X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রায় নিয়ে বিতর্কের অবসান হোক

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
১৮ আগস্ট ২০১৭, ১৪:৪৪আপডেট : ১৮ আগস্ট ২০১৭, ১৪:৪৬

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী ১৬তম সংশোধনীর রায় নিয়ে দেশে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগ আর বিএনপি উত্তেজনা সৃষ্টির খোরাক পেয়েছে এ রায়ে। ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়। এ রায় পড়তেও ক্লান্তি আসে। হাইকোর্ট সার্টিফিকেট দিয়েছিলো সংবিধানের আর্টিকেল ৯৬ প্রযোজ্য হবে কিনা, সাংবিধানিক হবে কিনা? নিয়ম অনুযায়ী হাইকোর্ট যে অংশটুকু সার্টিফিকেট দিয়েছে সে অংশটুকুর শুনানি এবং রায় ছিল সুপ্রিম কোর্ট থেকে প্রত্যাশিত। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তা না করে বহু কাহিনির অবতারণা করে এক রায় দিয়েছেন। তাতে দেশের দুই ডমিনেন্ট পার্টি মর্মাহত হওয়ার আর অহ্লাদিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
বিএনপি এ রায়ে তাদের আনন্দ প্রকাশের কী পেয়েছে জানি না; মাননীয় প্রধান বিচারপতি রায়ে জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদকে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী বলে উল্লেখ করেছেন এবং বিদ্রুপ করে বলেছেন তারা 'ব্যানানা রিপাবলিকের' প্রতিষ্ঠাতা। 'অবৈধ পিতার' 'অবৈধ সন্তান' হচ্ছে বিএনপি।
রায়ে সর্বমোট শেখ সাহেবের নাম এসেছে ১১ বার। বঙ্গবন্ধু শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে নয় বার। আবার রায়ের বয়ানে শেখ সাহেবকে জাতির জনক বলে উল্লেখ করা হয়েছে ৩ বার।
রিপোর্টাস ইউনিটিতে আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘কোনও একক ব্যক্তির নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি’ এ কথাটা অপ্রাসঙ্গিক এবং ইতিহাস বিকৃতির সমান। সম্ভবতো আওয়ামী লীগের সব আপত্তির মূলে হচ্ছে এটাই। অবশ্য রায়ে বলা হয়েছে, ‘কোনও জাতি- কোনও দেশ একজনের দ্বারা তৈরি হয়নি। যদি আমরা সত্যিকার অর্থে আমাদের জাতির পিতার সোনার বাংলার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই, আমাদের অবশ্যই ‘আমিত্বের’ আত্মঘাতী আকাঙ্ক্ষা এবং আসক্তি থেকে মুক্ত থাকতে হবে- এক ব্যক্তি বা একজন সব কিছু করেছেন এমন।’ সম্ভবতো আওয়ামী লীগের আপত্তির কারণ এখানে।
প্রধানমন্ত্রী রায়ের আপত্তিকর কথাগুলোর বিরুদ্ধে জনমত গঠনের জন্য সবাইকে সরব হতে বলেছেন। এখন সবাই বক্তব্য দিচ্ছেন ১৬তম সংশোধনীর সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল ১৩ আগস্ট ২০১৭। তারা সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় সমাবেশ করেছেন। সারাদেশব্যাপী বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ কর্মসূচি পালন করেছে ১৫ আগস্ট মঙ্গলবার পর্যন্ত।
হাইকোর্টের অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ১৬তম সংশোধনীর সুপ্রিম কোর্টের এই রায় নাকি লিখে দিয়েছেন বাইর থেকে কোনও এক ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদক। এ কথা বলে ব্যারিস্টার তাপস সুপ্রিম কোর্টের ভিত্তি মূলে শুধু আঘাত করেননি, তিনি বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ভিত্তি ‘এক বাক্যে ধ্বংস করে দিলেন’। সুপ্রিম কোর্টের মর্যাদাকে গ্রাম্য সালিশী আদালতের পর্যায়ে নিয়ে গেলেন।
তাপসেরা দেশের আইন আদালত ধ্বংস করে দিতে উদ্ধত হলেন কেন? জাতির আইন আদালত ধ্বংস হয়ে গেলে জাতি বেঁচে থাকবে কিসের ওপর ভিত্তি করে! অরাজকতার মাঝে তো জাতির বিনাশ হবে। আদালত বিনাশ হয়ে গেলে আইনের সার্বভৌম শক্তির পাহারা দেবে কে? রক্ষণাবেক্ষণ করবে কে? রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তির মালিক হবে আইন, ব্যক্তি নয়। কারণ ব্যক্তির মধ্যে আবেগ, ইচ্ছা, অনিচ্ছা আছে। ব্যক্তির শাসন হচ্ছে আবেগের তথা প্রবৃত্তির শাসন। আর আইনের শাসন হচ্ছে যুক্তির শাসন। আদালত ভণ্ডুল হয়ে গেলে আর আদালত টিউডর যুগের ‘কোর্ট অব স্টার চেম্বার’-এর মতো হয়ে গেলে আইনের শাসনতো উচ্ছেদ হয়ে যাবে।
আমরা সবিনয়ে অনুরোধ করব প্রধানমন্ত্রী যেন আওয়ামী লীগের নেতাদেরকে সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে নেওয়া অবস্থান থেকে বিরত করেন এবং রায়ে অহেতুক কোনও বক্তব্য যদি থাকে তা প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য আবেদন পেশ করেন। কোর্টকে অনুরোধ করবো অতি দ্রুত যেন অতিরিক্ত কথা যদি রায়ে থাকে তা যেন এক্সপাঞ্জ করে ফেলেন।
ইন্দিরা গান্ধীকে নির্বাচনি মামলায় যখন এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি জগমোহন লাল সিনহা এক রায় দিয়ে রায়বেরেলি কেন্দ্রে আনসিটেড করে দিলেন তখন ইন্দিরা গান্ধী পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের কু-পারমর্শে তিনি সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছিলেন তখন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ছিলেন অনাদি নাথ রায় যাকে ইন্দিরা গান্ধী তিনজন সিনিয়র জজকে ডিঙিয়ে প্রধান বিচারপতি করেছিলেন।
কুলদ্বীপ নায়ার তার এক বইতে লিখেছেন জগমোহন লাল সিনহাকে নাকি রায়ের আগে ইন্দিরা গান্ধী ৫ লাখ টাকা দিতে চেয়েছিলেন এক এমপির মাধ্যমে সে প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছিলো। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী রায় ঠেকাতে গিয়ে সিদ্ধার্থের কুপরামর্শে এতো অনিয়মে জড়িত হয়ে গিয়েছিলেন যে শেষ পর্যন্ত ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে তার ব্যাপক ভরাডুবি হয় খোদ রায়বেরেলিতে তিনি নিজেই পরাজিত হন। এরপরে তিনি সিদ্ধার্থকে যেখানে দেখেছেন তাকে তিরস্কার করেছেন।
১৯৮০ সালের নির্বাচনে জিতে ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হয়ে লন্ডন যান তখন সাংবাদিকেরা জিজ্ঞেস করেছিলেন এতো ঝামেলা সৃষ্টি করে আপনার লাভ হয়েছিলো কি? তখন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন লাভ হয়েছে জনতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলাম। আর ক্ষমতা থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম। আমরা শুধু শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর ঘটনা জানি। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঘটনাও জানেন ইন্দিরা গান্ধীকেও জানেন সুতরাং লম্বা কাহিনি বলার প্রয়োজন নেই।
প্রধানমন্ত্রীকে শুধু অনুরোধ জানাবো যেন বিচার ব্যবস্থার মর্যাদা ভুলুণ্ঠিত হওয়ার হাত থেকে বিচার ব্যবস্থাকে রক্ষার যেন উদ্যোগ নেন। একটা রায়ের জন্য একটা বিচার ব্যবস্থার মর্যাদা শেষ হয়ে যাওয়া কঠিন ব্যাপার।
বিচার ব্যবস্থাকে ফুটবল বানানো ঠিক হবে না। আওয়ামী লীগ দেশের বৃহত্তম দল আবার ক্ষমতাসীন। সুতরাং কোর্টকে স্তব্ধ করে দেওয়া তার পক্ষে খুবই সহজ। কোর্টকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করলে সভ্যতার পতন হবে।
কোর্ট কোর্টই। কোর্ট বিপ্লবের সূতিকাগৃহ নয়। সুতরাং কোর্টের বিপ্লবাক্তক চরিত্র কখনও কাম্য হতে পারে না। রায় প্রকাশের কয়দিন আগে প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, 'এখন আমিও রাজনীতি করা শুরু করবো'। ত্রিপিটকে পড়েছি, ‘লৌহজাত দ্রব্য হতে উৎপন্ন মরিচা যেমন লৌহকেই নষ্ট করে ফেলে। সেরূপ নীতিধর্ম অতিক্রমকারী ব্যক্তিকে নিজকৃত দুষ্কর্ম সকল দুর্গতিতে নিয়ে যায়'।
আমিত্ব তুমিত্ব নিয়েও রায়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। রায় উপদেশ বিতরণের জায়গা নয়। উপদেশ দিতে নেই। কথা বলারও একটা আর্ট আছে, সেটা আয়ত্তে না আসলে কথা বলে অন্যকে আনন্দ দেওয়া যায় না। আমরা আশা করবো সব পক্ষ রায় নিয়ে বিতর্ক শেষ করে দেবেন। পদক্ষেপ নিতে কোনও পক্ষই কুণ্ঠাবোধ করবেন না।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ