকে মিলে পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে মুক্ত আলোচনা করতে পারেন। শিশুদের দিয়ে ছবি আকাতে পারেন। নানা ছবি, ভিডিও বা ডকুমেন্টরির মাধ্যমে পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা দিতে পারেন। আসলে করা যায় অনেক কিছুই তবে এক্ষেত্রে সরকার যদি খেলার মাঠের ব্যবস্থা করে দেন তবে সোনায় সোহাগা হবে।

মেধাবী কিন্তু পঙ্গু শিশু তৈরি করে কি লাভ? শিশু তার মেধা দিয়ে বর্তমান সময়টা পার করবে যে কোনও ভাবে কিন্তু ভাবতে হবে ভবিষ্যতের কথা। কয়েক প্রজন্ম পরে কি হবে? পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা না হলে শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েই যাবে। কাজেই চাই একটু, সচেতনতা আর অনেকখানি উদ্যোগ। ভুলে গেলে চলবে না আমরা এক প্রজন্মে নয় অনেক প্রজন্ম মিলেই একটা সুখী ও নিরাপদ বিশ্বের স্বপ্ন দেখতে পারি!

লেখক: শিক্ষাবিষয়ক গবেষক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
পরিবারের অভাব দূর করতে সিঙ্গাপুরে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন রাকিব
পরিবারের অভাব দূর করতে সিঙ্গাপুরে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন রাকিব
কেমন চলছে ভারতের লোকসভার দ্বিতীয় দফার ভোট?
কেমন চলছে ভারতের লোকসভার দ্বিতীয় দফার ভোট?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ