X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৫ জানুয়ারির ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’

আমীন আল রশীদ
০৫ জানুয়ারি ২০১৮, ১৪:৩৫আপডেট : ০৫ জানুয়ারি ২০১৮, ১৪:৫২

আমীন আল রশীদ ‘অল্প গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন’ অথবা ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’— ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আলোচিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে এই কথাগুলো সরকার এবং সরকার সমর্থিতদের তরফে বারবার বলা হয়েছে। উন্নয়ন ও গণতন্ত্রকে পৃথক করে ফেলার এই প্রবণতা এর আগে কখনও লক্ষ্য করা যায়নি। পক্ষান্তরে বিএনপি ৫ জানুয়ারির এই নির্বাচন যেহেতু বর্জন করেছিল এবং প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছিল, তাই তারা এই দিনটিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ বলে অভিহিত করে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ৫ জানুয়ারি নিঃসন্দেহে একটি মাইলফলক এবং উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। যদিও এখনও এর খুব নির্মোহ বিশ্লেষণ হয়েছে— এমনটি বলা যাবে না।
একটি রাষ্ট্রে সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা যেসব শর্তের কথা বলেন, একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন তার অন্যতম। ভোট কতটা অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হলো, সেখানে সূক্ষ্ণ নাকি স্থুল কারচুপি হয়েছে, কতগুলো ব্যালট বাক্স ছিনতাই হয়েছে, কতজনের প্রাণহানি হয়েছে, ভোট গণনা ও ফল ঘোষণা কতটা প্রভাবমুক্ত থেকেছে— এসব আলোচনা সেকেন্ডারি। আলোচনার প্রথম বিষয় হচ্ছে সেখানে সব দল (অন্তত প্রধান দলগুলো) অংশ নিয়েছে কিনা। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে যতই সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষাকারী বলে অভিহিত করা হোক না কেন, এই নির্বাচনের সবচেয়ে বড় দুর্বল দিক হচ্ছে দেশের অন্যতম প্রধান একটি দল এবং তাদের শরিকরা এই ভোট বর্জন করেছে এবং প্রতিহত করতে চেয়েছে। তাই দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত এই জাতীয় নির্বাচন বিভিন্ন কারণেই দেশের রাজনীতিতে আরও বহু বছর আলোচিত হবে।
বিএনপি কেন এই নির্বাচনটি বর্জন করলো? তাদের কি এই শঙ্কা ছিল যে, তারা নির্বাচনে গেলে হেরে যাবে? কিংবা মাঠ প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকবে না? এবং এ কারণেই কি তারা এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করতে চেয়েছিল যেন নির্বাচনটি বানচাল হয় এবং অন্য কেউ ক্ষমতা গ্রহণ করে? বিএনপির তরফে অবশ্য এই নির্বাচন বর্জনের অন্য ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। তাদের অভিযোগ, বিএনপিকে হারানোর সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। সুতরাং ওই নির্বাচনে অংশ নিলে সেটিকে সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া হতো এবং পরবর্তী সময়ে ৫ জানুয়ারিকে তারা ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারত না।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে কত শতাংশ ভোট পড়েছে, কতজন সংসদ সদস্য বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন এবং গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় এই নির্বাচন কতটুকু ভূমিকা রাখতে পেরেছে, তা নিয়ে এই চার বছরে বিস্তর কথা হয়েছে। বাস্তবতা হলো— ১৫৩ জন সংসদ সদস্যের বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরল ঘটনা হলেও ওই সময়ে দেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, পেট্রোল বোমায় যেভাবে নিরীহ মানুষ নিহত হচ্ছিল, যেরকম একটি ভয়ার্ত কালো মেঘ দেশের রাজনীতির আকাশ ঢেকে দিয়েছিল, সেই পরিস্থিতিতে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি না হলে দেশ কোন দিকে যেত, তা আন্দাজ করা কঠিন নয়। কেননা, নির্বাচন না হলে কাদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা চলে যায় এবং তার পরিণতি কী হয়, তা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বিভিন্ন সময়ে দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে এবং সব শেষ ওয়ান ইলেভেনের সরকারের আমলেও তা দেখা গেছে। সুতরাং নির্বাচন না হওয়ার চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম অংশগ্রহণমূলক এবং বিতর্কিত নির্বাচনও রাষ্ট্রের সামগ্রিক নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার জন্য ভালো বলে মনে করা হয়।
আওয়ামী লীগের নেতারাও বোধ করি এই নির্বাচন নিয়ে খুব সন্তুষ্ট ছিলেন না। বিশেষ করে যারা ছাত্ররাজনীতির মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন, যারা ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেই বর্ষীয়ান নেতাদের মধ্যে নিশ্চয়ই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে একটা অতৃপ্তি আছে। কেননা ভালো খেলোয়াড় কখনও ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চান না।
নৈতিকতা ও গণতন্ত্রের বিচারে ৫ জানুয়ারির এই নির্বাচনটি হয়তো প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু দেশের মানুষ ঠিকই এই নির্বাচনকে বৈধতা দিয়েছে। কেননা এই নির্বাচনের আগে দেশে যে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়েছিল, একটা গুমোট পরিবেশ বিরাজ করছিল, সেখানে ভোটের পরদিনই রাস্তা-ঘাটের দৃশ্য বদলে যায়। মানুষের মনে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে আসে। অর্থাৎ বিতর্কিত নির্বাচন হলেও সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধ হোক। দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে না পড়ুক।
অস্বীকার করার উপায় নেই, আমরা যে ধরনের গণতন্ত্র প্রত্যাশা করি, তা থেকে আমাদের রাজনীতিবিদরা এখনও ঢের দূরে। সেই গণতন্ত্রে আমরা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধার যে ধ্রুপদি ধারণার কথা জানি এবং বিশ্বাস করি, সেই জায়গায় পৌঁছাতে আমাদের রাজনীতির হয়তো আরও বহু বছর লাগবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ যেভাবে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার ভেতরেও অর্থনৈতিকভাবে মোটামুটি একটা স্থিতিশীলতা ও মান বজায় রেখে চলেছে, সেই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে— এমন কোনও হঠকারিতাও দেশের জন্য বিপজ্জনক।
তবে ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’— এই যে নতুন রাজনৈতিক ধারণা অনেকে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, সেটিও যেকোনও একটি সত্যকে আড়াল করারই নামান্তর। সে কথাও আমাদের ৫ জানুয়ারির চার বছর পূর্তিতে এসে নির্মোহভাবে স্বীকার করা উচিত। কেননা, কোনও একটি রাষ্ট্রে প্রকৃত গণতন্ত্র থাকা মানে হলো সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা থাকবে, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে এবং উন্নয়নে জনঅংশগ্রহণ থাকবে। এই বিষয়গুলো থাকলে উন্নয়ন বাইডিফল্ট হবেই। ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’ তত্ত্বের প্রবক্তারা বস্তুত এক ধরনের পরোক্ষ একনায়কতান্ত্রিকতাকেই উসকে দেন; যা আখেরে রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর।
এ কথা অস্বীকারের সুযোগ কম যে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যদি একটি বিতর্কিত এবং ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনও না হতো, তাহলে চার বছর পরে এসে এই ২০১৮ সালের ৫ জানুয়ারি দেশের পরিস্থিতি হয়তো আমরা এতটা শান্তিপূর্ণ বা স্থিতিশীল পেতাম না। আমাদের স্মরণ করা উচিত ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালুর জন্য সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী আনার জন্য যদি নির্বাচনটি না হতো, তাহলে তার পরবর্তী বছরগুলো দেশ যে একটা অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে যেত, সে বিষয়ে নিশ্চয়ই কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন না। যদিও ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ওই ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটিও বিতর্কিত ছিল। অধিকাংশ বিরোধী দল এই ভোট বর্জন করে। মাত্র ২১ শতাংশ ভোট পড়ে। ক্ষমতাসীন বিএনপি ৩০০টির মধ্যে ২৭৮টি আসনে জয়ী হয়। ওই বছরের ৩০ মার্চ রাষ্ট্রপতি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন এবং প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন। রাষ্ট্রপতি সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। দেখা যাচ্ছে ১৫ ফেব্রুয়ারির ওই বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস হয় এবং একটি অনিশ্চয়তার হাত থেকে দেশ রক্ষা পায়।
এখন প্রশ্ন হলো— আমরা কি বারবারই এরকম ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র দোহাই দিয়ে ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন দেখব? নিশ্চয়ই না। আশা করা হচ্ছে, এ বছরের ডিসেম্বরেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। এই নির্বাচনে বিএনপি ও তার শরিক দলগুলো যদি অংশ নেয় এবং শেষমেষ যদি এটি একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়, তাহলে সেখানে কারচুপি যতই থাকুক, একটা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। দেশের মানুষ ভোটের নামে যেমন হানাহানি চায় না, তেমনি ভোট না হলে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাও চায় না। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন এলেই যে ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বের হওয়া খুব জরুরি। সেই কঠিন কাজটি আমাদের রাজনীতিবিদরা, বিশেষ করে প্রধান দু’টি দলের নেতারা কতটুকু করছেন, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিক

/টিআর/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
বিক্রির জন্য সবজি কিনে ফেরার পথে দুই ব্যবসায়ী নিহত
বিক্রির জন্য সবজি কিনে ফেরার পথে দুই ব্যবসায়ী নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ