X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিপদ কি কেটে গেছে?

আমীন আল রশীদ
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৪:০৫আপডেট : ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৪:০৬

আমীন আল রশীদ মিয়ানমারের হেলিকপ্টারের বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন এবং এরপর সে দেশের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে প্রতিবাদ জানানো এখন মোটামুটি নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন হলো, বারবার আকাশসীমা লঙ্ঘন করে মিয়ানমার আসলে কী বার্তা দিচ্ছে? তারা কি যুদ্ধের উসকানি দিচ্ছে নাকি বারবারই ভুলক্রমে তাদের হেলিকপ্টার বাংলাদেশের সীমানায় চলে আসছে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, বারবার রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এই প্রতিবাদ জানানোয় কী হয়? মিয়ানমার সরকার কি আদৌ এগুলোকে পাত্তা দেয়? যেখানে খোদ মার্কিন উপসহকারী মন্ত্রীকেও তারা সহিংসতাকবলিত রাখাইনের মংডু এলাকায় যেতে দেবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে তারা আসলে বিশ্ব জনমত কিংবা জাতিসংঘের চাপকে থোড়াই কেয়ার করছে। সামরিক সরকারের আমলে দীর্ঘদিন মার্কিন অবরোধে থাকার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মিয়ানমার সম্ভবত এখন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের হুমকিও আমলে নিচ্ছে না।
তবে এর মধ্যেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের টেলিফোন নিঃসন্দেহে একটি ভালো খবর। রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ পাঠানোর পর ১৪ সেপ্টেম্বর রাত পৌনে ১০টার দিকে সুষমা স্বরাজ ফোন করেন শেখ হাসিনাকে। গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশের যে অবস্থান, ভারতেরও একই অবস্থান। সেইসাথে মিয়ানমার যেন রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়, সেজন্য ভারতের পক্ষ থেকে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক চাপ দিয়ে যাওয়ার কথাও বলেছেন সুষমা।

যদিও এদিনই মিয়ানমারে চীনের রাষ্ট্রদূতকে উদ্ধৃত করে সে দেশের সরকারি সংবাদপত্র নিউ লাইট অব মিয়ানমার বলেছে, রাখাইনের সমস্যার বিষয়টি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে দেখছে বেইজিং। আবার এদিনই জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা বিশাল রোহিঙ্গা জনস্রোত সামলানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানবিক পদক্ষপের প্রশংসা করে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। সেইসাথে ইইউভুক্ত দেশগুলোর প্রতি মিয়ানমারের ওপর অবরোধ আরোপের বিষয় বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ মানবিকতার পরিচয় দিচ্ছে এটা যেমন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশ যে ক্রমেই একটা বিপদের গহ্বরে পড়ছে, তাতেও সন্দেহ কম। কারণ দলে দলে যে রোহিঙ্গারা আসছে তাদের সবাইকে নিবন্ধিত করা যাচ্ছে না। তাদের সবাইকে এক জায়গায় রাখাও যাচ্ছে না। তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে। দেশের একাধিক জায়গা থেকে অনেক রোহিঙ্গাকে পুলিশ আটক করেছে। বলা বাহুল্য, সাম্প্রতিক সহিংসতার শিকার হয়ে পালিয়ে আসা চার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার মধ্যে এরকম লাখখানেক মানুষ যদি বাংলাদেশের মূল জনগোষ্ঠীর মধ্যে মিশে যায়, সেটি চিহ্নিত করা খুবই কঠিন হবে। যা অতীতেও হয়েছে। ১৯৭৮ সাল থেকে কয়েক দফায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আসার পরে কূটনৈতিক তৎপরতায় লাখ দুয়েক রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হলেও অন্তত ৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্প ও নানা জায়গায় ছড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়। আগের সেই ৫ লাখের সঙ্গে এবার যুক্ত হলো আরও অন্তত ৪ লাখ। শেষমেষ কতজনককে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে বা আরও কত লাখ আসবে, তা বলা কঠিন।

এখানেই বাংলাদেশের বিপদ। একদিকে ঘনবসতিপূর্ণ, অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী নয়; এরকম আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে রোহিঙ্গাদের মতো একটা বিপন্ন জনগোষ্ঠী যখন মূল স্রোতধারায় মিশে যাবে, সেটি নানাবিধ সংকট তৈরি করবে। অধিকারবঞ্চিত এসব মানুষকে খুব দ্রুতই কোনও জঙ্গিগোষ্ঠী রিক্রুট করতে পারবে। নানাবিধ অপরাধে তারা সহজেই যুক্ত হয়ে পড়তে পারে; যার উদাহরণ এরইমধ্যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলে তৈরি হয়েছে। সুতরাং সুষমা স্বরাজের ফোন এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য চীনের ত্রাণ পাঠানো, মিয়ানমারের প্রতি ইউরোপীয় পার্লোমেন্ট এবং ওআইসির হুংকারে যতই মনে হোক যে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের বিপদ বোধ হয় কেটে গেছে, তা হয়তো মুদ্রার একপিঠ। অন্যপিঠ এখনও ধোঁয়াশা।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক, বিশেষ করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং আমাদের কোটি মানুষকে শরণার্থী হিসেবে সহায়তা করে যে উদাহরতার পরিচয় তারা দিয়েছিল ১৯৭১ সালে––সেই অভিজ্ঞতার পরও রোহিঙ্গা ইস্যুতে তারা শুরুতে বাংলাদেশের পক্ষে থাকেনি। বরং সেনাবাহিনী যখন রাখাইনে গণহত্যা চালাচ্ছিল, তখন মিয়ানমার সফরে যান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সুতরাং শেখ হাসিনাকে সুষমা স্বরাজের ফোন সেই পরিস্থিতি উত্তরণের একটা বড় ইঙ্গিত বলে ধরে নেওয়া যায়।

সামরিক খাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বন্ধু চীন। যাদের কাছ থেকে সম্প্রতি দুটি সাবমেরিন কেনার ফলে খোদ ভারতও নাখোশ বলে শোনা যায়। সেই চীনও রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রত্যক্ষভাবে মিয়ানমারের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। এখানে চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থই যে মূখ্য, তা এরইমধ্যে প্রমাণিত। রাখাইনের কিয়াকফু এলাকায় বঙ্গোপসাগরে  তারা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চায়। ফলে মিয়ানমারের বিপক্ষে সে দাঁড়াবে না। আর চীনের মতো শক্তিশালী প্রতিবেশীর কাছ থেকে যখন মিয়ানমার প্রত্যক্ষ মদদ পায়, তখন সে যারপরনাই বেপরোয়া হতেই পারে। আর দক্ষিণ তথা পুরো এশিয়ার রাজনীতিতে চীনকে বাইপাস করে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া যে পশ্চিমাদের পক্ষেও কঠিন, তা যুক্তরাষ্ট্রেরও জানা।

তবে এই ইস্যুতে কূটনৈতিক সম্পর্কের একটা নতুন সমীকরণ আমরা দেখতে পাই নিছক ধর্মীয় কারণে। যেমন মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ইস্যুতে যে তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ হয়ে গিয়েছিল, সেই তুরস্কই রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই ইস্যুতে তুরস্কের উচ্চকণ্ঠের মূল কারণ রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় পরিচয়। যদিও আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলেছেন, বাংলাদেশে বিপন্ন রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে তারা মুসলমান বলে নয়, বরং বাংলাদেশ তাদের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়েছে মানবিক কারণে। বাংলাদেশ বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। কারণ বাংলাদেশের মানুষও ১৯৭১ সালে এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশের পক্ষে। ইউরোপ তথা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভূয়সী প্রশংসা করেছে বাংলাদেশের। যদিও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে তাদের যথেষ্ট আপত্তি আছে এবং বর্তমান সরকারের প্রতি তাদের অভিযোগের শেষ নেই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় সরকারের মানবিক পদক্ষেপ মার্কিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছে।

এরকম কূটনীতি আর রাজনীতির হিসাবের বাইরে মূল উদ্বেগ বা প্রধান বিবেচ্য আসলে মানুষের জীবন। যেভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা দলে দলে বাংলাদেশে আসছে, যে ভয়াবহ সব ছবি আমরা গণমাধ্যমে দেখছি, তাতে বাংলাদেশের পক্ষে সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া সম্ভবপর ছিল না। কেননা তখন বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ বরং মিয়ানমারের চেয়েও খারাপ বলে প্রতীয়মাণ হতো। এখন বিশ্ববাসী দেখছে একটি হিংস্র রাষ্ট্রের বিপরীতে একটি মানবিক রাষ্ট্রের আচরণ। এক নতুন বাংলাদেশকে পৃথিবীর মানুষ আবিষ্কার করছে। সুতরাং শেষঅবধি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কোন পথে হবে, জাতিসংঘ কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে, চীন কতটা নিরপেক্ষ থাকতে পারবে এবং বাণিজ্যিক স্বার্থের বিপরীতে তার কাছে মানুষের জীবন কতটা প্রাধান্য পাবে––তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সারা বিশ্বে মিয়ানমারের যে ভাবমূর্তি নষ্ট হলো, বিশেষ করে শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সুচি সারা পৃথিবীতে যেভাবে সমালোচিত হয়েছেন, যেভাবে তার সারা জীবনের অর্জন ম্লান হয়ে গেলো, সেই ক্ষতি মিয়ানমার বা সু চির পক্ষে কোনোদিনই পূরণ করা সম্ভব হবে না।

লেখক: সাংবাদিক

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
বিক্রির জন্য সবজি কিনে ফেরার পথে দুই ব্যবসায়ী নিহত
বিক্রির জন্য সবজি কিনে ফেরার পথে দুই ব্যবসায়ী নিহত
টিভি ধারাবাহিকে খলনায়িকা রিনা খান
টিভি ধারাবাহিকে খলনায়িকা রিনা খান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ