X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

অ্যালার্ম

ফারোহা সুহরোয়ার্দ্দী
১৪ নভেম্বর ২০২০, ১৩:১৯আপডেট : ১৪ নভেম্বর ২০২০, ১৩:২১

অ্যালার্ম আমি ভৌতিক একটা মিউজিক সেট করেছি মোবাইল ফোনের অ্যালার্ম হিসেবে। সেটা ভোর ছ’টায় যখন বাজতে থাকে তখন দুঃস্বপ্নের একটা অনুভূতি হয়। ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠে পড়ি। এই যে একটা রোমাঞ্চকর ঘটনা তৈরি করলাম, এতেই খুশিতে আটখানা। এই যে একটা খুশি তৈরি হলো, এতেই নিজের মধ্যে ঐশ্বরিক ক্ষমতা অনুভব করি। আমি একা মানুষের একাকিত্বের ক্ষমতা এনজয় করি।

তখন আমি অনেক ছোট। ছোট বলতে বয়সে ছোট। এখনকার মতো মনের দিক থেকে ছোট না। মনটা তখন বেজায় বড় ছিলো। দুটো নাবিস্কো লজেন্স পকেটে থাকলে, তার একটা বন্ধু সাদিককে দিয়ে দিতাম। আরেকটা মুখে দেবো, এমন সময় টমি লেজ নাড়তে নাড়তে হাজির। দাঁতে ভেঙ্গে অর্ধেকটা টমিকে দিয়ে দিতাম। আমার আঙ্গুলে লেগে থাকা লজেন্সের চিনির আঠা টমি খসখসে জিব দিয়ে চেঁটে নিতো। আমি মাইন্ড করতাম না।

খুলনার টিবি ক্রস রোডের সেই পুকুরওয়ালা বাড়িটায় আমরা ভাড়া থাকতাম। বাড়ির মালিক ছিলেন পুলিশের দারোগা। তবে তিনি বেঁচে ছিলেন না। দারোগার বয়স্কা বিধবা বউ, ছেলে নিয়ে উপরতলায় থাকেন। আমরা নিচতলায়। মহিলা যখন সধবা ছিলেন, সবাই এ বাড়িকে দারোগা বাড়ি বলে ডাকতো। এখন এ বাড়িকে সবাই বুড়ির বাড়ি বলে। বুড়ি ছিলেন খুব রিজার্ভ মানুষ। দরকার না পড়লে কারোর সঙ্গে মিশতেন না। ওনার ছেলে তুহিন একেবারে বিপরীত। আমাদের চেয়ে তিন-চার বছরের বড়, একটু বড় ভাই টাইপ। তুহিন ভাই, এটা সেটা দিয়ে আমাদের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। একবার আমায় একটা বাঁশের কঞ্চি, নাইলনের সুতো, বড়শি এবং ময়ূরের পালকের ডাঁটির ফতনা দিয়ে ছিপ বানিয়ে দিলেন। আমি তো মহাখুশি।

সকালে আম্মা যখন রুটির জন্য আটা ছেনতো, আমি সেখান থেকে একটা ছোট গোল্লা নিয়ে পুকুর পারে গিয়ে বসতাম। হাতে ছিপ। বড়শিতে আটার গোল টুকরো লাগিয়ে যেই পানিতে ফেলতাম অমনি পুঁটিমাছ এসে ঠোক্কর মারতো। ফতনাটা আড়াআড়ি থেকে উলম্বরেখায় অবস্থান নিতো। তারপর ডুবুডুবু হলে, আমি ডানে বা বামে নিয়ে ছিপে হ্যাঁচকা টান মারতাম। ছিপ যখন ওপরে উঠাতাম, সুতোর শেষ মাথায় তিড়িংবিড়িং করতো পুঁটিমাছ। বাতাসে মাছের ছটফটানি। সুতোয় দোল খাইয়ে মাছটা কাছে এনে, বড়শি থেকে ছুটাতাম। পিচ্ছিল পুঁটি হাতের আলতো মুঠোয় নিয়ে একটা অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে রাখতাম। তার উপর কাচের পিরিচ উল্টো করে ঢেকে দিতাম। সেখানে খটর খটর আওয়াজ হতো। একসময় শব্দ তৈরির মতো শক্তি থাকতো না পুঁটিমাছের।

গুনে গুনে দশটা পুঁটি ধরতাম। তখনই সেগুলো কুটে, ভেজে দিতে হতো। রুটি, চিনি, পুঁটিভাজা—এসব নাস্তা খেয়ে স্কুলে রওনা দিতাম। আট/নয় বছরের শিশু পনের মিনিটের পথ হেঁটে ভিক্টোরিয়া স্কুলে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। টমি কিছুটা পথ এগিয়ে দিতো। সে সময়ের মফস্বল শহর দিনে-রাতে কখনোই ব্যস্ত হতো না। ঢিলেঢালা আটপৌরে শহর। স্কুলড্রেস ছিলো না, তাই আমি ইচ্ছামতো জামা-কাপড় পরার সুযোগ পেতাম। একটা ঢিলে হাফপ্যান্ট, চেক হাফ শার্ট, পায়ে চটি। টমি যেখানে আমাকে ছেড়ে যেতো তারপরই সেলিম সাহেবদের বাড়ি। সেলিম সাহেবরা বনেদি পরিবার। একনামে সবাই চিনতো। বিশাল বাড়ি, প্রয়োজনের চেয়ে বড় সেই বাড়ির ফটক। আমি একদৌড়ে সেই ফটক পার হতাম। দুটো জিব লকলক করা দানবের মতো অ্যালসেশিয়ান কুকুর আমাকে দেখলেই পিলে চমকানো ডাক দিয়ে উঠতো। মনে হতো চেইন ছিঁড়ে এখুনি আমার গায়ে এসে পড়বে। এই কুকুরদুটো ছাড়া খুলনা শহরে আমার কোন শত্রু ছিলো না।

তখন আষাঢ় মাসের শেষ, পুকুরের পানি কানায় কানায় ভরা। মাঠেও মাঝেমধ্যে পানি উপচে ওঠে। তাতে ছোট ছোট ডানকানা-চেলা মাছ ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে পুরুত পুরুত করে ছোটে। একটু থামে ক্ষণিকের জন্য, তখন সরু রেখার মতো শরীরটা একটা মেটে অবয়ব নিয়ে পানিতে স্থির হয়ে থাকে। আমি ঠিকই বুঝতে পারি, ডানকানার মাথার উপর চকচকে বিন্দুটা দেখে। তারপর আবার দ্রুত ছুটে যায়। আমি কখনো ওদের ধরার চেষ্টা করিনি। কখনো কখনো ঘাসের লম্বা ডগায় ফড়িং বসতো। খুলনার বড় মাঠে মন্ত্রি-মিনিষ্টার যেমন হেলিকপ্টারে করে নামতেন, সেরকম লাগতো। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি আবিষ্কার না করলে আমিই হয়তো হেলিকপ্টারের প্রথম ডিজাইনটা করতাম। আমি নতুন করে কিছু আবিষ্কারের সুযোগ পেলাম না বলে এ জীবনে আফসোস রয়ে গেলো। সবই দেখি আবিষ্কার হয়ে বসে আছে।

স্কুলের সামনে বড় মাঠ। আট বছরের শিশুর জন্য মাঠটা কতো বড় তা বলে বোঝানো যাবে না। সত্তুরের দশকে বড় মাঠই ছিলো খুলনার প্রাণকেন্দ্র। হাদিস পার্ক ছিলো ধারে-কাছে। সেখানে ছোট ছোট কাঠের বাক্স নিয়ে একদল মানুষ ঘোরাঘুরি করতেন। ছোট ছোট কাচের শিশি, নানা ধরণের কান-খুশকি, তুলো এসব দিয়ে মানুষের কানের ময়লা পরিষ্কার করতেন। হাদিস পার্কের বেঞ্চে বসে এক চোখ খোলা, এক চোখ বন্ধ করে ক্লায়েন্ট বসে আছেন। কানের ভিতর বুজবুজি বলে একধরণের তরল ঢেলে লম্বা সরু স্টিলের কাঠি ঢুকিয়ে ময়লা পরিষ্কার করা হচ্ছে। এক চোখ বন্ধ থাকতো আরামে। এক চোখ খোলা থাকতো কাঠির মাথায় গাঁথা তুলোর কালেকশন দেখার জন্য। দ্বিবিধ আনন্দ। আমি পার্কের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতাম। ভাবতাম হাতে টাকা পয়সা এলে আমিও একদিন বসে যাবো।

বড় মাঠের বড় বড় কারবার। সেখানে ফুটবল ম্যাচ হতো। ব্যান্ডপার্টি আসতো খেলা চলার সময়। বাজনার চেয়েও আকর্ষণীয় ছিলো ব্যান্ডদলের সদস্যদের পোষাক। সেসময় খুলনা শহরে ফার্স্টফুড বলতে ছোলাভাজা, কটকটি বাদাম। কোক-ফ্যন্টা-সেভেন আপ খুব একটা চোখে পড়তো না। সেসবের বদলে পাওয়া যেত নকল কোল্ড ড্রিঙ্কস। দেখতে কোকের বোতল, ভিতরে লেবুর শরবত। এক বোতলের দাম চার আনা বা আট আনা। আমার দৈনিক টিফিনের বরাদ্দ চার আনা। পনের পয়সায় একটা টকমিষ্টি তেঁতুল আর দশ পয়সা জমানো মানুষ আমি। নকল কোকাকোলা কোথায় পাবো। ছেলেরা যখন বোতল উঁচিয়ে নায়ক ওয়াসিম সেজে চিয়ার্স করতো, সেটাও আমি ফুটবল ম্যাচের অংশ মনে করতাম। একঢোক গলায় ফেলে ছেলের দল ঢেকুর তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করতো। আমি একদিকে ব্যান্ড পার্টি, আরেকদিকে বল নিয়ে খেলোয়ারের দৌড়ঝাঁপ এবং মধ্যিখানে কোকাকোলা বয়দের কীর্তিকলাপ দেখতাম। তবে রোদ পড়ে যাবার পর বাসার বাইরে থাকার চল ছিলো না। মাগরীবের আজানের আগেই বাসায় ঢুকে পড়া লাগবে। তাই ম্যাচের শেষ বাঁশি পর্যন্ত খেলা দেখার সুযোগ পেতাম না।

ডক্টর নাথ ছিলেন এলাকার বিশিষ্ট হোমিও চিকিৎসক। ওনার ব্যাপারে আমার আকর্ষণ দু’কারণে। প্রথমত উনি আমার দেখা প্রথম খ্রিস্টান। দ্বিতীয়ত ওনার বাসার সামনে বড় খাঁচায় একটা লোমশ কুকুর থাকতো। সেই অ্যালসেশিয়ানের মতো উগ্র স্বভাবের নয়। ডক্টর নাথের মতোই নরম ভদ্র। গরীব মানুষের কাছে চিকিৎসার খরচ নিতেন না। এমনকি ফ্রি ওষুধ দিয়ে দিতেন। কয়েকমাস পরপর উনি ঢাকায় যেতেন, ওষুধ সংগ্রহ করতে। অরিজিনাল জার্মান ওষুধ ছাড়া হোমিওপ্যাথ কাজ করে না, এমনটাই বিশ্বাস করতেন ডক্টর নাথ। খুব মন দিয়ে রোগীর উপসর্গের কথা শুনতেন। আব্বার সঙ্গে যেতাম। উনি হোমিওপ্যাথ নিয়ে বিস্তর কথা বলতেন। এর ইতিহাস, বিকাশ, এবং সুবিধা। আব্বার কাছে শুনতেন সূফীতত্ত্ব। আমি ‘তৃতীয় মাত্রা’র জিল্লুর রহমানের মতো একবার এর দিকে, আরেকবার ওর দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাতাম। ঘুঘু পাখির মতো মধ্যখানে বসে এমন ভাব করতাম, যেন কতো কী শিখে নিচ্ছি। আসলে তো মন পড়ে আছে খাঁচার লোমশ কুকুরটার দিকে। ডক্টর নাথ নিশ্চয়ই ওটাকে দিনে চারবড়ি করে ফসফরাস খাইয়ে দেন। তাই এতো শান্ত থাকে। আমার টমিকে যদি ওই বড়ি খাওয়াতে পারেতাম। হতে পারে দেশি, কিন্তু আমার টমির চেহারায় যে মায়া সেটা ডক্টর নাথের বিদেশি কুকুরের ছিলো না। তাছাড়া টমি ছিলো শিল্পমনা। আমার সঙ্গে রেডিও’র নাটক শুনতো।

পুঁটিমাছ ধরা, স্কুল, বড়মাঠ, ডক্টর নাথ কিংবা সেলিম সাহেবের অ্যালসেশিয়ান কুকুর—আমার জীবন এভাবেই ঘুরপাক খাচ্ছিল। মফস্বলের নিরামিষ জীবন। ঘড়ির কাঁটার মতো, কোন ব্যতিক্রম নেই। তবে মনে আছে এক সকালে এলাকায় মাইকিং শুরু হলো, ‘‘ভাইসব, আসছে রবিবার, পাইওনিয়ার গার্লস স্কুলের পুকুরে, ডুব দেবেন...। একটানা ১৬ ঘণ্টা পানির তলদেশে অবস্থান করবেন...। আপনারা সবান্ধব আমন্ত্রিত।’ সেই মাইকওয়ালা রিকশার পিছনে ছুটলাম, ডিটেইল জেনে নিতে। প্রথমত গার্লস স্কুলে আমরা ঢুকতে পারবো কিনা। দ্বিতীয়ত টিকেটের দাম কতো। এছাড়া জানা দরকার ছিলো যে ডুব দেবেন, সে একাজ আগে করেছেন কিনা। আমি রিকশার পিছনে দৌড়ে সেই পুলিশ লাইন পর্যন্ত গেলাম। বারবার ঘোষণা শুনলাম। ঘোষক সম্ভবত যশোরের মানুষ। একটু রসিয়ে রসিয়ে বলছেন। আমার শোনা সেরা ঘোষণা সেটাই। মনে দাগ কেটেছিলো। ‘’আইশ্চর্য কথা, পানিতে ডুবি থাকবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কতা কি কানে যাচ্চে?’ এভাবে মূল ঘোষণার সঙ্গে এক্সটেম্পো বলছেন।

বাসায় ফিরে এসে বল্লাম সবাইকে। বড় তিনভাই পারলে তখনই রওনা হয়ে যান। আমি বললাম, সামনের রবিবার। আজ মাত্র বুধ। বোঝাই যাচ্ছে ডুব দেখার চেয়েও বড় আকর্ষণ পাইওনিয়ার গার্লস স্কুল। বোন মুখ টিপে হেসে বলে, সেদিন তো স্কুল বন্ধ থাকবে। তোমরা এতো উত্তেজিত কেন! আব্বা সবাইকে অভয় দিয়ে বলেন, কাজ না থাকলে আমিও তোমাদের সঙ্গে যাবো। চার আনা মাথাপিছু টিকেট। আমি তো মহাখুশি, কিন্তু বড় ভাইদের এ প্রস্তাব ভালো লাগেনি চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। আম্মার এসব একেবারেই পছন্দ না। এতোগুলো পয়সা নষ্ট করে এসব ভাঁওতাবাজী দেখার কোন মানে হয়। সামনের সপ্তাহে পিকচার প্যালেসে আসছে রঙিন সিনেমা, ‘দি রেইন’। তিনজন নায়ক, তিনজন নায়িকা। রেডিও’র বাণিজ্যিক কার্যক্রমে, হাঁ ভাই— দিনরাত মুখে ফেনা তুলে পাবলিসিটি করছে। সেই টকি দেখার ইচ্ছা আম্মার। হলে মেয়েদের জন্য লেডিস বলে একটা আলাদা বসার জায়গা আছে। সেখানে মায়ের সঙ্গে শিশুরাও যেতে পারে। আমার মেজ ভাই, আম্মার সঙ্গে লেডিসে বসে টকি দেখার ওস্তাদ। এক ছটাক ভাজা চিনেবাদাম নিতে কখনো ভোলেন না। ঘরে ফিরে এসে আমাদের কাহিনি শুনিয়ে গুণগুণ করে গানও গায়। ক’দিন খুব গাইলো, ‘হীরা আমার কাচকাটা হীরা...।’ শাবানা কীভাবে পাহাড়ে, জঙ্গলে, লেকের পাড়ে হীরাকে খুঁজে ফিরছে। ওদিকে নায়ক রাজ্জাক পাহাড়ের ওপাশ থেকে বেলবটম প্যান্ট পড়ে গানের বাকি অংশ গেয়ে হীরাকে ডাকছে। ‘ফিরে আয়, ফিরে আয়’, ডাক শুনে শেষে ছুটে আসে হীরা। সেসব শুনে আমি রূপকল্প তৈরি করতাম।

একা একা পুঁটি মাছ শিকারের সময় মেজ ভাইয়ের নকল করে আমিও সিনেমার গান গাইতাম। গাইতে গাইতে বাটিতে গুনে গুনে মাছ রাখতাম। সেদিন রাতে বেশ বৃষ্টি হলো। আমি ফিরে আয়, ফিরে আয় করে গোটাপাঁচেক পুঁটি ধরেছি। চারদিক পানিতে থৈ থৈ। যে ইটের উপর বসে মাছ ধরতাম সেটা ডুবে যাওয়ায়, আমি দাঁড়িয়েই মাছ ধরছিলাম। বসে মাছ ধরার সময় বড়শির সুতো বেশিদুর ছুড়তাম না। দাঁড়িয়ে ছিপের বড়শি একটু দূরে ছুঁড়লাম। অনেকটা সময় চলে গেলো, পুঁটিমাছের ঠোক্কর নেই। আমি জোরে গেয়ে উঠলাম, হীরা হীরা। সেই ডাক মনে হয় মাছরা শুনতে পেলো। দেখি ফতনাটা ডুবু ডুবু নয়, পুরোটা ডুবে গেছে। আমার ছিপে বেশ জোরে টান লাগলো। তীরের মতো বেঁকে গেলো ছিপ। তারপর হ্যাঁচকা টান। আমি হুড়মুড় করে পুকুরের পানিতে নেমে গেলাম। ভীষণ রাগ হলো পুঁটি মাছটার অপর। সাঁতার তখনো শেখা হয়নি। সে কথা মনেও নেই। পানিতে হাবুডুবু খেয়েও ছিপ ছাড়লাম না। পানিতে যেমন স্কি করে, আমিও তাই করতে লাগলাম। মাঝেমধ্যে মাছটা ভেসে উঠছে, আবার ডুব দিচ্ছে। আমি দুইহাতে শক্ত করে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বানানো ছিপ ধরে রেখেছি। বাঁচবো না মরবো সেকথা ভাবার সময় নেই। এরমধ্যে বাসার লোকজন জেগে গেছে। আব্বা, ভাইরা সবাই মিলে আমায় পুকুরের পারে টেনে তুললো। আমি ছিপ ধরে রেখেছি। মাছও ক্লান্ত। বেশ বড় একটা মৃগেল মাছ ধরা পড়েছে আমার বড়শিতে। টেনে তুলে আনা হলো। আমি এবং মাছ দু’জনেই কাহিল। আমি তখন ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সী’ উপন্যাসের বুড়ো সান্তিয়াগো। ঘাসের উপর শুয়ে আড়চোখে দেখি মাছটাও বিশ্রাম করছে। গায়ের রং হলুদ-কমলা। বেশ লম্বা। চোখদুটো লাল। বড়শিটা মাছের ঠোঁটে, গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। পুঁটিমাছের ছোট্ট ঠোঁটের একফোটা রক্ত সয়ে গেছিলো। কিন্তু ঢাউস আকৃতির মৃগেল মাছের অসহায়ত্ব আমাকে ভাবালো। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, মাছটাকে আবার পুকুরে ছেড়ে দেবো। ছেড়ে দেবার আগে আরেকবার তাকালাম। হাত বাড়িয়ে মাছটার মাথা চেপে বড়শি খোলার চেষ্টা করছি, এমন সময় তুহিন ভাই এলেন। আ’মাকে সাহায্য করলেন মাছটাকে মুক্ত করতে। তারপর মাছটা দুহাতে ধরে তুলে ধরলেন। উপর থেকে বাড়িওয়ালী দেখে বললেন, সেই যে পোনা ছেড়েছিলো তোর বাবা, সেই ব্যাচের। হাতের ঈশারায় তুহিন ভাইকে উপরে নিয়ে যেতে বললেন।

রাতে ভাঙা মন আর গায়ে জ্বর নিয়ে বিছানায় শুয়ে রইলাম। ঘুম আসছে না। আব্বা মাথার কাছে বসলেন। কপালে হাত দিয়ে বললেন, আমরা বাড়ি ভাড়া করেছি। পুকুর তো ভাড়া করিনি। তোমার মন খারাপ করার তো কিছু নেই। আমার কোন অভিযোগ নেই। তবে মন খারাপ। আমি বললাম, তুহিন ভাই তো আমায় ছিপ, বড়শি দিয়েছে। আমি তো রোজ মাছ ধরি। আব্বা বললেন, তাহলে তো আর কোন কথাই নেই। আজকে তুমি গুরুদক্ষিণা দিলে। কথার মানে না বুঝেই আমি একদিকে মাথা কাত করে মেনে নিলাম।

রাতে ঘুমের মধ্যে বড়মাঠের ফুটবল খেলা দেখলাম। সেলিম সাহেবের অ্যালসেশিয়ান কুকুরটার কামড় খেলাম দু’বার, আসতে একবার, যেতে একবার। ব্যথা পেলাম না। আজব ব্যাপার। তবে কষ্ট পেলাম, যখন আমাকে বড়শিতে গেঁথে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখা হলো। হাত পা ছুঁড়লাম। গলগল করে রক্ত ঝরলো ঠোঁটের দু’পাশ দিয়ে। পরে আব্বা নিয়ে গেলেন ডক্টর নাথের কাছে। উনি ঠোঁটের উপর লিকলিকে আঙ্গুল দিয়ে কী যেন একটা ঝাঁঝালো তরল মেখে দিলে বড়শির দাগ মুছে গেলো। এমন সময়, পাইওনিয়ার গার্লস স্কুলের পুকুরে ডুব দেয়া ব্লাউজ আর ইজার হাফপ্যান্ট পড়া মেয়েটা এলো। আমি লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলাম; কিন্তু দেখার লোভও সামলাতে পারছি না। মেয়েটা আমার চেয়ে বছর দশেকের বড় হবে। কিন্তু মনে হচ্ছিল, আমার সঙ্গে বেশ মানানসই। তারপর দু’জন পাহাড়ে, নদীর পারে,জঙ্গলে গাইতে থাকলাম, ‘হীরা হীরা হীরা...।’ সেই ডাকে ছুটে এলো হীরা, সাদা হাফপ্যান্ট আর সাদা শার্ট গায়ে। কোলে নিতে গিয়ে দেখি, তুহিন ভাই। এমন সময় বেজে উঠলো ভৌতিক মিউজিক। চোখ মেলে দেখি সকাল ছয়টা বেজে গেছে। পাশে শুয়ে আমার ষোল বছরের ছেলে। সেই যে ঘুমিয়েছি জ্বর নিয়ে, উঠে দেখি, চল্লিশটা বছর কেটে গেছে একঘুমে।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মাদারীপুরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
মাদারীপুরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা
বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা   
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা  
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন