X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

দিনমজুরের সঞ্চয়ে গড়া গ্রাম পাঠাগার 'সাতভিটা গ্রন্থনীড়'

আরিফুল ইসলাম, কুড়িগ্রাম
০৩ মার্চ ২০২১, ১৫:০০আপডেট : ০৩ মার্চ ২০২১, ১৯:৫৯

পেশায় দিনমজুর জয়নাল আলী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় প্রাথমিকের গণ্ডি পেরুতে পারেননি। আর্থিক অনটনে বিদ্যালয় ছেড়ে শ্রম বিক্রি করে সংসারের হাল ধরেন সেই শিশু বয়সেই। কিন্তু পড়াশোনার প্রতি আগ্রহে ভাটা পড়েনি তাতে। নিজের প্রচেষ্টায় বই পড়ে পড়ে স্বশিক্ষিত হন তিনি। আর শিক্ষা ও বইয়ের প্রতি এই আগ্রহ ও ভালোবাসা থেকে গ্রামের ছেলেমেয়েদের জন্য তিনি তৈরি করেছেন গ্রাম পাঠাগার ‘সাতভিটা গ্রন্থনীড়'।

গ্রাম পাঠাগারের উদ্যোক্তা জয়নালের বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের সাতভিটা গ্রামে। ওই গ্রামের মৃত কাশেম আলীর ছেলে। জেলা শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে প্রত্যন্ত এই গ্রামে ২০১৫ সালে শ’খানেক বই নিয়ে নিজ বাড়িতে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন জয়নাল। শুরুটা বন্ধুর হলেও প্রত্যন্ত একটি অঞ্চলে পাঠাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়ায় প্রশংসা কুড়াচ্ছেন দিনমজুর উদ্যোক্তা জয়নাল আলী।

'বইয়ের প্রতি ভালোবাসা আর গ্রামের শিশু কিশোরসহ সব শ্রেণির মানুষের জন্য বুদ্ধিভিত্তিক জ্ঞান চর্চার সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই পাঠাগার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি', বলেন জয়নাল।

জয়নাল আলী জয়নাল জানান, তিনি পেশায় মূলত দিনমজুর। এছাড়াও মৌসুমভিত্তিক ধান ব্যবসাও করেন তিনি। ধানের মৌসুম ছাড়া বাকি সময় দিনমজুরের কাজ করে চলে সংসার। পারিবারিক অভাব অনটনে প্রাথমিকের গন্ডিও পার হতে পারেননি। কিন্তু এরপরও শিক্ষা থেকে দূরে থাকেননি তিনি। নিজে বই পড়ে পড়ে স্বশিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি উদ্যোগ নেন নিজ এলাকায় পাঠাগার গড়ে তোলার। অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে আজ সফলতার আলো ফুটেছে তার 'সাতভিটা গ্রন্থনীড়' পাঠাগারে।

পাঠাগার প্রতিষ্ঠার শুরুর গল্প বলতে গিয়ে জয়নাল আলী জানান, দিনমজুরের কাজ করে রোজগারের টাকার কিছু কিছু জমিয়ে ২০১৫ সালের দিকে প্রায় ১০০ বই নিয়ে নিজ বাড়িতে গড়ে তোলেন তার শখের পাঠাগার। গ্রাম অঞ্চলে পাঠক জোগাড় করতে ছুটতে হয়েছিল শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি। বই পড়ার আগ্রহ তৈরি করতে কখনও কখনও শিক্ষার্থীদের বাড়ি গিয়ে বই সরবরাহ করতে হতো বলেও জানান তিনি। বর্তমানে জয়নালের গ্রন্থনীড় পাঠাগার পাঁচ শতাধিক বইয়ে সমৃদ্ধ।

বসতবাড়ি থেকে বর্তমানে নতুন কেনা জমিতে নতুন ঘরে পাঠাগার স্থানান্তরিত করেছেন জয়নাল। সম্পূর্ণ নিরিবিলি পরিবেশে পাঠকরা যাতে আলাদা পরিবেশে বই পড়তে পারেন সেজন্য এই উদ্যোগ।

জয়নাল আলীর পাঠাগার 'ধীরে ধীরে পাঠক সংখ্যা বাড়তে থাকলে ২০১৯ সালে নিজের জমানো টাকা দিয়ে এক শতক জমি কিনে সেখানে টিনের ঘর নির্মাণের পরিকল্পনা নেই। অর্থনৈতিক সমস্যা থাকলেও স্বপ্ন বাস্তবায়নে ধীরে ধীরে এগুতে থাকি। এক শতক জমি, পাঠাগারের ঘর ও আসবাবপত্র নির্মাণে প্রায় ৮০ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়েছে যার সবটাই আমার দিনমজুরি করে আয়ের জমানো টাকায় করা। আজ আমার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। পাঠকরা এখন আরও স্বাচ্ছন্দ্যে বই পড়তে পারবেন।' বলেন জয়নাল।

জয়নালের পাঠাগারে বই পড়ে উপকৃত হচ্ছেন গ্রামের শিক্ষার্থী ও শিশু কিশোররা। তারা জয়নালের এমন উদ্যোগে অনুপ্রাণিত।

স্থানীয় যুবক পলাশ চন্দ্র সরকার বলেন, ‘প্রায় চার মাস থেকে আমি এই পাঠাগারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমরা অত্যন্ত গর্বিত যে জয়নাল ভাইয়ের মতো বইপ্রেমী যুবক আমাদের গ্রামে আছে।'

সাতভিটা বিশেষ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী ও পাঠাগারের পাঠক আম্বিয়া আক্তার মিম বলেন, ‘আমরা স্কুলের বই পড়ার পাশাপাশি অনেক ধরনের বই পড়তে পারছি। জয়নাল ভাই আমাদের বাড়ি থেকে ডেকে এনে বই পড়ান।'

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিকালে জয়নালের স্বপ্ননীড় পাঠাগারের নতুন ভবন উদ্বোধন ও সেরা পাঠককে পুরস্কৃত করা হয়। সে উপলক্ষে জয়নালের উদ্যোগকে সমর্থন এবং তাকে অনুপ্রাণিত করতে জেলা শহর থেকে ছুটে যান শিক্ষক, লাইব্রেরিয়ান, সাংবাদিক ও সমাজকর্মীরা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বইয়ের প্রতি ভালোবাসার এই উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসার পাশাপাশি সার্বক্ষণিক পাশে থাকারও প্রতিশ্রুতি দেন অতিথিরা।

জয়নাল আলীর পাঠাগার পাঠাগার পরিদর্শনে যাওয়া অতিথি আখতারুল ইসলাম রাজু বলেন, অত্যন্ত আনন্দের বিষয় যে প্রত্যন্ত একটি গ্রামে এরকম একটি পাঠাগার তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বই পড়ার আন্দোলন এক ধাপ এগিয়ে গেলো।'

সমাজকর্মী সুব্রতা রায় বলেন, লাইব্রেরিগুলো গ্রামেই হওয়া উচিত। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে পড়াশোনা খুবই জরুরি। শিশু-কিশোরসহ শিক্ষার্থীরা বইকে বন্ধু করতে পারলে সমাজটাই পাল্টে যাবে।’

শিক্ষক ও সাংবাদিক আব্দুল ওয়াহেদ বলেন, ইন্টারনেটভিত্তিক পড়াশোনার থেকে পুস্তকভিত্তিক পড়াশোনার গুরুত্ব বেশি যা এই পাঠাগারে সম্ভব। জয়নালের এই উদ্যোগকে আমরা স্বানন্দ্যে স্বাগত জানাই।

জয়নাল আলীর পাঠাগার পরিদর্শনে যাওয়া কুড়িগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক সুশান্ত বর্মন বলেন, ‘আমাদের সব ধরনের আগ্রহ ও সহযোগিতা থাকবে এই পাঠাগারটিকে সমৃদ্ধ করার জন্য।'

'পাঠক পাঠাগারের প্রাণ। তাদের পাঠাগারে আনতে পারাটা একটা বড় অর্জন। জয়নাল বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাঠক সংগ্রহ করছেন যা এই উদ্যোগকে সফল করবে বলে আমি মনে করি।' যোগ করেন এই শিক্ষক।

জয়নালের পাঠাগার তার গ্রামসহ আশেপাশের গ্রামগুলোতে জ্ঞানের আলো ছড়াবে এই প্রত্যাশা সবার।

 

 

/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা