X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রায় ও রাজনীতি

শুভ কিবরিয়া
২৫ আগস্ট ২০১৭, ১১:৫৪আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০১৭, ১১:৫৯

  শুভ কিবরিয়া সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে সরকার এবং বিচারবিভাগ এখন মুখোমুখি। সরকারপ্রধান এই রায়সহ নানাবিধ বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করে প্রধান বিচারপতিকে প্রকাশ্যে কঠোরভাষায় সমালোচনা করেছেন। প্রধান বিচারপতি আদালতের এজলাসে বসে পাকিস্তানের উদাহরণ টেনে সরকারের যন্ত্রণা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। সরকার প্রধানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, নেতা, কর্মীরা মিডিয়ায় ও প্রকাশ্যে প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেই চলেছেন। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে সরকারি তরফে যে যার মতো ব্যাখ্যা দিয়ে প্রধান বিচারপতিকে অপদস্থ করে চলেছেন। সরকারের এই উত্তেজনার প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি তাদের তরফে ধৈর্য ধরার কথাও বলেছেন। সব মিলিয়ে আদালত বিশেষত প্রধান বিচারপতি বনাম সরকার ও সরকারি দল এক প্রকাশ্য বাহাসে লিপ্ত হয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইতিহাসে এই ঘটনা নজিরবিহীন।
একদিকে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও নেতারা প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে নানানভাবে কটাক্ষ করছেন এবং তার পদত্যাগের জন্য আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা আলটিমেটাম বেঁধে দিচ্ছেন। পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য রাজপথে প্রধান বিচারপতির ওপর চাপ প্রয়োগ করছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা প্রধান বিচারপতির সাথে নজিরবিহীনভাবে দেখা করে দৃশ্যত এক ধরনের সমঝোতার চেষ্টা করছেন।

আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সংসদ সদস্যদের কেউ কেউ বলছেন, এই রায় আদালতের বাইরে লেখা হয়েছে। তারা দাবি করছেন, ইংরেজি দৈনিকের একজন সম্পাদক এই রায় লিখে দিয়েছেন।

কিন্তু কেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে এতো ভয় পাচ্ছেন?

এইসব দেখে কেও কেও সন্দেহ প্রকাশ করছেন, প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে এই উত্তুঙ্গতার বিষয়টি কি আসলেই পারস্পরিক বিদ্বেষ নাকি সরকার ও প্রধান বিচারপতি কোনও সাজানো খেলা খেলছেন?

এসব গুজব, গসিপ, গাল-গল্পকে চালু রাখছেন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যানের অতি তৎপরতা। আদালতের এই রায় নিয়ে যে রাজনীতি হচ্ছে তা এখন জনমনেও পরিষ্কার। কিন্তু এই দ্বৈরথ, এই প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব কেন? এই দ্বন্দ্ব কোন দিকে মোড় নেবে? এর নির্দিষ্ট গন্তব্য কী? সে নিয়ে নানান সংশয় এবং উৎকণ্ঠাও দেখা দিচ্ছে।

বিএনপি একে একটি রাজনৈতিক সুযোগ ভাবছে। সিপিবি-বাসদ ও সুধীজনদের একটা অংশ একে গণতন্ত্রের জন্য আসন্ন বিপদের আগাম নমুনা হিসাবে দেখছে।

০২.

আওয়ামী লীগ এত ভয় পাচ্ছে কেন? তারা প্রধান বিচারপতিকে নাজেহাল করতে এতো মন্ত্রী মাঠে নামিয়ে দিচ্ছে কেন?

কেন তারা প্রধান বিচারপতির প্রতি হঠাৎ এতো রুষ্ট হয়ে উঠলো। সরকারের কাছে প্রধান বিচারপতি ক্রমশ অপছন্দের হয়ে উঠছেন কেন? এর সম্ভাব্য কারণ কী?

এক. প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিচার বিভাগকে কিছুটা গৌরবের মর্যাদায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত অর্ধদশক ধরে উচ্চ আদালত বা বিচার বিভাগ তার স্বাধীনসত্তা ফিরে পাওয়ার জন্য প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে এক ধরনের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এটি সকল প্রকার আমলাতন্ত্রকে দেশ শাসনের ব্যাপারে তাদের একচ্ছত্র কর্তৃত্বকে কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। প্রধান বিচারপতির প্রতি রুষ্ট হওয়ার এটা একটা কারণ হতে পারে।

দুই. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, এয়োদশ সংশোধনী বাতিল করার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে দারুণতরভাবে কোণঠাসা করতে পেরেছে সাফল্যের সঙ্গেই। আদালতের রায়কে ব্যবহার করে  তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন সম্পন্ন করা গেছে। আদালতের এই কার্যক্রম ক্রমান্বয়ে বিচারবিভাগকে যথেষ্ট শক্তিমান করে তুলেছে।

আদালত তার এই ক্ষমতা ব্যবহার করে ওয়ারেন্স অব প্রিসিডেন্ট পুননির্ধারণ করে দিয়েছে। জেলা জজদের সচিবের মর্যাদা দিয়েছে। এই আদালত বেসামরিক আমলাতন্ত্রের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনকে বেআইনি বলেছে। যদিও উচ্চ আদালতে সেই রায়ের নিস্পত্তি অপেক্ষমান। এই আদালত নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা ও চাকরিবিধিমালা নির্ধারণের জন্য সরকারকে চাপের মধ্যে রেখেছে।

আদালতের এই শক্তি যতক্ষণ নিজেদের ক্ষমতা নিরংকুশ করার কাজে লেগেছে ততক্ষণ সরকারের কাছে তা মধুর ঠেকেছে।  কিন্তু যখনই তা সরকারের ইচ্ছেমত শাসন প্রক্রিয়ায় কিছুটা বাধা তৈরি করেছে বা বাধা তৈরির ভবিষ্যত সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে তখনই এক ধরনের ভীতি কাজ করছে সরকারের মনস্তত্বে। এই বিবেচনায় আদালতকে বিশেষ করে প্রধান বিচারপতিকে সরকার প্রতিপক্ষ ভাবছে।

তিন. দ্রব্যমূল্য, জ্বালানিমূল্য, সড়ক পথ, পরিবহন খাত, সর্বত্র সরকারের সুশাসন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই সরকার কিছুটা সন্ত্রস্ত আদালতের দিকে চেয়ে। সম্প্রতি বাসাবাড়িতে জ্বালানি গ্যাসের মূল্য কমাতে বাধ্য হয়েছে সরকার আদালতের নির্দেশে। এগুলো লক্ষণমাত্র। কিন্তু আগামী দিনে রাজনীতি যে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে, সেখানে সরকার নিয়ে যারা অসন্তুষ্ট, সর্বত্র একটা বড় ঐক্য গড়ে দিতে পারে আদালতের যে কোনও নির্দেশনা। যেমন ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর আদালতের পক্ষ নিয়েছে সরকার বিরোধী সমগ্র অংশ। এই ঘটনা সরকারের ভেতরে আশঙ্কার পরিবেশ তৈরি করেছে। সরকার তাতে কিছুটা অস্থির ও বিচলিত।

চার. আদালত পাড়ায় যে সব আওয়ামী আইনজীবী এখন প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করছেন, তার পদত্যাগ দাবি করে আল্টিমেটাম দিচ্ছেন তারা অনেকে ব্যক্তিগত কারণেও প্রধান বিচারপতির ওপর ক্ষুব্ধ হতে পারেন। কেননা প্রধান বিচারপতির নানান প্রাতিষ্ঠানিক নৈতিক বিবেচনা বা নৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে এদের অনেকের ব্যবসায়িক বা ব্যক্তিগত স্বার্থের জায়গাতে আঘাত লেগে থাকতে পারে। সেটাও ক্রমশ আওয়ামী লীগ ও সরকারকে ভুলভাবে প্রধান বিচারপতির প্রতি রুষ্ট করার অনুঘটক হিসাবে কাজ করে থাকতে পারে। 

০৩.

সরকার তাই রায় নিয়ে রাজনীতি করার চেষ্টা করছে। সরকারের প্রধানতম অভিযোগ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি কতগুলো অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর অমর্যাদা করেছেন। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই রায়ের বিষয়ে আওয়ামী লীগ এক ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে। এই রায়ের যে অংশটি মূল বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে সেই পর্যবেক্ষণে (আদালতের ৭৯৯ পৃষ্ঠা রায়ের ৫৪ নম্বর পৃষ্ঠার প্রথম প্যারায়) বলা আছে:-

‘No nation- no country is made of or by one person. If we want to truly live up to the dream of Sonar Bangla as advocated by our father of the nation, we must keep ourselves free from this suicidal ambition and addiction of ‘I’ness. That only

one person or one man did all this and etc.’

এই প্যারা ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গেই জাতির পিতার কথা, তার সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের কথা বলা আছে। রায়ের কোনও অংশেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি অমর্যাদার কথা সুস্পষ্টভাবে আওয়ামী লীগ উল্লেখ করতে পারেন নাই। রায়ে ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’দের কথা বলা আছে। সেটাও ১৯৭২ সালে যে গণপরিষদ সংবিধান তৈরি করেছে গণপরিষদের সেই সম্মানিত সাংসদদের উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে। কাজেই রায় নিয়ে যে রাজনীতি চলছে তা খুবই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

০৪.

এখন দেখার বিষয় রায় নিয়ে রাজনীতির পরিণতি কোন দিকে যায়। দুই পক্ষই যদি অনড় অবস্থানে থাকে, সংঘাতের দিকে চলে যায় তবে রাষ্ট্রের দুই প্রধান অঙ্গ নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের এই টানাপড়েন নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রনৈতিক বিপর্যয়ের দিকেই ঠেলে দেবে দেশকে। সেই পথে অতীতে যে বাংলাদেশ যায়নি তা নয়। ভবিষ্যতেও সেই পথে হাঁটলে দেশের জন্য তা সুখকর কিছু হবে না। তাই দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই লাগাম টানা দরকার এই বিষময় বিরোধিতার। মনে রাখতে হবে নগর পুড়লে দেবালয় রক্ষা পাবে না। পেতে পারে না।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

 

.

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাংলাদেশ ব্যাংকে সংবাদকর্মীদের প্রবেশে বাধা: উদ্বিগ্ন টিআইবি
বাংলাদেশ ব্যাংকে সংবাদকর্মীদের প্রবেশে বাধা: উদ্বিগ্ন টিআইবি
আপাতত গরমেই খেলতে হচ্ছে সাবিনা-সানজিদাদের
আপাতত গরমেই খেলতে হচ্ছে সাবিনা-সানজিদাদের
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসেডর যুবরাজ
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসেডর যুবরাজ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ