X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘শিশুবিবাহ’ অনুমোদন পেলো মন্ত্রিপরিষদে!

চিররঞ্জন সরকার
২৬ নভেম্বর ২০১৬, ১৩:০৯আপডেট : ২৬ নভেম্বর ২০১৬, ১৩:১০

চিররঞ্জন সরকার দেশের নারী ও মানবাধিকার আন্দোলন কর্মীদের দাবি ছিল-নতুন আইনে যেন শর্তহীনভাবে মেয়েদের ন্যূনতম বিয়ের বয়স ১৮ রাখা হয়। এ জন্য গত চার বছরে আন্দোলন-সংগ্রাম, দেন-দরবার কিছু কম হয়নি। কিন্তু সবার সব দাবিকে অগ্রাহ্য করে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের বুঝকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরলেন। ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৬’-এর খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করা হয়েছে। খসড়ায় মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছরই রাখা হয়েছে বটে, তবে বিশেষ ক্ষেত্রে যেকোনও অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশে এবং মা-বাবার সম্মতিতে বিয়ে হতে পারবে। খসড়া আইনে বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অন্যান্য বিধানে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোনও বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোনও নারীর সর্বোত্তম স্বার্থে, বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণক্রমে, বিবাহ সম্পাদিত হইলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে না’। তার মানে ‘আদালতের নির্দেশে এবং মা-বাবার সম্মতিতে’ কোনও শিশুরও যদি বিবাহ হয়, তবে সেটাও জায়েজ হয়ে যাবে। তার মানে ক্ষেত্রবিশেষে শিশুবিবাহও অনুমোদন পেলো মন্ত্রিপরিষদে! প্রশ্ন হলো, এমন একটি উদ্ভট ও ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত মন্ত্রিপরিষদ অনুমোদন করল কেন, কার স্বার্থে?
‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৬’ শীর্ষক আইনের খসড়ায় বিশেষ ধারায় ‘বিশেষ ক্ষেত্রে’, ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ বা ১৮ বছরের কম বয়সী কোনও মেয়ের ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’ বিবেচনায় বিয়ে হলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না বলে উল্লেখ আছে। ‘অপ্রাপ্তবয়স্কের’ ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’ রক্ষার খুবই ধোঁয়াশাপূর্ণ একটি কথা। কম বয়সী কোনও মেয়ের সর্বোত্তম স্বার্থ কে এবং কিভাবে নির্ধারণ করবেন! যারা এই আইনের খসড়া তৈরিতে মেধা, মনন ও অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করেছেন, তারা বিষয়টিকে কিভাবে ব্যাখ্যা করতে চান? একজন নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার ভোগই তো তার সর্বোত্তম স্বার্থ, যেখানে সব বয়সী নাগরিকই অন্তর্ভুক্ত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, সম্পদ-সুযোগ-সুবিধা ভোগ, ন্যায্য মজুরি ইত্যাদি ইত্যাদি অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। তাহলে কিসের ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’?
বাল্যবিবাহ একজন মেয়েশিশুর জীবনের ঝুঁকি বাড়ায়, অপরিণত সন্তান প্রসবের কারণ হয়, জীবনের সুষ্ঠু বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে, শিক্ষার অধিকার হরণ করে, সমাজ তাকে সামাজিক সম্পর্ক ধারণ ও পরিচর্যায় সামর্থ্যের অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করে, সামাজিক অবক্ষয়ের অনেক কারণের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বাল্যবিবাহের কুফলজনিত সমস্যার চরিত্রটি গভীরভাবে সামাজিক, শুধুই চিকিৎসা সংক্রান্ত বা স্বাস্থ্যগত নয়। তবে কেন বাল্যবিবাহ উচিত নয়, এর কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হলো স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি। অর্থাৎ কম বয়সে বিয়ে মানেই কম বয়সে সন্তান জন্মদান এবং এর স্বাস্থ্যহানিকর ও মানসিক আঘাতজনিত পুরো প্রভাব পড়ে মেয়েটির ওপর। স্বাস্থ্যগত উপাদান ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক উপাদানও জড়িত রয়েছে। তাই একজন মেয়েশিশুর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই বাল্যবিবাহ বন্ধ করা প্রয়োজন। তাহলে কি কেবল একটি স্থায়ী ঠিকানার বন্দোবস্তকেই ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ নারীর ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে?
তাহলে শিশুটির শারীরিক, মানসিক নিরাপত্তার জায়গা বলে কোনও কিছু আদৌ থাকছে কী? নাকি আমরা ভেবে নিয়েছি পিতৃ-মাতৃহীন একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েশিশুর বাল্যবিবাহের পর তার শারীরিক, মানসিক ঝুঁকি নেই বা থাকবে না? কারণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায়, তথা যতদিন সে প্রাপ্তবয়স্ক না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত সহবাস ঘটবার সম্ভাবনা থাকবে না তথা প্রজনন প্রক্রিয়ায় সে লিপ্ত হবে না, ফলে সে গর্ভবতী হবে না, প্রসবের ঝুঁকি বলে কিছু থাকবে না, তাই কি? আবার যদি বুঝে নিতে হয় যে, পিতৃ-মাতৃহীন অবস্থায় একটি স্থায়ী ঠিকানা নয়, বরং ধর্ষণের মতো নানাবিধ জঘন্য অপরাধের শিকার শিশুদের রক্ষার জন্য, সামাজিক আশ্রয়ের জন্য ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ নারীর ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’ হিসেবে বাল্যবিবাহের ব্যবস্থা চালু রাখা জরুরি, তাহলে তো ধর্ষণ স্বীকৃত হয়ে যায় সমাজে! ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’ কথাটির কোনও সুনির্দিষ্ট যুক্তি বা ব্যাখ্যা কারও কাছে নেই। এর মানে কি তা হয়তো দেশের প্রধান আইন কর্তাও জানেন না। ভেজালের এ দেশে সব আইনেও ভেজাল (ফাক) রাখা হয়, দু নম্বরি ও দুর্নীতির জন্য। তার মানে দাঁড়ালো যে কোনও বয়সেই বিয়ে দেওয়া বা করা যাবে, একটু ‘চা পানি’ খরচ করতে হবে। এটা খুবই দুঃখজনক।

মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা আমাদের সমাজ-মানসের গভীরে প্রোথিত রয়েছে। অনেকে গোপনে বা কাজীর কাছে বয়স লুকিয়ে হলেও মেয়ের বিয়ে দেন। ফলে যে আইন অনুযায়ী বিয়েটি বেআইনি হচ্ছে; কিন্তু সেই একই আইন অনুযায়ী আবার বিয়েটি অবৈধ বা বাতিলযোগ্য হচ্ছে না। কেননা আইনে বলা আছে যে বিয়ের ক্ষেত্রে বয়সের ন্যূনতম সীমা যদি কোনও পক্ষ লঙ্ঘন করে সে জন্য তাদের শাস্তি হবে। কেন না তারা একটি বেআইনি কাজ করেছে। কিন্তু তাই বলে তাদের বিয়েটি বাতিল হয়ে যাবে না। এটাই বর্তমান আইনের বিধান।

সর্বশেষ মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত খসড়া আইনে সংযুক্ত ‘বিশেষ বিধানের’ কারণে যদি নাবালক-নাবালিকারা দলে দলে বিয়ের পিঁড়িতে বসে তাহলে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে? ১৬ কোটি মানুষের দেশে আদালত কত আদেশ-নির্দেশ দেবেন? যেখানে লোকবলের অভাবে নিয়মিত মামলা পরিচালনায় হিমশিম খেতে হয়, আদালতগুলোতে বছরের পর বছর ধরে হাজার হাজার লাখ লাখ মামলা ঝুলে রয়েছে, সেখানে ‘বিশেষ স্বার্থের’ দোহাই দিয়ে যদি ঘরে ঘরে শিশু বিবাহের উৎসব শুরু হয়, আদালত তাহলে কী করবে? কত নির্দেশ দেবে? কত বাল্যবিবাহ বন্ধ করবে? এই খসড়া প্রস্তাবটি যদি আইনে পরিণত হয়, তাহলে তা সরকারের বাল্যবিয়ে কমিয়ে আনার লক্ষ্যের বিপরীতে কাজ করবে।

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের জুলাইয়ে লন্ডনে অনুষ্ঠিত গার্ল সামিটে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে পর্যায়ক্রমে কমিয়ে এনে একেবারে বন্ধ করার অঙ্গীকার করেন। সেখানে তিনি ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে বন্ধ করার অঙ্গীকার করেন।

বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনে বিশেষ বিধান যুক্ত করাটা মারাত্মক রকমের ভুল সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার এমনিতেই অনেক বেশি। নতুন বিধানের ফাক দিয়ে বাল্যবিবাহের উচ্চ হার অব্যাহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে। নতুন আইনটিতে শর্তহীনভাবে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর ধার্য করা উচিত এবং খেয়াল রাখা উচিত, যাতে কোনও অজুহাতেই কোনও শিশুর বিয়ে না হয় এবং শিশুদের স্বার্থ আইনের সব বিধানের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইনে নারীর বিয়ের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ বছর। শিশু অধিকারসংক্রান্ত কনভেনশনে (যা বাংলাদেশ অনুমোদন করে ১৯৯০ সালে) শিশুর সংজ্ঞায় বলা আছে যে ১৮ বছর বয়সের নিচে সব ব্যক্তি শিশু হিসেবে বিবেচিত হবে। সেক্ষেত্রে বিশেষ ধারা শিশুবিবাহকেই উৎসাহিত করবে।

সরকারের উচিত বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনটির বিশেষ ধারা বাতিল করা। আইনটিকে আগে ত্রুটিমুক্ত করা। তারপর আইনটি কিভাবে কার্যকর করা যায় সে ব্যাপারে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা। প্রচলিত আইনে নিষিদ্ধ হওয়ার পরও বাল্যবিবাহ সমাজে চালু রয়েছে যতটা না পুরনো আইনের কারণে, তার চেয়ে বেশি প্রয়োগের অভাবে। ২০৪১ সালের মধ্যে সরকারের বাল্যবিয়ে বন্ধ করার লক্ষ্যকে সমর্থন করতে হলে নতুন আইনটিকে সম্পূর্ণভাবে প্রয়োগ করতে হবে। নতুন আইন তৈরির সময় সরকারের পর্যালোচনা করতে হবে, কোন কোন বাধার কারণে বর্তমান আইনের সঠিক প্রয়োগ ঘটেনি। বাধাগুলোর মধ্যে রয়েছে- আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আইনটিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ না করা, ত্রুটিপূর্ণ জন্ম এবং বিবাহনিবন্ধন-প্রক্রিয়া, জন্ম ও বিবাহনিবন্ধনের বিধান অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া, বাল্যবিয়ে সংঘটনে স্থানীয় কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ, দুর্নীতি, অপর্যাপ্ত সামাজিক সচেতনতা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের ধরে রাখার জন্য কার্যকর কর্মসূচির অভাব ইত্যাদি।

‘বাল্যবিবাহ নিরোধ’ আইনটি সংশোধন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সরকারের উচিত নতুন আইনের বিধানের মাধ্যমে বাধাগুলোকে অতিক্রম করা এবং আইনের প্রয়োগ করা। সবচেয়ে বড় কথা আইন যাই হোক, মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। হয়রানি, নির্যাতন এবং মেয়েদের উত্ত্যক্তকারীদের সঠিক বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’ বলতে যা বুঝিয়েছে তার দরকার হবে না।

‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’টি চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সরকার শর্তহীনভাবে মেয়েদের ন্যূনতম বিয়ের বয়স ১৮ নির্ধারণ করবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ