শেষ পর্যন্ত হরকাতুল জিহাদ নেতা, ভয়ঙ্কর জঙ্গি মুফতি হান্নান রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছে। গাজীপুরে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় হাই সিকিউরিটি কারাগারে বন্দি ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত এই জঙ্গি নেতা কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সোমবার প্রাণভিক্ষার আবেদন করে। তার সহযোগী রিপনও লিখিতভাবে প্রাণভিক্ষা চেয়েছে। ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায় তারা ফাঁসির দণ্ড পেয়েছে।
যে বিচারিক প্রথাকে তারা তাদের ভাষায় ‘তাগুতি আইন’ বলে এতদিন প্রত্যাখ্যান করে আসছিলেন সেই আইনের কাছেই শেষ পর্যন্ত আত্ম-সমর্পন করেছেন। কোথায় তাদের সেই ঈমানী শক্তি যার কথা এই ধর্মীয় নেতারা প্রায়শ বলে থাকেন? আসলে এদের কোনও ধর্ম নেই, কোনও ঈমান নেই, পুরোটাই হলো রাজনীতি, যে রাজনীতি উদারতা বিরোধী, অসাম্প্রদায়িকতার পরিপন্থী। এই রাজনীতি যারা করেন, বা যারা এই রাজনীতির ওপর ভর করেই ক্ষমতায় যাওযার স্বপ্ন দেখেন তারাই মানুষের মৃত্যুর মাঝেও জঙ্গি বিরোধী অভিযানে নাটক বা বায়োস্কোপ দেখেন। বায়োস্কোপের নেশাতো এদের আজকের নয়, সেই পাকিস্তান আমল থেকেই। এরা রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ বিরোধী আন্দোলনে বায়োস্কোপ দেখেছেন, মুক্তিযুদ্ধকে ইসলাম বিরোধী হিসেবে বিবেচনা করে বায়োস্কোপ দেখেছেন, এরা যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানিয়ে জাতিকে বায়োস্কোপ দেখিয়েছেন, এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারকেও বায়োস্কোপের লেন্স দিয়েই দেখেছেন।
হলি আর্টিজানের হামলা ছিল এ জাতির সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় নাটক। একদিকে মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধ তথা বাংলাদেশ বিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীর আক্রমণে দেশের মানুষ যখন এ দেশ নিয়ে চিন্তিত, যখন জীবন বাজি রেখে সৈনিকরা, পুলিশ ও র্যাবের সদস্যরা ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করছে, তখন এক গ্রুপ লেন্সে দৃষ্টি দিয়ে স্বপ্ন দেখছিল এই বুঝি তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ পরিষ্কার হয়ে এলো। এসব সন্ত্রাসী যারা বিশ্বব্যাপী সৃষ্টি করেছে সেই আন্তর্জাতিক রাজনীতির মোড়লরাও নানা কথা বলে এদেশীয় প্রতিক্রিয়াশীল চক্রকে উষ্ণতা দিচ্ছিল। তবে যে বাংলাদেশ পৃথিবীর বিপজ্জনক শক্তি, পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করেছে, সে-তো পরাজিত হওয়ার নয়। তাই সে আবারও বিজয়ীর বেশে ঘুরে দাঁড়ায়, প্রগতির চাকা আবার সচল হয়।
কিন্তু স্বস্তির পরশ পাওয়া এতো সহজ নয়। কারণ এই জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠীর পরমাত্মীয়তা আছে। হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ার হামলার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক একের পর এক জঙ্গি খতম অভিযান সফলের পর জনমনে স্বস্তি এসেছিল। কিন্তু ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস ঘোষণার সাথেই সাথেই স্বাধীনতার মাসে আবার জঙ্গিদের সক্রিয় হতে দেখলো বাংলাদেশ। চট্টগ্রাম, ঢাকা সিলোটের মতো বড় শহরে জঙ্গিদের তৎপরতা শুরু হলো, পুলিশসহ সাধারণ মানুস আবারও জীবন দিল।
এবারের জঙ্গি তৎপরতার বিশেষ দিক হচ্ছে আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীর অস্তিত্ব। ঢাকা এবং সিলেটে সুইসাইডাল বেল্ট পরা ও সঙ্গে বোমা রাখা জঙ্গিরা তাদের উপস্থিতির কথা জানান দিয়েছে।
কিন্তু এতসব কিছুর পরও কেউ কেউ শুধু নাটকই দেখেন দেশজুড়ে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান কোথায় গিয়ে নামলে এমন ভয়ঙ্কর জঙ্গিদের পক্ষ নিয়ে কোনও দল বলতে পারে যে, এসব হলো সরকারের সাজানো নাটক। সাংস্কৃতিক মানসম্পন্ন সভ্য-ভব্য মানবিক রাজনীতি কোথায় হারিয়ে গেলো?
জঙ্গিদের সঙ্গে যাদের আদর্শের মিল রয়েছে এবং জঙ্গিদের প্রতি যাদের রাজনৈতিক সমর্থন রয়েছে তাদের অভিযোগ, ‘প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে সামরিক চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাই একে যুক্তিগ্রাহ্য করার জন্য জঙ্গি সংকট দেখানোর আয়োজন করেছে সরকার’। দেখা যাক এই অভিযোগের যৌক্তিকতা কোথায়। একটা সমঝোতা স্মারকের জন্য জঙ্গি ইস্যু তৈরির প্রয়োজন আছে কি? বাংলাদেশ তো যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে এ ধরনের সমঝোতা করেছে। তখনতো এসব নিয়ে এসব নিয়ে কথা ওঠেনি। ক’দিন আগেই বাংলাদেশের নৌবাহিনীতে দুটি সাবমেরিন যুক্ত হয়েছে এবং দুটিই এসেছে চীন থেকে। বিএনপি নেতারা এ নিয়ে কোনও কথা বলছেন না। কারণ, সেই রাজনীতি, ভারত বিরোধী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি যা জঙ্গিবাদকেই প্রকারান্তরে উসকে দেয়। জঙ্গিবাদ উসকে দিয়ে সরকারের লাভ নেই, বরং ক্ষতি আছে। উল্টো দিক দিয়ে সরকারকে অস্থির করে তুলতে জঙ্গি তৎপরতার রাজনৈতিক ফায়দা কারা পাবে, তার অংক নিশ্চয়ই কোন কঠিন কাজ নয়।
হলি আর্টিজানে মর্মান্তিক হামলার সময় যে সংকট সৃষ্টি হলো, তখন দায়িত্বশীল দল হিসেবে বিএনপি জঙ্গিবিরোধী বক্তব্য না দিয়ে সরকারবিরোধী বক্তব্য বেশি দিয়েছে যা এখনও অব্যাহত আছে। কেন জঙ্গিদের মারা হচ্ছে, কেন অভিযানের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মারা যায়নি এমন প্রশ্ন তুলেছে দলটি। দলীয় রাজনীতি ভালো জিনিস, দলীয় স্বার্থরক্ষাও ভালো, কিন্তু কূপমণ্ডুকতা ও প্রতিক্রিয়াশীর রাজনীতি উত্তরণের দিশা নয়। ভ্রষ্ট রাজনীতির চর্চা থেকে বেরিয়ে এসে দেশ ও মানুষের জন্য রাজনীতিতে ফিরে না এলে, ক্ষমতায় বসেও স্বস্তিতে থাকবে না কোনও দল। পাকিস্তানে যারা তালেবানি রাজনীতিকে সমর্থন করেছে, জঙ্গিদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়েছে, তারাই পরবর্তীতে তাদের জঙ্গি হামলার শিকার হয়েছে।
সিলেট শহরের জনবসতিপূর্ণ এলাকার আতিয়া মহলে জঙ্গিগোষ্ঠীর শক্ত অবস্থান এটাই প্রমাণ করে যে তাদের ভিত অনেক গভীরে। পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে এই অভিযানে সেনাবাহিনীকে সম্পৃক্ত করতে হয়েছে এবং তাদের পাঁচদিন লেগেছে এদের খতম করতে। জঙ্গিদের শক্তি সম্পর্কে যে ধারণা নিয়ে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে, সে তুলনায় তাদের শক্তি অনেক বেশি। কাছাকাছি সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি ঘাঁটিতে অভিযানের সময়ে জঙ্গিদের পাল্টা প্রতিরোধের চেষ্টা ও আত্মঘাতী বোমা হামলার পথ বেছে নেওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে যে তারা নিজেদের শক্তি–সামর্থ্য ও অবস্থানের জানান দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
যারা বায়োস্কোপ দেখে বা যারা নাটক বলে তারা তা দেখবে এবং বলবেই। কিন্তু সরকারের কাজ সরকারকে করতে হবে। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অব্যাহত অভিযানের কোনও বিকল্প নেই। এদের শক্তি–সামর্থ্যকে কোনও অবস্থাতেই হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। আবার একথাও মনে রাখতে হবে যে, শুধু শুধু অভিযান চালিয়ে দেশের মধ্যে গেড়ে বসা জঙ্গিবাদকে নির্মূল করা যাবে না। মানুষকে, বিশেষ করে তরুণদের জঙ্গি ভাবাদর্শ থেকে ফিরিয়ে আনার যে কথা প্রধানমন্ত্রী স্বাধিনতা দিবসে বলেছেন সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ডির্যাডিকালাইজেশনের বড় উদ্যোগ এখনই শুরু করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সামাজিক শক্তির জাগরণই পারে জঙ্গি নির্মূল করতে এবং এদের সহযোগীদের বায়োস্কোপের নেশা ছাড়াতে।
লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি