X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাম্পের মন্ত্রিসভা: ধনবাদী, উগ্রবাদীদের মিলনমেলা

আনিস আলমগীর
০৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৪:২৭আপডেট : ০৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৪:৩৬

আনিস আলমগীর ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বরের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। আমেরিকার মিডিয়া এবং বিশ্বের সব মিডিয়া জনমতকে বিভ্রান্ত করেছিল হিলারির জয়ের সম্ভাবনার কথা বিভিন্ন রঙে বিভিন্ন ঢঙে প্রচার করে।
আসলে জেতার জন্য মনে হয় এটাও একটা কৌশল। মিডিয়ার বিভ্রান্তিতে কিন্তু বিশ্বজনমত বিভ্রান্ত হলেও আমেরিকার ভোটাররা বিভ্রান্ত হননি। তারা ভোট দিয়েছেন ট্রাম্পকে।
ট্রাম্প পরিবর্তনের কথা বলেছেন। ট্রাম্পের পরিবর্তনটা যে কী পরিবর্তন তা কিন্তু তলিয়ে দেখেননি কেউ, কারণ আমেরিকার সাধারণ মানুষ ক্লান্ত ও হতাশ। ট্রাম্প সে ক্লান্তি ও হতাশাকে ক্রোধে রূপান্তরিত করেছেন খুবই সফলভাবে। ক্রোধটা জাগিয়ে তুলেছিলেন সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে অথচ তারা কোনভাবেই অপরাধী নন। সংখ্যালঘু সমাজটা সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্রের বাইরের কেউ নয়। বর্ণের তফাৎ থাকলেও তারা একই সমাজভুক্ত। তারা উভয় গ্রুপ দরিদ্র।
বিষয়টা উপলব্ধি করতে সংখ্যাগরিষ্ঠদের হয়তোবা বিলম্ব হচ্ছে। ছয় নয় মাস পরে সংখ্যাগরিষ্ঠরা বুঝতে পারবেন যে তারা প্রতারিত হয়েছেন। আসলে আমেরিকান সমাজটা রোগাক্রান্ত হয়েছে তৃণমূল পর্যায়ে। এখন তারা কাজ করে আগের তুলনায় বেশি অথচ মজুরি পায় কম। তারা চেয়ে চেয়ে ক্লান্ত হচ্ছে তাদের বেশি বেতনের চাকরিগুলো চীন, মেক্সিকো চলে যাচ্ছে। সেখানে বেতন কম হলেও নাকি চলে। তারা এও দেখছে যে কোম্পানির ওপরের কর্তারা তাদের চেয়ে তিনশ গুণ বেশি বেতন পায়। আর এও তারা উপলব্ধি করছে যে জাতীয় আয়ের ৫২% চলে যাচ্ছে ১% ধনিদের পকেটে।

আমেরিকায় পল্লীকেন্দ্রীক অনেক ছোট ছোট শহর ছিল। এখন শহরগুলো বিরান হয়ে যাচ্ছে, বসতি চলে যাচ্ছে বড় শহরগুলোতে। দোকানপাটে এখন ঝাপ পড়েছে। ছোট ছোট ব্যবসাগুলো বন্ধ। বসতি ছেড়ে দিয়ে এই যে বাস্তুত্যাগী হওয়ার প্রবণতা- একি ভালো লক্ষণ? দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাস্তুত্যাগী হয়ে যাযাবর জীবনের দিকে পা বাড়ানো দেউলিয়াত্বের লক্ষণ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে আমেরিকার সমাজ খুবই জটিল পরিস্থিতির মাঝে পড়েছে। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার যে প্রত্যাশা আমেরিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ করছে সে পরিত্রাণ  ট্রাম্প কখনও দিতে পারবে না।

নির্বাচন হয়েছে আজ প্রায় এক মাস হয়ে গেলো। আগামী ২০ জানুয়ারি ট্রাম্প শপৎ গ্রহণ করবেন। দীর্ঘ ৭৩ দিন ট্রাম্প করছেন কী- অনেকের মনেই হয়ত প্রশ্ন। ট্রাম্পের এই ৭৩ দিন নির্বাচন-উত্তর কাজ খুব সহজ কাজ নয়। আমেরিকায় নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এ সময়ে তার কর্মকর্তা কর্মচারী নির্বাচন করে থাকেন। হোয়াইট হাউসের রাধুনি থেকে মন্ত্রিসভার সদস্যসহ সব পর্যায়ের কর্মচারী নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হয় প্রেসিডেন্টকে। এ কর্মচারীর সংখ্যা কয়েক হাজারের ওপরে।

ডোনাল্ট ট্রাম্প এ পর্যন্ত তার মন্ত্রিসভার জন্য যেসব লোক পছন্দ করেছেন তারা সবাই ধনকুবের, যদিওবা তিনি নির্বাচনি সভায় বলেছিলেন ওয়াল স্ট্রিটের লোক, দুষ্ট ব্যাংকার আর ওয়াশিংটনের রাজনীতিবিদদের যোগসাজসে আমেরিকার মজদুর শ্রেণি পথে বসেছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে এ কোটারি তিনি ভেঙে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যেখানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকসকে তিনি কর্মজীবী মানুষের এক নম্বর শত্রু বলে উল্লেখ করেছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে সেই গোল্ডম্যান স্যাকস থেকেই তিনি তার মন্ত্রিসভার জন্য তিনজন মন্ত্রী পছন্দ করেছেন। তিনজনই বিলিওনিয়ার।

খবরে দেখা যাচ্ছে, এখন পর্যন্ত ধনকুবেরদের মাঝে মন্ত্রিসভায় শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে যাকে নির্বাচিত করা হয়েছে তিনি হচ্ছেন শিক্ষাবিদ ও ব্যবসায়ী বেটসি ডেবস। তিনি ৫১০ কোটি ডলারের মালিক। বাণিজ্য দফতর পাচ্ছেন উইলবার রস তিনি ২৯০ কোটি ডলারের মালিক। ১০০ কোটি ডলারের মালিক টড রিকেটস সহকারী বাণিজ্য মন্ত্রী হচ্ছেন আর ৪ কোটি ডলারের মালিক স্টিভ মিনশিন হচ্ছেন রাজস্ব দফতরের মন্ত্রী। চার কোটি ডলারের মালিক ইলেইন চাও হচ্ছেন শিক্ষা দফতরের মন্ত্রী, ২ কোটি ডলারের মালিক টম প্রাইম হচ্ছেন স্বাস্থ্য দফতরের মন্ত্রী।

যে মিট রমনিকে পররাষ্ট্র দফতরের জন্য পছন্দ করা হচ্ছে তার সম্পদে পরিমাণ ২৫ কোটি ডলার। দেশরক্ষা মন্ত্রী হিসাবে নির্বাচিত করেছেন জেনারেল জেমস ম্যাস্টিসকে, যুদ্ধ প্রীতির জন্য তিনি যুদ্ধবাজ সন্ন্যাসী হিসাবে পরিচিত। অনেকে তাকে ম্যাড ডগ বা পাগলা কুকুর বলেও অভিহিত করেন। এই জেনারেল ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে ও ২০০১ সালে আফগান যুদ্ধে ম্যাড ডগ সেনা অভিযানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ জড়িত ছিলেন। নিষ্ঠুরতা ও মানুষ হত্যার বিষয়ে তার খ্যাতি রয়েছে।

সামরিক বাহিনীর লোককে দেশরক্ষা মন্ত্রী করার বিষয়ে সাংবিধানিক বিধি নিষেধ রয়েছে। সেটাকে উপেক্ষা করে ট্রাম্প জেনারেল ডগকে নিয়োগ দিলেন। বস ও মিনশিন উভয়ে গোল্ডম্যান স্যাকসের লোক। তারা পাচ্ছেন অর্থদফতরের দায়িত্ব। তারা ২০০৮ সালে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠান বেচা-কেনা করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন।

মন্ত্রী সিলেকশনের পর গোল্ডম্যান স্যাকসসহ বড় আর্থিক সংস্থার শেয়ারের মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে উঠছে। অর্থদফতর দেখাশুনার দায়িত্ব যাদেরকে দেওয়া হচ্ছে তাদের কোনও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা নেই। যারা ২০০৮ সালের মন্দার জন্য দায়ী তাদেকেই মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হয়েছে। তারা ঘোষণা দিয়েছেন ওবামার সিদ্ধান্ত তারা এক এক করে তুলে নেবেন। ট্রাম্পের মন্ত্রিসভার সদস্যদের সিলেকশন দেখে ডেমোক্র্যাট দলের নেতারা সংকিত হয়েছেন। ডেমোক্র্যাট দলের দুই বাম সিনেটর বার্নি স্যান্ডারস ও এলিজাবেথ ওয়ারেন এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন নির্বাচনি প্রচারের সময় ট্রাম্প আশ্বাস দিয়েছিলেন ওয়াল স্ট্রিট এবং ওয়াশিংটনের আতাত তিনি ভেঙে দেবেন কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি যে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাতে ওয়াল স্ট্রিট- এর নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার হবে।

স্টিভ মনুশিন যাকে রাজস্ব ও অর্থ-দফতরের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে তিনি ওয়াল স্ট্রিট-এর খাস লোক। ট্রাম্পের এ মনোনয়নকে জাতির সঙ্গে বড় ধরনের ঠাট্টা বলে তারা অবহিত করেছেন। স্টিভ মনুশিন ঘোষণা দিয়েছেন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে তিনি বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ধারিত কর কমাবেন। মধ্যবিত্তের জন্যও কর কমাবার কথা বলেছেন।

মন্ত্রীর জন্য যারা মনোনয়ন পেলেন তাদের প্রত্যেককে দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে সিনেটর শুনানীর সম্মুখীন হতে হবে আর ডেমোক্র্যাটরা বলেছেন এসব লোক ২০০৮ সালের মন্দার জন্য দায়ী। বিনা যুদ্ধে তারা তাদের মনোনয়ন নিশ্চিত হতে দেবেন না।

আমরা মনে করেছিলাম ওয়াল স্ট্রিট-এর কায়েমি স্বার্থের ক্ষতি না করেও আমেরিকার মানুষের কষ্ঠ লাগবের একটা পন্থা ডোনাল্ট ট্রাম্প উৎভাবন করবেন। কিন্তু তার মন্ত্রিসভার চেহারা দেখে মনে হয় না যে তারা আমেরিকার সাধারণ লোকের কোনও উপকারে আসবেন। ট্রাম্প ও তার মন্ত্রিসভা ধনীদের ষোল আনা পাইয়ে দেবার পণ নিয়ে যদি প্রতিজ্ঞ হন তবে যে অনৈক্য ও বিভেদ আমেরিকার সমাজকে বিভক্ত করেছে তা কখনও জোড়া লাগবে না। ধীরে ধীরে আমেরিকা সোভিয়েত রাশিয়ার ভাগ্য বরণ করবে। মনে হয় ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভের মতো ঐক্যবদ্ধ আমেরিকার শেষ প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসেডর যুবরাজ
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসেডর যুবরাজ
অবশেষে মুক্তির বার্তা
অবশেষে মুক্তির বার্তা
এমপিপুত্র প্রার্থী হওয়ায় ‘আগুন জ্বলছে’ সেলিম প্রধানের গায়ে
এমপিপুত্র প্রার্থী হওয়ায় ‘আগুন জ্বলছে’ সেলিম প্রধানের গায়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ