X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

টয়লেট নিয়ে দু’চার কথা

আবদুল মান্নান
২০ জানুয়ারি ২০১৮, ১৩:৫৫আপডেট : ২০ জানুয়ারি ২০১৮, ১৮:৫০

আবদুল মান্নান জানি লেখার শিরোনাম পড়ে অনেকেই নাক সিটকাবেন। বলবেন,  দেশে এত সব মানবাধিকার সমস্যা, গুম, রাজনৈতিক সংঘাত, পদ্মা সেতুর জোড়াতালি, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন, ক্রিকেট খেলার টিকিটে বাংলাদেশ বানান ভুল, খালেদা জিয়ার মায়ের মৃত্যু দিবসকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার, আলু-পেঁয়াজের এমন আকাশচুম্বী দাম,  প্রেমিকের হাত ধরে তিন সন্তানের মায়ের ঘরছাড়া আর প্রেমিকের বুকে প্রকাশ্য দিবালোকে প্রেমিকার চাকু চালানোর মতো ঘটনা থাকতে টয়লেট নিয়ে লেখার আবার কী হলো? লেখার শুধু কারণই নয়, এই লেখার আগে আমি দু্ই/একজন ফেসবুককেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে কথা বলেছি। গুগলকেন্দ্রিক গবেষণা তো আছেই। টয়লেট নিয়ে বলিউডে ‘টয়লেট এক প্রেম কথা’ নামক একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে বলে শুনেছি। জেনেছি, ২০১৭ সালে সেই ছবি ভারতের ব্যবসা সফল ছবি। এই পর্যন্ত নাকি ৩৪ মিলিয়ন ডলার আয়ও করেছে। এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছেন, তার সরকার মনে করে, দেশে মন্দির বানানোর চেয়ে টয়লেট বা শৌচাগার বানানো অনেক জরুরি। ভারতে মোট জনসংখ্যার ৪৭ ভাগের বাড়িতে কোনও শৌচাগার নেই। জঙ্গল আর রেল-লাইনই তাদের একমাত্র ভরসা। বাংলাদেশের অবস্থা বেশ ভালো। মাত্র সাত ভাগ মানুষ খোলা জায়গায় গিয়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমাদের সঙ্গে পাকিস্তানের মুলতান থেকে সরকারি বৃত্তি নিয়ে পড়তে এসেছিল মাকসুদ আহম্মদ। তার কাছ থেকে জেনেছিলাম, পুরো গ্রামের মধ্যে তাদের বাড়িতেই একটি টয়লেট আছে কিন্তু ব্যবহার সীমাবদ্ধ। এটি তার বৃদ্ধা দাদির জন্য বানানো হয়েছিল। অন্যরা কাজটি নিকটস্থ খোলা জায়গায় অথবা ঝোঁপের আড়ালে সারতেন।  সেটি ১৯৬৭ সালের কথা। টয়লেট নিয়ে এই লেখার প্রেরণা পেয়েছি টিভি ব্যক্তিত্ব মিথিলা ফারজানার কাছে। তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

মিথিলা তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানিয়েছে, ক’দিন আগে তিনি গুলশানের এক ‘অভিজাত’ কফি শপে গিয়েছিলেন। কফি শপটি একটি আলিশান ভবনের দোতলায় অবস্থিত। ওই ভবনে ঢোকা গণভবনে ঢোকার চেয়েও কঠিন। নিরাপত্তা বলে কথা। কফির অর্ডার দিয়ে মিথিলা টয়লেট কোথায় জানতে চাইলে একজন ওয়েটার জানিয়ে দেয় টয়লেট-বিষয়ক সব কাজকর্ম নিচের তলায় হয়। ওপরে শুধু পকেট কাটার ব্যবস্থা। সপ্তাহ খানেক আগে সফররত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতির সঙ্গে একটি ডিনারে অংশ নিতে আমন্ত্রিত হয়ে একটু বেশি আগে গুলশানে চলে যাওয়ায় সময় কাটানোর জন্য এই ‘অভিজাত’ কফি শপটিতে ঢুঁ মেরেছিলাম সাহস করে। ঢোকার পূর্ব-মুহূর্তে পকেটে দু’বার হাত দিয়ে নিশ্চিত হয়েছি প্রবেশের সক্ষমতার বিষয়ে। এক কাপ কফি একটু আলু ফ্রাই আর দুই পিস পঞ্চাশ গ্রামের মুরগির টুকরার দাম রাখলো একহাজার টাকা।

টয়লেট নিয়ে এমন বিড়ম্বনা নতুন নয় । ১৯৭৬ সালে প্রথম টোকিও যাই। ওই সময় জাপানের খুব কম মানুষই ইংরেজিতে কথা বলতো। বিমানবন্দরে নেমে দেখি বিভিন্ন বাক্সে পর্যটকদের জন্য ছোট ছোট কিছু পুস্তক রয়েছে যেটিতে প্রয়োজনীয় কিছু জাপানি বাক্য ও শব্দ ইংরেজিতে লেখা আছে। একটি হাতে নিয়ে দেখি প্রথম বাক্যটি ছিল,  ‘Where is the toilet?’ এর জাপানি ভাষ্য, ‘Ben jo doko?’ হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। কারণ ওই মুহূর্তে ওটা আমার কাছে খুব প্রয়োজন ছিল।  

টয়লেট নিয়ে ইতিহাসে বেশ কিছু মজার চিত্র আছে। মোগল সম্রাটদের সব প্রাসাদে হাম্মাম খানা ছিল। স্নান আর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য মোগল বাদশাহরা এই হাম্মাম খানা ব্যবহার করতেন। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাওয়ার আগে হাম্মামের ক্রীতদাসরা গোলাপের সুগন্ধি ছড়িয়ে আসতেন। এদিক দিকে ইউরোপের রাজা বাদশাহরা অনেক পিছিয়ে ছিলেন। ফ্রান্সের জগৎবিখ্যাত ভার্সাই প্রাসাদ নির্মিত হয়েছিল ১৬২৪ সালে। এটি প্রথমে কুলিন ফরাসিদের শিকারের মৌসুমে ব্যবহারের জন্য নির্মিত হয়। পরে তা বিশাল প্রাসাদে রূপান্তর করা হয়। এই প্রাসাদে পরবর্তী ১৪৪ বছর কোনও ধরনের টয়লেট ছিল না। প্রাসাদে অবস্থানকারীদের প্রয়োজন পড়লে সেবাদাসরা মোবাইল টয়লেট নিয়ে আসতো।  ভার্সাই প্রাসাদে ৩০০টি অতিথি কক্ষ ছিল। এই সব কক্ষে সর্বক্ষণ অতিথি লেগেই থাকতো। তবে অতিথিরা আসার সময় নিজেরাই নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী টয়লেট নিয়ে প্রাসাদে প্রবেশ করতো। ভুলে কেউ না আনলে তাকে সূর্য ডোবা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গেই এই অভিজাত মেহমানরা প্রাসাদের সামনের অনিন্দ্য সুন্দর বাগানে তাদের প্রাকৃতিক কর্মটি সারতেন।

ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ বার্কিংহাম প্যালেসে থাকেন। প্রায় ৩০০ বছর পুরনো। রানি এলিজাবেথের আগেও অনেক রাজ পরিবার এই প্রাসাদে ছিল। ইংরেজদের বলা হয় জাতবেনিয়া। সব সময় ফন্দি আঁটে কোথা হতে টু’পাইস আয় করা যায়। আর রানি তো বহুদিন ধরে বেকার। সাম্রাজ্য আর নেই। রানি আর তার পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য প্রয়োজন আয়। ইংল্যান্ডে বিশ্বের বহুদেশ থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক আসছে। সবাই ভেতর হতে রানির প্রাসাদ দেখতে চায়। একদিন খুলে দেওয়া হলো প্রাসাদের একটি অংশ। কুড়ি পাউন্ডের টিকিট। টিকিট কেটে ঢুকলাম। ভেতরে ঢুকেই চোখ ধাঁধানো সব কামরা আর পেইন্টিং। পুরো প্রাসাদ ঘুরে দেখতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগবে। ঘণ্টাখানেক পরে টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন। পাহারাদারের কাছে সবিনয়ে জানতে চাই, ভাই রানির টয়লেটটা কোন দিকে? পাহারাদার কোনও দিকে না তাকিয়ে বললেন, রানির টয়লেটে যাওয়ার হুকুম নেই। বাইরে বাক্স টয়লেট আছে। সেখানে যাও, তবে পুনরায় ঢোকার সময় আরও কুড়ি পাউন্ডের টিকিট কাটতে হবে। এমন বেনিয়া বুদ্ধি না হলে কি ইংরেজরা আমাদের ২০০ বছর শাসন করেছিল?

চমৎকার একটি টয়লেট ব্যবহার করেছিলাম সুইজারল্যান্ডের একটি হোটেলে। টয়লেটে অবস্থানকালে ক্লাসিক সঙ্গীত শোনার ব্যবস্থা আছে। মোজারট, বেথোবেন, বাখ্ সব কিছু শোনার আয়োজন আছে। এখন তো অনেক অভিজাত বাড়ির টয়লেটে ছোটখাটো গ্রন্থাগারের ব্যবস্থাও থাকে। আমার পাড়ার মফজল চাচা তার নিম্ন আয়ের প্রায় পঞ্চাশটি ভাড়াটের জন্য দু’টি খাটা পায়খানার (টয়লেট) ব্যবস্থা করেছিলেন। দুটোর কোনোটাতেই দরজা ছিল না। সবাই ছাতা নিয়ে এই অভিনব টয়লেট ব্যবহার করতেন। প্রাকৃতিক কর্মটি সারার সময় সামনে ছাতা মেলা থাকতো। মফজল চাচার যুক্তি এই ব্যবস্থায় টয়লেট ব্যবহারকারীরা অযথা সময় নষ্ট করবে না।

ঢাকার আগারগাঁওয়ে একটি অত্যন্ত পুরাতন সরকারি অফিস আছে। নির্মাণের সময় স্থপতি ভিজিটরদের জন্য কোনও টয়লেট রাখেননি। তার কারণ তিনি যখন এই ভবনের নকশা তৈরি করেন, তখন আশপাশে অনেক জঙ্গল ছিল।

শেষ করি ওপার বাংলার প্রখ্যাত লেখক শৈলেষ দে’র একটি লেখা থেকে সামান্য একটি ঘটনা দিয়ে। শৈলেষ দে এই প্রজন্মের কাছে তেমন একটা পরিচিত নাও হতে পারেন।  দুই খণ্ডে তার লেখা ‘আমি সুভাষ বলছি’ আর ‘জ্যোতি বসু জবাব দাও’ একসময় বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। রম্য রচনা লিখেও তিনি বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। শৈলেষ বাবু লিখেছেন ‘খোদ মুখ্যমন্ত্রী তার সচিবকে ডেকে হুকুম দিলেন, এমন একটা কিছু বানাও, যা সকল ধর্মের মানুষ ব্যবহার করতে পারে। সেটি আমি উদ্বোধন করবো। তাতে আমার ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির একটা উদাহরণ সৃষ্টি হবে।’ সচিব মাথা চুলকে কাজে নেমে পড়লেন। মাস কয়েক পর মুখ্যমন্ত্রীকে জানালেন তার হুকুম মতো জনসেবামূলক এমন একটা সুবিধা নির্মাণ তিনি করেছেন, যা এখন উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত। এদিকে নির্বাচন সমাগত। দিনক্ষণ ঠিক হলো। সাইরেন হুটার বাজিয়ে ছুটলেন মুখ্যমন্ত্রী। সঙ্গে তার সচিব। ওমা গাড়ি হতে মন্ত্রী মশায় নেমে দেখেন সামনে একটা পাবলিক টয়লেট ফিতে কেটে উদ্বোধন করার জন্য প্রস্তুত!  সচিবের ওপর ক্ষেপে গেলেন মন্ত্রী মশায়। সচিব মোটেও বিচলিত না হয়ে বললেন ‘স্যার টয়লেটের মতো সেক্যুলার কোনও ব্যবস্থা তো হতে পারে না। এটি ব্যবহারে জাত ধর্ম বিচার করা হয় না।’ মন্ত্রী ফিতা কেটে অতপর টয়লেটে প্রবেশ করলেন। টয়লেটের প্রয়োজনীয়তা বোঝেনি এমন মানুষ জগৎ-সংসারে পাওয়া যাবে না। পরিষ্কার টয়লেট আর রান্নাঘর বাড়ির মালিকের রুচির পরিচয় দেয়। এবার থেকে কোনও অভিজাত এলাকার কফি শপে যেতে চাইলে, আগে খোঁজ নিয়ে যাবেন, তাদের টয়লেট ব্যবস্থা ওপরে নাকি নিচে।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
পরিবারের অভাব দূর করতে সিঙ্গাপুরে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন রাকিব
পরিবারের অভাব দূর করতে সিঙ্গাপুরে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন রাকিব
কেমন চলছে ভারতের লোকসভার দ্বিতীয় দফার ভোট?
কেমন চলছে ভারতের লোকসভার দ্বিতীয় দফার ভোট?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ