X
বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪
২৫ বৈশাখ ১৪৩১

সব ঘটনার কি অডিও বা ভিডিও থাকতে হবে?

আমীন আল রশীদ
১০ জুন ২০১৮, ১৩:০৩আপডেট : ১০ জুন ২০১৮, ১৩:১৩

আমীন আল রশীদ ইস্যুটা নিশ্চয়ই পুরনো হয়নি। কেননা, মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান এখনও চলছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, জঙ্গিবাদ ও মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। এই অভিযান একটি নতুন মাত্রা পায় যে টেলিফোন আলাপের কারণে, সেটি নিয়েও নানা কথা হয়েছে। তবে বিষয়টিকে একটু অন্যভাবেও দেখা যায়।
এটা ঠিক যে, টেকনাফের ওয়ার্ড কাউন্সিলর একরামুল হক নিহত হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত পরিবারের সঙ্গে তার যে কথিত ফোনালাপ ভাইরাল হয়েছে, সেটি শোনার পরে যেকোনও সংবেদনশীল মানুষের জন্যই সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকা কঠিন। যদিও এই অডিও ক্লিপের অথেনটিসিটি বা বিশ্বাসযোগ্যতা এখনও প্রশ্নাতীত নয়। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে বলা হচ্ছে, তারা অডিও ক্লিপটি খতিয়ে দেখছে। সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এত বড় অভিযানে দুয়েকটা ভুল হতে পারে। ভুল মানে একজন মানুষের জীবন কেড়ে নেয়া কিনা, সে প্রশ্নও উঠেছে।

তবে প্রশ্নটা অন্যখানে। তা হলো, বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে হত্যা বহু বছর ধরে চলছে। এর বিরুদ্ধে খুব বেশি প্রতিবাদ হয়নি। যদি একরামুল হকের নিহত (হত্যা) হবার আগ মুহূর্তের এই ফোনালাপটা প্রকাশ না হতো, তাহলে হত্যাটা বৈধ হয়ে যেত কিনা? এবং যারা এখন ওই ফোনালাপ শুনে ব্যথিত, মর্মাহত এবং ক্ষুব্ধ হচ্ছেন, তারা কোনও কথা বলতেন কিনা? এর আগেও কি আরও অসংখ্য স্ত্রী বিধবা হয়নি, কোনও সন্তান এতিম হয়নি?  আমাদের এই প্রতিক্রয়া জানানোর জন্য একটা অডিও বা ভিডিও প্রকাশ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়, এটাই ট্র্যাজেডি।

অস্বীকার করার উপায় নেই, মাদক বিশেষ করে ইয়াবা এখন তৃণমূলেও যেভাবে পৌঁছে গেছে, তাতে একটি বিশাল প্রজন্মের 'প্রতিবন্ধী' হওয়া রোধ করা কঠিন। সেই নির্মম বাস্তবতায় মাদকের বিরুদ্ধে একটি নির্মম অভিযান কাঙ্ক্ষিতই ছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভেতরে সেই অভিযানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার লোকেরও অভাব নেই। নারায়ণগঞ্জে সাত খুন কিংবা কলেজছাত্র লিমনকে পঙ্গু করে দেওয়ার প্রেতাত্মারা অত্যন্ত শক্তিশালী। ফলে সরকার একটি ভালো উদ্দেশ্যে অভিযান শুরু করলেও এটির বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হয়েছে।

প্রচলিত বিচারব্যবস্থার দুর্বলতা, পক্ষপাতদুষ্ট তদন্ত রিপোর্ট, বড় অপরাধীর বিরুদ্ধে সাক্ষী না পাওয়া, অর্থ ও রাজনৈতিক প্রভাবসহ নানা কারণে মাদকের গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। অতীতে বিভিন্ন সময়ের অভিযানে কিছু চুনোপুঁটি ধরা পড়েছে এবং যথারীতি জামিনে বেরিয়ে আগের মতোই অপরাধে জড়িয়েছে। ফলে এখন যে ধরনের জিরো টলারেন্স বা শূন্যসহনশীলতার নীতি নিয়ে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মাদকবিরোধী অভিযান চলছে, সেটির প্রতি এক ধরনের জনসমর্থন আছে। কিন্তু চট্টগ্রামে ইয়াবা ও অস্ত্র দিয়ে একজন আইনজীবীকে ফাঁসিয়ে দেওয়া এবং কাউন্সিলর একরাম হত্যার ঘটনাটি পুরো অভিযানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং যারা এই অভিযানকে সমর্থন করছিলেন, তারাও ক্ষুব্ধ হয়েছেন।

বাস্তবতা হলো, এই ক্ষুব্ধ হওয়া বা জনঅসন্তোষ তৈরির জন্য একটি অডিও ক্লিপ প্রচার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমরা স্মরণ করতে পারি, এর আগে সিলেটের শিশু রাজন থেকে শুরু করে নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল কান্তি এবং সিলেটের কলেজছাত্রী খাদিজার ওপর নৃশংসতার প্রতিবাদ হয়েছিল ওই ঘটনাগুলোর ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল বলে। সবশেষ বরিশালের বাকেরগঞ্জে আবু হানিফ নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষকের মাথায় মল ঢেলে দেওয়ার ভিডিও ভাইরাল হয় এবং এই ঘটনায়ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। যদিও এরকম ঘটনা  এর আগে-পরেও ঘটেছে। কিন্তু সেসবের অডিও ভিডিও নেই। ফলে সেসব নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ হয়নি।

প্রশ্ন হলো, যদি রাজনকে পিটিয়ে মারা কিংবা শ্যামল কান্তিকে কান ধরে উঠবস করানো অথবা খাদিজাকে কোপানোর ওই ভয়াবহ দৃশ্যগুলোর ভিডিও না থাকত, যদি উৎসাহী কেউ ওই দৃশ্যগুলো তাদের মোবাইল ফোনে ধারণ না করতেন, তাহলে এই ঘটনাগুলোর কী পরিণতি হতো? দ্রুততম সময়ের মধ্যে রাজন হত্যার বিচার কি হতো? শ্যামল কান্তি এবং খাদিজার পক্ষে কি সারাদেশ জেগে উঠত? কুমিল্লার কলেজছাত্রী তনু খুন হয়েছেন খোদ সেনানিবাস এলাকার ভেতরে। ওই নৃশংসতার কোনো ভিডিও নেই। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যারও ভিডিও নেই। নেই বলেই বছরের পর বছর মামলার তদন্তই শেষ হয় না।

তার মানে কি দাঁড়াচ্ছে এই যে যেকোনও ঘটনার ন্যায়বিচার পেতে গেলে বা জনমত গড়ে তুলতে গেলে তার অডিও বা ভিডিও থাকতে হবে? প্রশ্নটা এ কারণে যে শ্যামল কান্তিকে কান ধরে উঠবস করানোর কিছুদিন পরেই লালমনিরহাটে একজন শিক্ষককে প্রকাশ্যে জুতাপেটা করার খবর এসেছিল গণমাধ্যমে। ওই ঘটনার প্রতিবাদে শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা প্রতিবাদও জানিয়েছেন। কিন্তু এ নিয়ে খুব বেশি আলোড়ন তৈরি হয়নি। না ফেসবুকে, না মূলধারার গণমাধ্যমে। কারণ, ওই শিক্ষককে জুতাপেটা করার কোনো ভিডিও ছিল না।

খাদিজাকে কোপানোর প্রতিবাদে সারাদেশ মুখর হয়েছে। কিন্তু প্রতিদিন এরকম তো আরও অনেক খাদিজা নৃশংসতার শিকার হন। তার কোনও সম্মিলত প্রতিবাদ চোখে পড়ে? ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যাযজ্ঞ আনুষ্ঠানিকভাবে ১৫ বছর ধরে অর্থাৎ বিএনপির আমলে অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় থেকে চলছে। কিন্তু এই রাষ্ট্রীয় হত্যার বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে উঠতে ২০১৮ সালের একটি অডিও ক্লিপ প্রচার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো।

কাউন্সিলর একরামের নিহত হওয়ার পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আর দশটা ঘটনার মতো এটিকেও কথিত বন্দুকযুদ্ধ বলে বিবৃতি দিয়েছে। অডিও প্রকাশ হওয়ার পরে তারাই এখন বলছে, খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এটির অডিও প্রকাশ হয়েছে বলে খতিয়ে দেখা হবে, কিন্তু আরও যে অসংখ্য নিরীহ মানুষ কথিত ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে, সেসবও খতিয়ে দেখা হবে?

ধরা যাক একরামুল হক মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। তাতেও কি এই হত্যা  বৈধতা পায়? জাতির জনকের স্বীকৃত খুনিকেও প্রচলিত বিচারব্যবস্থায় সাজা দেওয়া হয়েছে। তাদের কোনও ধরনের আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া প্রকাশ্যে গুলি করে মারলেও খুব বেশি মানুষ হয়তো প্রতিবাদ করতেন না। গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, সাকার মতো যুদ্ধাপরাধীরও বিচার হয়েছে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া মেনে। তাদের তুলনায় মাদক ব্যবসায়ীরা কি বড় অপরাধী যে কোনও ধরনের বিচারের মুখোমুখি না করে, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে জনগণের পয়সায় কেনা অস্ত্র দিয়ে তাদের মেরে ফেলতে হবে?

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জোসেলুর জোড়া গোলে ফাইনালে রিয়াল
জোসেলুর জোড়া গোলে ফাইনালে রিয়াল
চেয়ারম্যান হলেন এমপির ছেলে ও ভাই
চেয়ারম্যান হলেন এমপির ছেলে ও ভাই
কিশোরগঞ্জের তিন উপজেলায় বিজয়ী হলেন যারা
কিশোরগঞ্জের তিন উপজেলায় বিজয়ী হলেন যারা
কদমতলীতে গলায় ফাঁস লেগে দশ বছরের শিশুর মৃত্যু
কদমতলীতে গলায় ফাঁস লেগে দশ বছরের শিশুর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ