X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

লাদাখে চীনের শক্ত অবস্থানের নেপথ্যে কী?

বিদেশ ডেস্ক
২২ জুন ২০২০, ১৭:০৯আপডেট : ২২ জুন ২০২০, ১৯:২৬
image

লাদাখে ভারতীয় টহল দল ও চীনা বাহিনীর সাম্প্রতিক আচরণ ছিল রীতিমতো মধ্যযুগীয়। হিমালয়ের এমন উচ্চতায় নো-ম্যান্স ল্যান্ডে বন্দুক বহন না করার বিষয়ে দুই দেশের মধ্যেই ঐকমত্য ছিল। দীর্ঘদিনের আঞ্চলিক বিরোধ যেন যুদ্ধে রূপ না নেয় সেজন্যই এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হয় দুই দেশ। তবে ১৫ জুনের পরিস্থিতি ছিল একেবারেই ভিন্ন। বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকট, করোনাভাইরাস নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির প্রেক্ষাপটে চীন সে দেশের জনগণের সামনে সার্বভৌমত্ব নিয়ে কঠোর অবস্থানের প্রমাণ হাজির করতে চেয়েছে। বিশ্লেষকদের আরেক অংশ অবশ্য একে আগ্রাসী মনোভাবের বাস্তবায়ন হিসেবেই দেখতে চাইছেন।

লাদাখে চীনের শক্ত অবস্থানের নেপথ্যে কী?

হিমালয় পর্বতমালার ওপর ভারতীয় সেনাদের মুখোমুখি হয় চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি। প্রায় ১৪ হাজার ফুট উচ্চতার খাড়া ভূখণ্ডের ঢালে দুই দেশের বাহিনী সংঘাতে জড়ালে বেশ কিছু সেনা গালওয়ান নদীর হিমাঙ্কের নিচে থাকা পানিতে পড়ে যায়। দুই পক্ষের মধ্যে কয়েক ঘণ্টা ধরে হাতাহাতি, সংঘর্ষ চলতে থাকে। সংঘাত শেষে জানা যায়, অন্তত ২০ ভারতীয় জওয়ান নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও কয়েক ডজন।

এ সংঘাতে ক্ষয়ক্ষতি শুধু ভারতের নয়; চীনেরও হয়েছে। তবে বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে তাদের ক্ষয়ক্ষতির সুনির্দিষ্ট কোনও পরিসংখ্যান হাজির করা হয়নি। এর আগে গত ৪৫ বছর ধরে চীন-ভারত সীমান্তে কোনও সেনার প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। সীমান্ত বিরোধ নিয়ে ইতোপূর্বে ১৯৬২ সালে যুদ্ধে জড়িয়েছে চীন-ভারত। ১৯৬৭ ফের সংঘাতে জড়ায় দুই দেশ। তবে দৃশ্যত উভয় পক্ষই উত্তেজনা এড়াতে চেয়েছিল।

১৫ জুন সোমবারের সংঘাত শুধু দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যেই ছিল না। এটি ছিল দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যকার লড়াই। উভয় দেশেই ক্ষমতায় রয়েছে জাতীয়তাবাদী শক্তি। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উভয়েই জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে পরিচিত। দু’জনকেই নিজ দেশের সেনাদের মরদেহের মুখোমুখি হতে হয়েছে। অথচ তাদের রাজনীতি কখনও সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত ইস্যুগুলোতে নিজেদের খুব বেশি দুর্বল হিসেবে দেখাতে চায় না। আর সেদিনের ঘটনাবলি ছিল নিঃসন্দেহে একটা বিস্ফোরক পরিস্থিতি।

১৫ জুনের ওই সংঘাতের পর গত ২০ জুন প্রথমবারের মতো এ নিয়ে মুখ খোলে বেইজিং। তাদের দাবি, সেদিন ভেবেচিন্তে উসকানি দিয়েছে ভারতীয় বাহিনী।

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিজিয়ান ঝাওয়ের অভিযোগ, গত এপ্রিল থেকে গালওয়ান উপত্যকার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারত রাস্তা, সেতু এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করছে। তবে বেইজিংয়ের সমালোচনার মুখে দিল্লির দাবি, তারা নিজেদের ভূখণ্ডেই অবকাঠামো নির্মাণ করেছে।

জার্মান মার্শাল ফান্ডের একজন সিনিয়র ফেলো অ্যান্ড্রু স্মল। তার মতে, সেদিনের ঘটনা ছিল নিয়ন্ত্রণরেখার বিদ্যমান স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের জন্য চীনের পক্ষ থেকে একটি বড় ধরনের ধাক্কা। তিনি সতর্ক করেছেন, সীমান্ত অঞ্চলগুলো সম্পর্কে তথ্য আদতে খণ্ডিত ছিল। বেশিরভাগই উপগ্রহ চিত্র থেকে সংগৃহীত ভারতীয় উৎস থেকে পাওয়া গেছে। তবে সেখানে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির একটা পরিষ্কার চিত্র পাওয়া গেছে।

অ্যান্ড্রু স্মল বলেন, ‘চীনা সামরিক বাহিনী একাধিক স্থানে তাদের অবস্থান শক্ত করে চলেছে। নিয়ন্ত্রণরেখাজুড়ে কেবল টহল না চালিয়ে তারা অবকাঠামো তৈরি এবং চলমান উপস্থিতি বজায় রেখেছে।’ তিনি বলেন, ‘এটাও অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে যে যেখানে এক মাস আগে মারাত্মক বিবাদ হয়েছিল, সেখানে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অনুমতি ছাড়া উভয় পক্ষের কমান্ডাররা এমন মারাত্মক হামলার পরিকল্পনা করবেন।’

অ্যান্ড্রু স্মল বলেন, ‘হ্যাঁ! বেইজিংয়ের জন্য এখন প্রতিবেশী দেশটিকে নিয়ে ঝামেলা শুরু করার সময় নয়। তারা নিজেরাই বেশ কয়েকটি সংকট মোকাবিলা করছে।’ জার্মান মার্শাল ফান্ডের এই সিনিয়র ফেলো বলেন, করোনাভাইরাসে চীনের অর্থনীতি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। ১৯৭০-এর দশকে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে।

হংকং বিদ্রোহী এবং বেইজিংয়ের সেখানে একটি সুরক্ষা আইন কার্যকর করার ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। হংকংয়ের বিক্ষোভ এবং সেখানে নতুন নিরাপত্তা আইন কার্যকরের ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

করোনার উৎস নিয়ে তদন্ত দাবি করায় অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গেও বিবাদে জড়িয়েছে চীনা কর্তৃপক্ষ। এর জেরে ইতোমধ্যে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গেও বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছে বেইজিং। একই সময়ে প্রযুক্তি জায়ান্ট হুয়াওয়ের একজন সিনিয়র এক্সিকিউটিভকে হস্তান্তরের বিষয়ে কানাডার সঙ্গেও বিবাদ চলছে তাদের।

বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, ভারতীয় সীমান্তে আগ্রাসন হচ্ছে এসব দেশীয় চাপের প্রতিক্রিয়া। আর এই প্রতিক্রিয়া এসেছে এমন একজন নেতার কাছ থেকে যিনি জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি দুর্বল না হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক অংশীদারের পাশাপাশি অর্থনীতিকেও হতাশ করেছেন এবং সম্পর্ক নষ্ট করেছেন। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির নিরাপত্তা অধ্যয়ন প্রোগ্রামের পরিচালক টেলর ফ্রেভেল বলেন, ‘আমার মনে হয় চীনা প্রেসিডেন্ট যে চাপের মধ্যে রয়েছেন এটি তারই একটি সহজাত প্রতিক্রিয়া।’

টেলর ফ্রেভেল বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে চীনকে আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। দেশের মধ্যকার অর্থনৈতিক সংকট এবং চীন-মার্কিন সম্পর্কের অবনতির ফলে সার্বভৌমত্ব ইস্যুতে বেইজিং একটি শক্ত অবস্থান নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তারা বোঝাতে চায় যে চীন ভীত নয়।’

কোনও কোনও বিশ্লেষক একে চীনের সুবিধাবাদী আগ্রাসন হিসেবেই দেখছেন। তারা বলছেন, এই আগ্রাসন এমন একটি সরকারের পক্ষ থেকে যারা গত এক দশকে উগ্র জাতীয়তাবাদ নিয়ে বৈদেশিক নীতিতে অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার এবং বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। হয় চীনকে গ্রহণ কর নতুন উত্তেজনা বাড়াও; এমন একটি পরিস্থিতি অন্য দেশগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেনে নেওয়া কিংবা উত্তেজনা তৈরির মধ্যে যেকোনও একটিকে বেছে নিতে বাধ্য করা হলে কোনও দেশই চীনের সঙ্গে বিবাদে যেতে চায়নি।

সোমবারের সহিংসতার পর শুক্রবার এ নিয়ে কথা বলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তার বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে বেইজিংয়ের সঙ্গে আরও উত্তেজনা এড়াতে তিনি রাজনৈতিক মূল্য দিতেও রাজি ছিলেন। টেলিভিশনে সম্প্রচারিত বক্তব্যে মোদি দাবি করেন, সেদিন চীনা সেনারা ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করেনি। যদিও এটি তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আগের অবস্থানের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।

মিয়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক জুন ড্রেয়ার বলেন, চীনের অর্থনীতি ভারতের পাঁচগুণ। তাদের ঘোষিত প্রতিরক্ষা বাজেট ভারতের চেয়ে ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। তবে এটা ঘোষিত বাজেট মাত্র। প্রকৃত পার্থক্য সম্ভবত আরও বেশি।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের রাজপথে চীনবিরোধী বিক্ষোভ এবং চীনা পণ্য বর্জনের হুমকির খুব বেশি অর্থনৈতিক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই। বেইজিংয়ের সামরিক অ্যাকশনে যাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। বরং এই সংঘাতে তাদের নিজেদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটাকে হয়তো চীন গুরুত্ব দিচ্ছে না।

কার্নেজি এন্ডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের সিনিয়র ফেলো এবং মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রবীণ উপদেষ্টা অ্যাশলে টেলিস বলেন, ‘এই সংকট আমাদের যে বিষয়গুলো শিখিয়েছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে: চীন সম্পর্কে ভারতের বোঝাপড়া যথেষ্ট দুর্বল এবং দিল্লিতে এ সংক্রান্ত আলোচনা সচরাচর নিজেদের প্রতি পক্ষপাতমূলক হয়ে থাকে।’

১৫ জুনের ঘটনা সীমান্তে প্রাণহানি এড়াতে দুই দেশের চুক্তির পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছে। এ ঘটনায় ভারতে হয়তো সাধারণ জনগণ এবং রাজনীতিবিদের মধ্যে চীন সম্পর্কে মনোভাব আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে। অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে এর নেতিবাচক প্রভাব হবে দীর্ঘমেয়াদি। ওয়াশিংটনের ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ইন্ডিয়া প্রজেক্টের পরিচালক তানভী মদন বলেন, ‘আমার ধারণা, ভারতে চীন আরও একটি প্রজন্মকে হারিয়েছে, যাদের অনেকেই চীনকে একটি সুযোগ হিসেবে দেখেছিল।’ প্রকৃতপক্ষে তারা এখন আর বেইজিংয়ের ওপর আস্থা রাখতে পারবে না।

তানভী মদনের মতে, অর্থনৈতিক আন্তনির্ভরশীলতা রাজনৈতিক ধকলকে হ্রাস করতে চলেছে; ১৫ জুনের ঘটনা এমন ধারণার অবসান ঘটাবে।

/এমপি/বিএ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
লোকসভা নির্বাচন: প্রথম ধাপে পশ্চিমবঙ্গের ৩ আসনে ভোট আজ
মানব ও সুপারি পাচারের অভিযোগে ভারতে শুল্ক কর্মকর্তা গ্রেফতার 
ভুয়া পরিচয়ে ভারতে বসবাস বাংলাদেশির, ৪ বছরের কারাদণ্ড
সর্বশেষ খবর
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
দুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টিদুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন