X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দুই কোরিয়ার বৈঠক এবং পানমুনজম ঘোষণার ভবিষ্যৎ

আনিস আলমগীর
০১ মে ২০১৮, ১৩:০৮আপডেট : ০১ মে ২০১৮, ১৩:১৩

আনিস আলমগীর মাথামোটা মানুষ হিসেবে পরিচয় পাওয়া দুই প্রেসিডেন্ট একে অন্যকে পারমাণবিক বোমার হুমকি দিচ্ছিল ক’দিন আগেও। উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উন বলেছেন তার টেবিলে যে বোতাম রয়েছে তা টিপলে ক্ষেপণাস্ত্র আমেরিকাকে আঘাত করবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, উনের টেবিলের বোতামের চেয়ে তার টেবিলের বোতাম বড়। এমন এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে হঠাৎ শোনা গেলো ট্রাম্প-কিম বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন চলতি মে মাসে।
সেই বৈঠকে কী কী অর্জন হতে পারে মার্কিন মিডিয়ায় এই নিয়ে যখন রঙতামাশা চলছে তা শেষ না হতেই ২৭ এপ্রিল ২০১৮ হয়ে গেলো আরেক চমক। দুই কোরিয়ার প্রেসিডেন্টদের মধ্যে বৈঠক। বৈঠকে তাদের আশা জাগানিয়া ঘোষণা। হঠাৎ করে কিম এতো ভালো লোক হয়ে গেলো সেটাই এখন আলোচনার বিষয়। সেইসঙ্গে দুই কোরিয় নেতার খাওয়া দাওয়া, বৈঠকের স্থান- সব কিছু আলোচনায় আছে। বৈঠকের স্থান ‘পিস হাউস’ এতো আলোচনায় এসেছে যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প টুইট করে তার ইচ্ছে ব্যক্ত করেছেন দুই কোরিয়ার সীমান্তবর্তী ওই গ্রামেই তিনি কিমের সঙ্গে নির্ধারিত মিটিং করবেন।
অন্যদিকে ট্রাম্প মনে হয় স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন তিনি শান্তিতে নোবেল পাবেন। তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইন- এর মতে পিয়ংইয়ংয়ের সঙ্গে পারমাণবিক বিরোধ নিষ্পত্তিতে তার প্রচেষ্টার জন্য ট্রাম্প নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া উচিত। দুই কোরিয়ার অশান্তি লাগিয়ে রেখেছিল আমেরিকা। এখন দাবি করছে শান্তি প্রচেষ্টায়ও তাদের ভূমিকা আছে, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের।
একটু পেছনে তাকালে আমরা দেখতে পাই, মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লব সফল হওয়ার পর সমগ্র ইন্দোচীন বা বর্তমান দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় কমিউনিস্ট আদর্শ গ্রহণের জন্য মানুষ উদগ্রীব হয়ে ওঠে। ভিয়েতনামে হো চি মিন এবং কোরিয়ার কিম ইল সাং কমিউনিস্ট বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। মাও সে তুংয়ের মতো তারাও জাতীয়তাবাদীদের বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। জাতীয়তাবাদের সমর্থনে এগিয়ে আসে আমেরিকা। ডালাস ডকট্রিনের মূল কথাই ছিল কমিউনিস্ট মতাদর্শকে প্রতিরোধ করা- এ কারণে ভিয়েতনামে এবং কোরিয়ায় আমেরিকা জাতীয়তাবাদের সমর্থনে কমিউনিস্টদের প্রতিরোধের জন্য সরাসরি মাঠে নেমেছিলো।
১৯৫৩ সালে দুই কোরিয়ার যুদ্ধ শেষে কমিউনিস্ট নেতা কিম ইল সাং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিয়ে উত্তর কোরিয়ায় কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেও সিনম্যান রি-এর নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদীরা কোরিয়ার দক্ষিণ অংশে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। তবে কাগজে কলমে যুদ্ধ শেষ হলেও ১৯৫৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত কোরিয়ার দ্বিধা বিভক্তি অব্যাহত আছে এবং উভয়ের মধ্যে কোনও সুসম্পর্ক কখনও ছিল না। অনেকটা যুদ্ধ অবস্থা বিরাজ করছিলো।
দক্ষিণ কোরিয়ায় শক্তিশালী সেনাবাহিনী থাকার পরও এখনও আমেরিকার পঞ্চাশ হাজার সেনা বাহিনী দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থান করছে আর প্রশান্ত মহাসাগরে গত শতাব্দীর পাঁচ দশক থেকে দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ানকে রক্ষা করার জন্য আমেরিকার নৌ-বাহিনীর শক্তিশালী অবস্থান এখনও পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। এখন তো আমেরিকা তার নৌশক্তির ৬০ শতাংশ আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে নিয়ে এসেছে। বিপুল যুদ্ধ জাহাজ আর বিমানবাহী রণতরী নিয়ে আমেরিকার নৌ-বাহিনী বিশ্বের বৃহত্তম নৌ-শক্তি।
ভিয়েতনাম মুক্ত হতে অবশ্য বিলম্ব হয়েছিলো। তবে গত শতাব্দীর সাত দশকে প্যারিস চুক্তি অনুসারে ভিয়েতনাম মুক্ত হয় এবং চুক্তি অনুসারে দুই বছরের মধ্যে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম একত্রিত হয়েছিলো। মুক্ত ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন হো চি মিন। সহজ সরল জীবন যাপনকারী হো চি মিন জীবনে কখনও জুতা পায়ে দেননি, টায়ারের স্যান্ডেল পরে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। আমি তাকে ভারত সফরের সময় কলকাতায় দেখেছি। পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু প্রদত্ত সংবর্ধনা সভায় তিনি উপস্থিত ছিলেন। মনে হয়েছিলো জ্যোতি বসুর পাশে বসা একজন সর্বস্ব ত্যাগী এক সন্যাসী।
দীর্ঘ ৬৫ বছর পর উত্তর কোরয়িার প্রেসিডেন্ট কিম জং উন আর দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইন-এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তবর্তী গ্রাম পানমনজুমের ‘পিস হাউসে’ এক ঐতিহাসিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। কোরিয়ায় দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও উভয় রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ মনে প্রাণে কখনও বিচ্ছিন্ন ছিল না। পানমুনজমের পিস হাউসে যখন উভয় নেতার মাঝে বৈঠক চলছিলো তখন কোরিয়ার সাধারণ মানুষ সম্মেলনের সফলতা কামনা করে গণ-প্রার্থনায় বসেছিলো।
উত্তর কোরিয়ায় কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় কিম পরিবারের হাত ধরে। তারাই ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় বহাল আছেন ৬৫ বছরব্যাপী। বর্তমান প্রেসিডেন্ট কিম জং উন সেই পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের মানুষ। আবার দক্ষিণ কোরিয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। অবাধ গণতন্ত্রের চর্চা রয়েছে সেখানে। যথা নিয়মে নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়। এশিয়ায় শিল্প সমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর মাঝে দক্ষিণ কোরিয়া অন্যতম। দক্ষিণ কোরিয়া আকারে, লোকসংখ্যায়, প্রাকৃতিক সম্পদে উত্তর কোরিয়ার চেয়ে ছোট হলেও শিল্প উন্নয়নে তারা সমৃদ্ধ এবং ধনী রাষ্ট্র। মানুষগুলো কঠোর পরিশ্রমী এবং নিবেদিত। এখনও দক্ষিণ কোরিয়া আইএলও’র শ্রম ঘণ্টাকে তোয়াক্কা করে না।
উত্তর কোরিয়া দরিদ্র দেশ। কমিউনিস্ট রীতিপ্রথায় শাসিত, ব্যক্তিগত কোনও স্বাধীনতা নেই। কঠোর রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলার মাঝে মানুষগুলোকে বসবাস করতে হয়। তবে তারা পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী। গত বছরের শেষের দিকে এবং এ বছরের প্রথম দুইমাস তারা বেশ কিছু ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে যে কারণে কোরিয়া উপদ্বীপসহ এ অঞ্চলে উত্তেজনা বিরাজ করছিলো।
দীর্ঘ সময়ব্যাপী এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রাখার পর হঠাৎ করে কিম জং উন শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের প্রতি এগিয়ে আসলেন কেন? কে তাকে উদ্বুদ্ধ করলো শান্তির আলোচনায় বসার জন্য? ট্রাম্পের আসলে কি এখানে কোনও ভূমিকা আছে? আসলে বেশ কিছু দীর্ঘমেয়াদী ও স্বল্প মেয়াদী প্রচেষ্টা এবং বিরাজমান পরিস্থিতিই তাকে বাধ্য করেছে পারমাণবিক অস্ত্রের খেলা বন্ধ করার কথা ঘোষণা করতে।
উত্তর কোরিয়া দীর্ঘদিনব্যাপী চীনের আর্থিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে রয়েছে। কিমকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি বেইজিং-এ ডেকে নিয়েছিলেন এবং সব বিষয়ে আলোচনা করে বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে শান্তির প্রয়োজনে আনবিক অস্ত্রের খেলা বন্ধ করতে হবে। চীনের প্রেসিডেন্ট-এর ওপর এ বিষয়টা নিয়ে আমেরিকার চাপ ছিল। আবার উত্তর কোরিয়া কঠোর বাণিজ্যিক অবরোধের মধ্যে রয়েছে যে কারণে তার সিমেন্ট রফতানি, কিলিংকার রফতানি শূন্যের কোটায় গিয়ে পৌঁছেছে এবং জাতীয় আয়ও বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করে আনবিক ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যয়বহন করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক।
কিম জং উন-এর বোন উত্তর কোরিয়ায় উন এর পরেই শক্তিশালী ব্যক্তি। তার বোন নাকি অব্যাহতভাবে চেষ্টা করেছে তাকে আনবিক অস্ত্রের ভয়াবহ খেলা থেকে ফেরানোর জন্য। বোনটি পলিটব্যুরোর সদস্য, তার ওপর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। অনেক বিশ্লেষক বলেছেন, বোনের প্রভাবে উন প্রভাবিত হয়েছেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দা প্রধান হচ্ছেন সুহ হন দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে চেষ্টা করছেন দুই কোরিয়ার রাষ্ট্র প্রধানকে এক টেবিলে বসানোর জন্য। ২০০০ সালে তিনি পিয়ং ইয়ং সফরও করেছেন। ২০০৩ সালেও তিনি উত্তর কোরিয়া সফর করেন। দীর্ঘ ২ বছর তিনি অব্যাহতভাবে উত্তর কোরিয়ায় অবস্থানও করেছিলেন। তিনি সব সময় বলেছেন আলোচনার কোনও বিকল্প নেই। এবার পানমুনজমের আলোচনা বৈঠক আরম্ভ হলে পিস হাউসের বাহিরে দাঁড়িয়ে তিনি অঝরে কেঁদেছিলেন।
গত ২৭ এপ্রিলের বৈঠক পানমুনজমের পিস হাউসে দুপুর পর্যন্ত চলে। এরপর ভোজের শেষে উভয়ে আবার বৈঠকে বসেন। এ বৈঠকের পর দুই নেতার তরফ থেকে আসে যৌথ ঘোষণা। কোরিয়া উপদ্বীপ ‘সম্পূর্ণ পরমাণু অস্ত্র মুক্ত করতে’ কাজ করার অঙ্গীকার করে আলিঙ্গন করেন উভয় নেতা। যৌথ ঘোষণায় বলা হয় দুই নেতা তাদের আট কোটি মানুষ ও সারা বিশ্বের সামনে ঘোষণা করছেন যে, কোরিয়া উপদ্বীপে আর কোনও যুদ্ধ হবে না এবং শান্তির নতুন যুগের সূচনা হবে। কোরিয়া যুদ্ধের ইতি টানার জন্য চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দেওয়া হয়। আসন্ন এশিয়ান গেমস সহ বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় যৌথভাবে অংশগ্রহণের কথাও ঘোষণা করা হয়।
পরমাণু ইস্যুতে অন্তত সাতবার চুক্তি ভঙ্গ করেছে উত্তর কোরিয়া। এবার দেখা যাক কিম জং উন ২৭ এপ্রিল যে অঙ্গীকার করলেন তা কতটুকু পালন করেন। ট্রাম্পের সঙ্গে আসন্ন বৈঠকটি পানমুনজম সম্মেলনে যেসব প্রতিশ্রুতি এসেছে তা বাস্তবায়নে সহায়ক হয় নাকি নতুন করে সমস্যা তৈরি হয়।

লেখক: সাংবাদিক
[email protected]

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিক্রির জন্য সবজি কিনে ফেরার পথে দুই ব্যবসায়ী নিহত
বিক্রির জন্য সবজি কিনে ফেরার পথে দুই ব্যবসায়ী নিহত
টিভি ধারাবাহিকে খলনায়িকা রিনা খান
টিভি ধারাবাহিকে খলনায়িকা রিনা খান
রাজধানীতে খেলাফত মজলিসের বিক্ষোভ
রাজধানীতে খেলাফত মজলিসের বিক্ষোভ
প্রচণ্ড গরমে দই-ফলের এই ডেজার্ট বানিয়ে খান
প্রচণ্ড গরমে দই-ফলের এই ডেজার্ট বানিয়ে খান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ