X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বইমেলায় পথশিশুরা

জেসমিন চৌধুরী
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০৭:৩৮আপডেট : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০৭:৩৮

জেসমিন চৌধুরী কিছুদিন আগে ফেসবুকে পথশিশুদের নিয়ে একটা স্ট্যাটাসে লিখেছিলাম, ‘এদের জ্বালায় মেলায় কিছু খেতে পারি না।  বলেছি ভিক্ষা দেব না, তবু পিছু ছাড়ে না’।  এখানে আমার ‘ভিক্ষা’ শব্দের ব্যবহারে আহত হয়ে কেউ কেউ বলেছেন, এই সুন্দর শিশুদের সম্পর্কে ‘ভিক্ষা’ শব্দটি ব্যবহার না করলে কি হতো না?

ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘কল আ স্পেড আ স্পেড’, অর্থাৎ কোদালকে কোদাল বলে ডাকাই ভালো।  এই কাজটাই আমরা পারি না।  যেসব সমস্যা আমাদেরকে বিচলিত করে, বিব্রত করে তা সমাধানের পথে না গিয়ে আমরা সমস্যাটাকে একটা ফুলেল নাম দিয়ে রোমান্স করতে চাই, ভুলে যেতে চাই যে সমস্যাটা আছে, তারপর নিজের সুন্দর সুশৃঙ্খল জীবন নিয়ে নিমগ্ন হয়ে পড়তে চাই।  আমরা সুশীল, শিশুরা ভিক্ষুক হবে তা আমরা মেনে নেব, কিন্তু তাদের সম্পর্কে কথা বলার সময় ‘ভিক্ষুক’ শব্দটি ব্যবহার করবো না।  আমাদের মতো সুশীলরা যে সমাজে বাস করে সেখানে এসব অসুন্দর সমস্যা আছে, তা আমরা স্বীকার করবো কেন? এতটা বোকা তো আমরা নই।

যারা ‘ভিক্ষা’ শব্দের ব্যবহারে আপত্তি প্রকাশ করেছেন, তারা ‘আমি এদের জ্বালায় মেলায় কিছু খেতে পারি না’ কথাটা বোধ হয়ে খেয়াল করেননি।  প্রথম যেদিন মেলায় গিয়ে বন্ধুদের নিয়ে একটা টেবিলে এক কাপ কফি নিয়ে বসেছিলাম, তখন একটা সাত/আট বছরের মেয়ে এসে ভিক্ষা চাইল।  আমি যদি এই সুন্দর শিশুটির জন্য ‘ভিক্ষা’ একটা উপযুক্ত শব্দ বা কাজ বলে ভাবতাম তাহলে পাঁচটা টাকা দিয়ে তাকে বিদায় দিতাম।  সেটাই হতো সবচেয়ে সহজ সমাধান। কিন্তু তা করতে পারলাম কই? বরং মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম।  পাশের টেবিলেই ফুলে ফুলে সজ্জিত একই বয়সের একটা মেয়ে  মা-বাবার সাথে বসে বার্গার খাচ্ছিল।  খেয়াল করলাম পথশিশুটা বারবার বার্গার যে সৌভাগ্যবান মেয়েটা খাচ্ছে তার প্লেটের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।  আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না, তাকে একটা বার্গার কিনে দিলাম।  বন্ধুদের একজন বললেন, ‘এটা করো না, এক্ষুনি আরো একশ’টা বাচ্চা এসে হাজির হবে’।

আমি মেয়েটাকে বললাম, ‘কাউকে বলো না কিন্তু’।  সে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে চলে গেল, কিন্তু কথা রাখলো না।  দুই মিনিটের মধ্যেই তারই মতো একঝাঁক শিশু এসে হাজির। এরা যখন চারপাশে ঘুরঘুর করে, আমি বড় অসহায় বোধ করি। ভিক্ষা দিতে তো পারিই না, এতোগুলো বাচ্চাকে প্রতিদিন খাবারও কিনে দিতে পারি না, আবার তাদের দেখিয়ে দেখিয়ে খেতেও পারি না। বন্ধুদের নিয়ে পর্যটনের খাবারের দোকানে আড্ডা দিতে বসলে বড়জোর এক কাপ কফি নেই, আর কিছুই খেতে পারি না আমি।  শুধু একদিন এক বন্ধুর সঙ্গে বসে এক প্লেট ফুচকা খেয়েছিলাম, পথশিশুদের চোখের আড়ালে খানিকটা দূরে অন্ধকারে বসে।

তারা আমকে চিনে গেছে।  দেখলেই পিছু নেয়, কিন্তু কিছু না দিলেও পিছু ছাড়ে না।  আমি তাদের সঙ্গে গল্প করি, তারাও আমাকে গল্প বলে, গান শোনায়।  যারা কখনও এইসব শিশুদের সঙ্গে সমান কাতারে নেমে গিয়ে কথা বলেননি তারা কোনোদিনও জানতে পারবেন না এই শিশুগুলো একই সঙ্গে কতটা সাধারণ এবং অসাধারণ।  তারা আপনার আমার বাচ্চাদের মতই অনুসন্ধিৎসু মনের অধিকারী, মায়ার কাঙ্গাল।  আবার তাদের মধ্যেই অনেকে বেশ বুদ্ধিমান, ভাবুক, কল্পনাপ্রবণ, এমনকি বেশ দার্শনিক চিন্তাভাবনারও অধিকারী।

একদিন আমার বন্ধু মাহমুদাও এসে জুটল আমাদের এই আড্ডায়।  সন্ধ্যার পর পর্যটনের খাবারের দোকানের পাশাপাশি যেতেই দেখি বাচ্চাগুলো কাচুমাচু মুখে ভিক্ষার আশায় ‘মেলাগত’দের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে।  আমাকে দেখেই ছুটে এলো সবগুলো, একটু আগের কাচুমাচু চেহারাগুলো মুহূর্তের মধ্যে হয়ে উঠল দীপ্তিময়, করুণ দৃষ্টিগুলো দুষ্টুমিতে আত্মবিশ্বাসে জ্বলজ্বল।  আমরা তাদের জন্য বাঁশিওয়ালা ললিপপ নিয়ে গিয়েছিলাম।  সেগুলো চুষতে চুষতে মুখে গল্পের খই ফোটালো তারা, বাঁশি বাজিয়ে মাহমুদার কান ফাটিয়ে দিল অনেকবার না করা সত্ত্বেও।  মাহমুদাকে বলে রেখেছিলাম ভিডিও করতে, তাদের মজার মজার কথাগুলো ধরে রাখার জন্য।  হঠাৎ একটা ছেলে ক্ষেপে গেল, ললিপপ মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে বলল, ‘একটা ললিপপ খাওয়াইয়া আমাগোর ভিডিও তুলেন? লাগবো না আপনের ললিপপ’।

আমি তার আচরণে এতোটাই হতভম্ব হয়ে গেলাম যে কয়েক মুহূর্ত কী করব, কী বলব ভেবে পেলাম না।  তারপর ছুটে গিয়ে তার হাতটা ধরে বললাম, ‘তোমার রাগ দেখে আমি খুশি হয়েছি, তোমার আত্মসম্মানবোধ আছে।  তাহলে ভিক্ষা কর কেন?’ বলল, ‘ভিক্ষা না করলে খামু কী? টেকা না নিয়া গেলা মায় মারব’।  তাকে হাত ধরে এনে বসালাম, ক্ষমা চাইলাম, মাহমুদা ততক্ষণে ভিডিও করা বন্ধ করে দিয়েছে।  বললাম, ‘তোমাদেরকে নিয়ে কিছু লিখব আমি, তাই ভিডিও করছিলাম।  কিন্তু তোমরা না চাইলে করব না’।  সাথে সাথে সরব হয়ে উঠল পথশিশুর দল, ‘করেন আপা, করেন।  কুনো সমস্যা নাই’।  আমি বললাম, ‘কী ভিডিও করব বলো তো?’

একজন বলল, ‘আপা আমি একটা দুঃখের গান গাই?’ তারপর গেয়ে উঠল, ‘আমার মালিকানা গাড়িখানা, রাস্তা আছে সরকারি, সাবধানে করিও ড্রাইভারি’।  অন্যেরা গলা মেলালো তার সঙ্গে, দু’একজন মাথার ওপর হাত তুলে নাচতেও শুরু করল।  কোনও দ্বিধা নেই, নেই কোনও জড়তা। এইসব শিশুদের ভিক্ষা করে খেতে হয়? ভিক্ষার টাকা নিয়ে ঘরে ফিরতে না পারলে মায়ের হাতে পিটুনি খেতে হয়? আমি চারদিকের আয়োজনের দিকে তাকালাম, শিক্ষা-দীক্ষা জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারের প্রচেষ্টায় আয়োজিত বইমেলার চাকচিক্যের দিকে তাকিয়ে আমার চোখ ভিজে উঠল, গলা ধরে এল।  নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ‘এটা দুঃখের গান কিভাবে হলো?’ আমাকে গানের অর্থ বুঝিয়ে বলতে গিয়ে সবাই মিলে চেঁচামেচি করে গোল পাকিয়ে ফেলল তারা।  ‘এই ধরেন আমার শরীলটা একটা ছয়চাক্কার গাড়ি’।  আমি জানতে চাইলাম, ‘ছয়চাকা কিভাবে?’ ‘এই ধরেন দুইটা হাত, দুইটা পাও, আর ...’ বাকি দু’টো চাকার হিসেব দিতে হিমশিম অবস্থা তাদের। আমি বলি, ‘ড্রাইভারটা কে, বলো তো?’ ‘বুঝলেন না আফা? আমিই গাড়ি, আমিই ড্রাইভার।  কিন্তু সাবধানে না চালাইলে সমুস্যা’।

তারপর খরগোশ ও কচ্ছপের গল্প হলো, টুনাটুনির পিঠা বানানোর গল্প হলো, রাজার তিন কন্যার গল্পও শুনলাম।  সবশেষে আমি বললাম, ‘এইযে তোমরা এভাবে আমার সাথে প্রতিদিন গল্প কর, এভাবে অনেক বড়বড় স্কুলে পড়া বাচ্চারাও পারবে না।  তোমাদের অনেক বুদ্ধি। তোমাদের জীবনটা কি কোনোভাবে বদলানো সম্ভব?’ সাথে সাথে সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল সবাই, ‘না আফা সম্বব না’।  কেউ কেউ আবার জোরে জোরে দু’দিকে মাথা নাড়তে লাগল।  তারপর শুনলাম তাদের জীবনের হাজারো কষ্টের কথা।  অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম কেউ নিজের কথা বলছে না।  সবাই অন্যের কথা বলছে, পাশের ছেলেটার কথা বলছে।  ‘আফা জানেন, ওর মায় ওরে বাইর কইরা দিসে।  কামকাজ পায় না হের লাইগা।  অহন ফুটপাতে থাকে’।  আরেকজনের মা-বাবা ঘরের ভেতর ঘুমায়, তাকে বাইরে রাখে।  আরেকজনের মা মরেছে সড়ক দুর্ঘটনায়, বাবা রোগে ভুগে।  পথ ছাড়া এখন তার আর কেউ নেই।

বাচ্চাগুলোর মধ্যে অসাধারণ মমতার ক্ষমতা লক্ষ্য করলাম।  একজনের কোলে একটা নাদুস-নুদুস কুকুরের বাচ্চা, তাকে আদর করে বোতল থেকে একটু একটু করে কোক খাওয়াচ্ছে সবাই মিলে, বাচ্চাটাও চুকচুক করে খাচ্ছে।  পাশ দিয়ে মায়ের হাত ধরে হেঁটে যেতে যেতে ছোটো একটা বাচ্চা পেছন ফিরে তাকাচ্ছিল বারবার।  একটা পথশিশু বলে উঠল, ‘আফা আর ললিপপ নাই? হে মনে অয় একটা ললিপপ চায়’।  আমি ব্যাগ হাতড়ে একটা ললিপপ বের করে দিলাম, সে ললিপপটা নিয়ে ছুটল শিশুটির দিকে।  শিশুটিও হাত বাড়িয়ে আগ্রহ করে ললিপপটা নিয়ে নিল, তার মধ্যবিত্ত অহমিকা বোধ সম্পন্ন মায়ের কোনও আপত্তিই এই অসম সামাজিক অবস্থানের শিশুদের স্নেহ শেয়ারিং এর পথে বাধা হতে পারলো না।

আমি আর মাহমুদা পথশিশুদের এই মানবতা বোধে হতভম্ব হয়ে গেলাম, এদের কাছ থেকে খুব ভালো কিছু আশা করার মানসিকতা নিয়ে আমরাও বড় হইনি।  একটু পরে মাহমুদা জিজ্ঞেস করল, ‘এই তোরা ড্রাগস খাস?’ সাথে সাথে ‘আমি খাই না আফা, হেয় খায়’ বলে অদৃশ্য কোনও শিশুর প্রতি আঙুল তুলে চেঁচিয়ে উঠল সবাই।  এইসব কিছুর মধ্যে যে জিনিসটা ভালো লাগল তা হচ্ছে তারা সবাই স্কুলে পড়ে, কিভাবে কোথায় কখন তা আর জানা হলো না, কিন্তু তাদের মুখের অজস্র ছড়া শুনে বুঝলাম কথাটা সত্যি।  

পরদিন আবার গেলাম তাদের জন্য কিছু খাতা, পেন্সিল, আর রাবার নিয়ে।  খাতা নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল- ‘আমি এইটা চাই, আমি ঐটা চাই’।  বুঝলাম খাতার উপরের ছবি পছন্দেরও একটা ব্যাপার আছে।  বিলেত থেকে আনা একবক্স ফেরেরো রোশে চকলেট নিয়ে গিয়েছিলাম তাদের জন্য।  একটা ছেলে হাতের তালুতে সোনালি রাংতা জড়ানো চকলেটটা নেড়ে চেড়ে বলল, ‘আফা, এইটার দাম কত?’ আমি বললাম, ‘অনে...ক’। ‘আফা, এইটা না দিয়া ভাত কিন্না দিলে ভালা হইত’।

ছেলেটার সাধারণ এই মন্তব্যে আমার বিলাসিতারত বিবেকের মুখে একটা চাবুক পড়ল যেন। আমি যতই তাদের সাথে গল্প করি না কেন, ললিপপ আর খাতা কিনে দেই না কেন, তাতে করে বাস্তবতা বদলে যায় না।  তারা তারাই থেকে যায়, আমি আমিই থেকে যাই।  তাদের ভাতের অভাবের জীবন আর আমার ফেরেরো রোশে খাওয়া জীবন পাশাপাশি এসে দাঁড়িয়ে আমার সমস্ত অস্তিত্বকে তিতা করে দেয়।  এই শিশুগুলোর প্রতি আমার ভালোবাসাও যে অবিমিশ্র নয়, তার মধ্যেও যে অনেকটা করুণা মিশে আছে, তা ভেবে নিজের কাছেই অপরাধী হয়ে ওঠি।  মাথা নিচু করে বের হয়ে আসি বইমেলা থেকে, এগিয়ে যাই অপেক্ষারত গাড়ির দিকে।  পথশিশুরা একই গেট দিয়ে বের হয়ে পথের দিকেই চলে যায়।

লেখক: অভিবাসী লেখক ও অনুবাদক।

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাংলাদেশ ব্যাংকে সংবাদকর্মীদের প্রবেশে বাধা: উদ্বিগ্ন টিআইবি
বাংলাদেশ ব্যাংকে সংবাদকর্মীদের প্রবেশে বাধা: উদ্বিগ্ন টিআইবি
আপাতত গরমেই খেলতে হচ্ছে সাবিনা-সানজিদাদের
আপাতত গরমেই খেলতে হচ্ছে সাবিনা-সানজিদাদের
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসেডর যুবরাজ
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসেডর যুবরাজ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ