X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একেই বলে ‘যার বিয়ে তার খবর নাই...’

গোলাম মোর্তোজা
২৬ এপ্রিল ২০১৭, ১৫:৩৪আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০১৭, ১৫:৩৭

গোলাম মোর্তোজা হাওর নিয়ে সারা দেশের মানুষ উদ্বিগ্ন, ২৪ লাখ হাওরবাসী পরিবার সব হারিয়ে নিঃস্ব। ৩ লাখ ৩০ হাজার পরিবারের জন্যে সাহায্যের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাকি ২১ লাখ ৭০ হাজার পরিবারের কী হবে, সরকারের ভাবনায় তা নেই। দেশের এমন সঙ্কটময় অবস্থায়, আরও একটি ঘটনা ঘটছে। ঘটনাটি ঘটছে বাংলাদেশের খনিজ সম্পদ নিয়ে। এর মধ্যে মার্কিন তেল কোম্পানি ‘শেভরন’ বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ব্লক চীনের ‘হিমালয় এনার্জি’র কাছে বিক্রি প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে। এত বড় এত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, আলোচনায় গুরুত্ব পাচ্ছে না। বাংলাদেশের খনিজ সম্পদ নিয়ে এমন লুণ্ঠনের চিত্র নতুন নয়। আগে অনেকবার হয়েছে। এখন আর একবার হচ্ছে।
সংক্ষেপে সামান্য কিছু তথ্য জানানোর চেষ্টা করছি।
১. দেশের মালিক জনগণ, প্রাকৃতিক সম্পদেরও- সংবিধানে তাই লেখা আছে। জনগণের সম্পদ প্রতিনিধি হিসেবে দেখা, রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে সরকার। জনগণের প্রতিনিধি সরকার, কতটা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করে, দেখা যাক সেই চিত্র।
ক. ১৯৯৫ সাল, বিএনপি সরকার ক্ষমতায়। দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ১২, ১৩ এবং ১৪ নম্বর গ্যাস ব্লক ইজারা দেওয়া হয় আমেরিকান তেল কোম্পানি অক্সিডেন্টালকে।
খ. ১৯৯৭ সালে ১৪ নম্বর ব্লকে কূপ খননের সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটায় অক্সিডেন্টাল। যা ‘মাগুরছড়া দুর্ঘটনা’ হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত। আশপাশের পরিবেশ ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিপুল পরিমাণ গ্যাস সম্পদের ক্ষতি হয়। ক্ষতির সেই হিসেবে পরে আসছি।
গ. ১৯৯৯ সালে অক্সিডেন্টাল আরেকটি আমেরিকান তেল কোম্পানি ইউনোকলের কাছে তাদের ইজারা নেওয়া গ্যাস ক্ষেত্র তিনটি বিক্রি করে দিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়।

ঘ. ২০০২ সালে অক্সিডেন্টালের থেকে কেনা গ্যাস ক্ষেত্র ইউনোকল বিক্রি করে দেয় আরেক মার্কিন কোম্পানি শেভরনের কাছে।

ঙ. শেভরন এখন সেই গ্যাস ক্ষেত্র বিক্রি করে দিচ্ছে চীনের কোম্পানি ‘হিমালয় এনার্জি’র কাছে।

২. বিষয়টি লক্ষ্য করুন। গ্যাস ক্ষেত্র বাংলাদেশের। মালিক দেশের জনগণ। প্রথমে ইজারা দেওয়া হয়েছে অক্সিডেন্টালকে। অক্সিডেন্টাল বিক্রি করে দিল ইউনোকলের কাছে। ইউনোকল বিক্রি করে দিল শেভরনের কাছে। শেভরন বিক্রি করছে হিমালয় এনার্জির কাছে। এই পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে কোথাও বাংলাদেশ নেই! এভাবে বললে অবশ্য সত্য বলা হয় না। বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা আছে। পিএসসি অনুযায়ী ইজারা নেওয়া কোম্পানি গ্যাস ক্ষেত্র অন্য কোনও কোম্পানরি কাছে বিক্রি করতে চাইলে পেট্রোবাংলার সম্মতির প্রয়োজন হয়।

অক্সিডেন্টাল যখন ইউনোকলের কাছে বিক্রি চূড়ান্ত করে ফেলে, পেট্রোবাংলা দাবি করে তারা কিছু জানে না। তাদের না জানিয়ে বিক্রি করা হয়। আইন অনুযায়ী অক্সিডেন্টাল তা করতে পারে না। কিন্তু পেট্রোবাংলা ঠিকই তাদের বিক্রি প্রক্রিয়ার অনুমোদন দিয়ে দেয়।

ইউনোকল যখন শেভরনের কাছে বিক্রি করে, তখনও পেট্রোবাংলা দাবি করে তারা কিছু জানে না। তাদের কিছু জানানো হয়নি। বিক্রির অনুমোদন এক্ষেত্রেও দিয়ে দেয় পেট্রোবাংলা।

শেভরন এখন বিক্রি করছে হিমালয় এনার্জির কাছে। এখনও পেট্রোবাংলা দাবি করছে, তাদের কিছু জানানো হয়নি। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানাচ্ছে, শেভরন চীনের কোম্পানি হিমালয় এনার্জির সঙ্গে বাংলাদেশের তিনটি গ্যাস ব্লক বিক্রির চুক্তি চূড়ান্ত করে ফেলেছে।

গ্রামীণ প্রবাদ আছে না, যার বিয়ে তার খবর নাই...। সম্পদ একহাত থেকে আরেক হাতে চলে যাচ্ছে, যার সম্পদ তার কোনও খবর নেই!

৩. শেভরনের থেকে এই তিনটি গ্যাস ব্লক বাংলাদেশও কিনতে চেয়েছিল। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট গ্যাস সরবরাহের ৫৮% আসে এই তিনটি গ্যাস ক্ষেত্র থেকে। বাংলাদেশ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যে সার্ভের দায়িত্ব দিয়েছে ব্রিটিশ কোম্পানি উড ম্যাকেঞ্জিকে। তারা এখনও রিপোর্ট দেয়নি। যে রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নেবে। বাংলাদেশের সিদ্ধান্তের জন্যে অপেক্ষা করেনি শেভরন। আমাদের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলছেন, ‘রিপোর্ট পাওয়ার আগে, আমরা তাড়াহুড়ো করে কোনও সিদ্ধান্ত নেব না। শেভরন নিশ্চয়ই আমাদের ‘অনুরোধ’ রাখবে।’

হিমালয় এনার্জির কাছে বিক্রির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ার পর, বাংলাদেশের ‘অনুরোধ’ কিভাবে রক্ষা করবে শেভরন, তা যদিও বোধগম্য নয়।

রয়টার্স জানাচ্ছে, বাংলাদেশের তিনটি গ্যাস ব্লক ২ বিলিয়ন ডলারে শেভরন বিক্রি করছে হিমালয় এনার্জির কাছে। এর আগে এক কোম্পানি আরেক কোম্পানরি কাছে কত দামে বিক্রি করেছে, কোথায় চুক্তি বা লেনদেন হয়েছে, কোনও তথ্যই প্রায় জানা যায়নি। মজার বিষয় পেট্রোবাংলা দাবি করে কোনও কিছু জানে না, আবার বিক্রি প্রক্রিয়ায় বাধা না দিয়ে অনুমোদন দিয়ে দেয়। এখন বাংলাদেশের গ্যাস ক্ষেত্র বাংলাদেশ কেনার জন্যে ইজারা নেওয়া বিদেশি কোম্পানি কাছে ‘অনুরোধ’ করে। কোম্পানি আবার বাংলাদেশের সেই ‘অনুরোধ’ বিবেচনা করে না। বাংলাদেশের অসহায়ত্বটা চিন্তা করলে, হাসি পায় কষ্টও হয়। কেমন শর্তের ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে যে, তারা যে কোনও সময় যার কাছে ইচ্ছে বিক্রি করে দিয়ে চলে যায়। বাংলাদেশের কিছুই করার থাকে না, বলার থাকে না। থাকলেও বলে না। কেন বলে না? ব্যক্তির লাভের কাছে দেশের স্বার্থ বিক্রি করে দিতে আমরা একটুও চিন্তা করি না। বিদেশি কোম্পানিগুলোর স্বর্গ বাংলাদেশ।

৪. আওয়ামী লীগ-বিএনপির ভেতরে এত বিরোধ, বিদেশি কোম্পানিকে সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে আবার বিস্ময়কর রকমের মিল।

২০০২  সালে অসত্য কথা বলে কানাডিয়ান কোম্পানি নাইকোকে ছাতক গ্যাস ক্ষেত্র দিয়ে দেওয়া হয়। সম্পূর্ণ জীবন্ত গ্যাস ক্ষেত্র নাইকোকে দেওয়ার সময় মৃত দেখানো হয়। ২০০৫ সালে অনভিজ্ঞ নাইকো কূপ খননের সময় টেংরা টিলায় পর পর দুই দফা দুর্ঘটনা ঘটায়।

অক্সিডেন্টাল এবং নাইকোর তিনবারের দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার গ্যাস সম্পদ ধ্বংস হয়। ১৯৯৭ সালে অক্সিডেন্টালের ঘটানো দুর্ঘটনার সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের জ্বালানি মন্ত্রী ঘটনাস্থলে গিয়ে ঘোষণা দেন, ‘ক্ষতির পরিমাণ খুবই সামান্য’।

২০০৫ সালে নাইকো কর্তৃক টেংরা টিলায় দুর্ঘটনা ঘটানোর পর বিএনপি সরকারের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ঘটনাস্থলে গিয়ে বলেন, ‘ক্ষতির পরিমাণ সামান্য’।

ক্ষতিপূরণ আদায়ের ক্ষেত্রে বিএনপি-আওয়ামী লীগ সরকার নজীরবিহীনভাবে টালবাহানা করে। অক্সিডেন্টাল এবং নাইকোর পক্ষ হয়ে সবকিছু চাপা দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে নেয় সরকার। জাতীয় কমিটি এবং নাগরিক সমাজের চাপে তদন্ত কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয় সরকার। তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দেয়। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সেই তদন্ত রিপোর্ট পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের কেবিনেট থেকে ‘হারিয়ে’ যায়। বিএনপি ক্ষমতায় এসে সেই ‘হারিয়ে’ যাওয়া রিপোর্ট উদ্ধার করে। কিন্তু ক্ষতিপূরণ আর আদায় করা হয় না। এক কোম্পানি আরেক কোম্পানির কাছে যখন গ্যাস ব্লক বিক্রি করে দিয়ে চলে যায়, পেট্রোবাংলা কিছু না জানার ভান করেও অনুমোদন ঠিকই দিয়ে দেয়। অনুমোদন দেওয়ার সময় ক্ষতিপূরণ আদায় বা ক্ষতিপূরণ বিষয়ে কোনও কথা বলে না।

অক্সিডেন্টাল-ইউনোকল-শেভরন কারও কাছ থেকেই ক্ষতিপূরণ আদায়ের কার্যকর কোনও উদ্যোগ বাংলাদেশ সরকার নেয়নি। অনেক কম পরিমাণ ক্ষতির অর্থ ইউনোকলের কাছে চাইলেও, তা পাওয়া যায়নি। ইউনোকলের গ্যাস ক্ষেত্র বিক্রি করে দিয়ে চলে যেতেও সমস্যা হয়নি।

বিদেশি কোম্পানিগুলোকে সুবিধা দেওয়া এবং ক্ষতিপূরণ আদায় করার ক্ষেত্রে নানা রকম টালবাহানা করার গুরুত্বপূর্ণ সময়কালে জ্বালানি সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তৌফিক এলাহী চৌধুরী। বর্তমান সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা হিসেবেও তিনি কাজ করেছেন। বিস্তর অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।

বিএনপি সরকারের জ্বালানি মন্ত্রী মোশারফ হোসেন তো নাইকো থেকে ৫ হাজার ডলার ঘুষ নেওয়ার অপরাধে কানাডার আদালতে দণ্ডিতও হয়েছে।

৫. শেভরনের এখনকার বিক্রির ক্ষেত্রে কী ঘটবে? আগাম মন্তব্য করে রাখি, পাঠক মিলিয়ে নিতে পারবেন পরবর্তীতে।

যা ঘটতে পারে-

শেভরন গ্যাস ব্লক বিক্রি চূড়ান্ত করে ফেলবে (ইতিমধ্যে ফেলেছে) হিমালয় এনার্জির কাছে।

বাংলাদেশ বলবে, এই গ্যাস ক্ষেত্র কেনা লাভজনক নয়। অর্থাৎ ২ বিলিয়ন ডলার দিয়ে কিনে লাভ করা যাবে না। এই সব ব্লকে মজুদ বেশি নেই। টাকা উঠবে না। পেট্রোবাংলা শেভরনকে বিক্রির অনুমোদন দিয়ে দেবে। বাংলাদেশের পাওনা ক্ষতিপূরণ নিয়ে কোনও আলোচনা হবে না।

৬. একটি দেশের খনিজ সম্পদের লুণ্ঠনের এমন চিত্র খুব বিরল নয়। আফ্রিকার নাইজেরিয়াসহ কিছু দেশে এমন হয়েছে। লাতিন আমেরিকার কিছু দেশের সম্পদও এভাবে লুণ্ঠন হয়েছে। পরবর্তীতে হুগো শ্যাভেজ যুগে এসে ভেনিজুয়েলা, ইকুয়েডরসহ কিছু দেশ লুণ্ঠন প্রক্রিয়া ঠেকাতে সক্ষম হয়েছে। তাদের বিপুল সম্পদ, লুণ্ঠনের পরও পরিমাণে অনেক রয়ে গেছে। আমাদের স্থল ভাগের গ্যাস সম্পদ অত্যন্ত সীমিত। তার বেশির ভাগই বিদেশি কোম্পানিকে লুটপাটের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। শেভরন সবার চোখের সামনে দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের সম্পদ বিক্রি করে, ২০০ কোটি ডলার নিয়ে চলে যাবে। পরবর্তী লুণ্ঠনটা অপেক্ষা করছে সমুদ্রের গ্যাসসহ অন্যান্য খনিজ সম্পদের ক্ষেত্রে।

মন্তব্য করার কোনও প্রয়োজন নেই যে, জনগণের পক্ষে জনগণের সম্পদ যারা রক্ষণাবেক্ষণ করছেন, কতটা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে তা করছেন!

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
কুমিল্লা শিক্ষা প্রকৌশল কার্যালয়ে ঠিকাদারকে মারধর২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ