X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী

সংস্কৃতি দিয়ে মানুষকে উন্নত করতে চাই : সৈয়দ হাসান ইমাম

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : তুষার চন্দন
২৬ মার্চ ২০২১, ০০:৫৩আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২১, ০০:৫৩

সৈয়দ হাসান ইমাম একাধিক পরিচয় বহন করেন। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক, অভিনেতা, আবৃত্তিকার, পরিচালক এবং ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক। ছিলেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গেও। 

 

তুষার চন্দন : পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশকে আপনি কিভাবে দেখেছেন?
সৈয়দ হাসান ইমাম : বঙ্গবন্ধুর অনেক কথার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ হলো—“আমি কমিউনিস্ট নই কিন্তু আমি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি।’ সমাজতন্ত্র আর কমিউনিজম কিন্তু এক নয়। কমিউনিজমে ধর্মকে আফিম বলা হয় কিন্তু একজন ধর্মপালনকারীও সমাজতন্ত্রী হতে পারেন এবং বঙ্গবন্ধু তা-ই ছিলেন। তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। এখানে একটা জিনিস আমরা দেখি যে, আমাদের সবচেয়ে দুর্ভাগ্য—আমরা যখন স্বাধীন হলাম তারপরেই কিন্তু পৃথিবীর প্রেক্ষাপট বদলে গেল। আমাদের অক্ষে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল এবং যার জন্য আমরা সমাজতন্ত্রের কথা বলতে শিখেছিলাম। সেই দেশটি আর সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকল না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার ফলে তাদের যে আন্তর্জাতিকতাবাদ ছিল তা আর থাকল না; জাতীয়তাবাদী রাশিয়া হয়ে গেল। এর ফলে আমরা একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হারালাম। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বিরুদ্ধে ছিলো। হেনরি কিসিঞ্জার ‘Bottomless basket’ বলেছিলেন এ দেশকে এবং বাংলাদেশ হওয়ায় এটা তার পরাজয় হিসেবে নিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র ৭৪ সালে আমাদের দেশে দুর্ভিক্ষ করিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল যে, তারা কোনো দিন আমাদেরকে গ্রহণ করতে পারেনি; অন্তত বঙ্গবন্ধুকে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে।

বঙ্গবন্ধু অনেক কষ্ট করে দেশটাকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এজন্য তাকে অনেক কৌশল করতে হয়েছিল যেমনটি মুক্তিযুদ্ধে আসার জন্য অনেক কৌশল করতে হয়েছিল তেমনি অর্থনৈতিকভাবে দেশটাকে উন্নত করার জন্য অনেক কৌশল করতে হয়েছিলো। শুধু নীতিনিষ্ঠ হলেই হয় না, বাস্তব জ্ঞানও থাকতে হয়। বঙ্গবন্ধু যখন বাকশাল করেছিলেন তখন তাকে হত্যা করা হয়। বাকশাল করলেন কখন? যখন দেখলেন প্রতিবিপ্লবীরা এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আমাদের এই সমাজতন্ত্রের দেশকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে।

পাকিস্তানে যারা চলে গেছে তারা তো চলে গেছে কিন্তু দেশের মধ্যে তাদের অনেকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে; আমাদের বাড়ি-ঘরে, আমাদের প্রশাসনে। এভাবে ঘরে-বাইরে অনেক শত্রু হয়ে গেল। আর বঙ্গবন্ধুর হত্যাটাও ছিল একেবারেই পরিকল্পিত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যারা ক্ষমতায় এসেছিল তাদের কর্মকাণ্ডে আমরা দেখেছি পাকিস্তানের সাথে একত্রিকরণের পরিকল্পনা তাদের ছিলো।

অনেক নেতাকে বলতে শুনি—ঐক্য। এই ঐক্যের জন্য জিয়াউর রহমান জামায়াতে ইসলামী, গোলাম আযমকে নিয়ে আসলেন দেশে। ঐক্য করার জন্য জিয়া জামাতের সাথে জোট গঠন করলেন। ঐক্য কিসে হয়? মানুষে মানুষে? ঐক্য হয় নীতিতে নীতিতে। একজনের একরকম নীতি, অন্যজনের ভিন্ন নীতি—তাদের মধ্যে ঐক্য হতে পারে না। বিশেষ করে নীতি যদি সাংঘর্ষিক হয় তাহলে তো হতেই পারে না। যারা এখনো পাকিস্তানি নীতিতে বিশ্বাস করে আর তাদের সাথে ঐক্যের কথা যারা বলে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করে না। যদি নীতির পরিবর্তন হতো তাহলে এক কথা, যদি আমরা এক আদর্শে আসতে পারতাম সেখানে অবশ্যই ঐক্য করা যেত। আমাদের স্বাধীনতার চেতনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে ঐক্য কখনোই চাইনি, এখনো নয়।

আমাদের যে চার মূল নীতি সেই চার মূল নীতি বিসর্জন না দিয়ে আজকের যে পৃথিবী সেই পৃথিবীর সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলতে গিয়ে যে কৌশল সেটা সমর্থন না করলেও ওটা ছাড়া গত্যন্তর নেই। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই তাজউদ্দীন সাহেব বলেছিলেন—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশে দূতাবাস করতে দেয়া হবে না। এটা তো সম্ভব ছিল না। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে পৃথিবীর কোনো দেশ চালানো কঠিন কাজ। সোভিয়েত ইউনিয়নেও মার্কিন দূতাবাস ছিল, চীনেতেও আছে। অতএব, কৌশলগত কারণে সেখানে দূতাবাস করতে দিতে হয়েছে তাদের। যে কিসিঞ্জার বলেছিল—বাংলাদেশের জন্ম মানে আমার পরাজয়। ’৭৪ এর দুর্ভিক্ষের সময় খাদ্যের জাহাজগুলি যে ঘুরিয়ে নিয়ে গেল বন্দরের কাছ থেকে সেই দেশের সাথে আমাদের সম্পর্ক রাখতে হচ্ছে। আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য তাদের সাথে আছে। গার্মেন্টস রপ্তানির বেশিরভাগ তাদের দেশে যায়, ইউরোপে যায় যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিরোধিতা করেছিল।


তুষার চন্দন : সাংস্কৃতিক পরিবর্তনগুলো যে দিনের পর দিন এ দেশে হয়েছে, সে পরিবর্তনগুলো কতটুকু মানবিক এবং উন্নত সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে? সংস্কৃতির বিবর্তনে আমরা কোনদিকে যাচ্ছি?
সৈয়দ হাসান ইমাম : সংস্কৃতি বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর একটি পরিষ্কার ধারণা ছিল। তিনি দেশজ সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান থাকাকালীন আমি ১৯৫৭ সালে দেশে ফিরলাম পড়াশুনা শেষ করে, আমার মামাবাড়ি থেকে। আমি বর্ধমানে পড়াশুনা করেছি। আমি যখন ঢাকায় আসি তখন বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী। তার বন্ধু ছিলেন নূরুল আলম, এ কে মাজহার প্রমুখ। বঙ্গবন্ধু নূরুল আলমকে সাধারণ সম্পাদক এবং এ কে মাজহারকে সভাপতি করে একটি সংগঠন গড়ে তুললেন। এর উদ্দেশ্য ছিলো—সারা বাংলাদেশে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটানো। একদম এই কথাটিই বলেছিলেন প্রথম মিটিংয়ে বঙ্গবন্ধু। আমি সেখানে ছিলাম। এটা ছিল ৫৭ সালে আইয়ুব খানের মার্শাল ল-এর কিছুদিন আগে। আমাদের একটি মিটিংয়ে বঙ্গবন্ধু যিনি ছিলেন প্রধান পৃষ্ঠপোষক বক্তব্য দিলেন—দেশে একটি সাংকৃতিক বিপ্লব ঘটাতে হবে, সারা দেশে এর শাখা গড়ে তুলতে হবে। বাংলার সংস্কৃতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ভাষা—এগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে। আমাদের এতদিনের সংস্কৃতিকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। এ শব্দগুলো হয়তো ব্যাবহার করেননি কিন্তু এ রকম কথাই তিনি বলেছিলেন। এ কথা থেকে বোঝা যায়—তিনি সংস্কৃতিকে কতটা গুরুত্ব দিতেন। এবং দেশ যখন স্বাধীন হলো তখন আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শিল্পকলা একাডেমির অনেক কাজ করার। তিনি সংস্কৃতির বিকাশ এবং প্রকাশে দেশব্যাপী কাজ করার তাগিদ দিলেন—বাঙালি সংস্কৃতির উন্নয়ন হবে, বাংলা ভাষার উন্নয়ন হবে। গঠনতন্ত্রেও সেরকম ছিল—শিল্পের কারিগরি দিকের উন্নয়ন, মানের উন্নয়ন এবং তার প্রসার।

তিনি তাঁর স্বপ্নের মতো করে কাজগুলো করে যেতে পারেননি। ৭৫-এর পর সব শিল্পকলা একাডেমি সরকারিকরণ করা হলো। আমি একটি গঠনতন্ত্র তৈরি করেছিলাম। একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। আলী আহসান সাহেব সভাপতি ছিলেন। কামরুল ভাই, সানজিদা খাতুন, কবির চৌধুরী তখন বাংলা একাডেমির ডিজি ছিলেন এবং আমি। আমরা সদস্য। কামাল সিদ্দিকী সদস্য সচিব। সে তখন ডেপুটি সেক্রেটারি কালচারাল মিনিস্ট্রির। এভাবে একটি কমিটি গঠন করা হলো। তখন আমরা কামাল সিদ্দিকীর বাড়িতে রাতের পর রাত সময় দিয়ে কামাল সিদ্দিকীর সাথে গঠনতন্ত্র তৈরি করলাম। সেই গঠনতন্ত্রে আমরা শিল্পকলা একাডেমিকে স্বায়ত্বশাসিত রেখেছিলাম। কিন্তু জিয়াউর রহমান সাহেব এসে এটাকে সরকারি দপ্তর বানালেন এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে দিয়ে দিলেন। বঙ্গবন্ধু যে উদ্দেশ্যে শিল্পকলা একাডেমি করেছিলেন যে, সারা দেশে শিল্পের প্রসার এবং বিপ্লব। এটা এখন আর তেমনটি নেই। এখন শুধু প্রশিক্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর যে কার্যকারিতা—সমাজকে পরিবর্তন এবং রাজনীতিকে প্রভাবিত করার যে উদ্দেশ্য সে উদ্দেশ্য শিল্পকলা একাডেমি এখন আর পালন করে না। কিন্তু এটাই বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা ছিল।

ইংরেজি শেখা আর বাংলা ভোলা—এ দুটো একসাথে হওয়া তো দরকার নেই। আমাদেরকে ইংরেজিও শিখতে হবে, বাংলাকেও শিখতে হবে। দুটোই সঠিকভাবে শিখতে হবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি—বাংলায় যত শব্দ আছে তা আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বাংলা শব্দের জায়গায় ইংরেজি শব্দ ঢুকে যাচ্ছে আর বোম্বে সিনেমার প্রভাবে হিন্দি শব্দ ঢুকে যাচ্ছে। শুধু ক্রিয়াপদটা বাংলা থাকছে। এটা জগাখিচুড়ি বাংলা। এ বাংলা তো আমরা চাইনি। আমরা সব সময় চেয়েছি যে, আমরা শুদ্ধ বাংলা চর্চা করব, বাংলার উন্নয়ন করব। বাংলা একাডেমি করা হয়েছে এবং সেখানে নতুন শব্দ যেগুলো আসছে—যেগুলো বাংলায় নাই সেগুলো অবশ্যই আমরা বাংলায় গ্রহণ করব, চিরকালই আমরা সেভাবে গ্রহণ করেছি। এভাবেই ভাষা সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু যে ভাষা এবং শব্দ বাংলা ভাষায় আছে তা বিলুপ্ত করে বিদেশি শব্দ গ্রহণ করব তা তো প্রয়োজন নেই। অত্যন্ত সুন্দর সুন্দর শব্দ আছে আমাদের। রবীন্দ্রনাথ যতদিন বেঁচে ছিলেন সে সময় অনেক নতুন জিনিস এসেছে যেগুলি শব্দবন্ধ দিয়ে তিনি একটা সুন্দর নতুন শব্দ তৈরি করেছিলেন। যেমন—যখন রেডিও এলো সহজেই রেডিওটা গ্রহণ করে নেয়া যেত বাংলায় কিন্তু উনি সেটা করেননি। উনি এর নাম দিলেন আকাশবাণী। কী সুন্দর কাব্যিক নাম! প্রতিভাবান মানুষ থাকলে নতুন শব্দ আসলেও তা নিজের ভাষায় রূপান্তর করে নিতে পারেন, তৈরি করতে পারেন প্রতিশব্দ।

আমাদের যে মাটির সংস্কৃতি—সে সংস্কৃতি থেকে যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই তাহলে আমাদের আত্মপরিচয়ই আমরা ভুলে যাই, হারিয়ে ফেলি। সেজন্য আমাদের যে মাটির সংস্কৃতি এটাকে আধুনিকায়ন করতে হবে আবার আদিরূপটাও রাখতে হবে। আধুনিকের সাথে আদিরূপের যোগসূত্র স্থাপন করতে হবে। এবং বিদেশি সংস্কৃতি নেয়ার ব্যাপারে আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে, একটু সংযত হতে হবে। যেমন আমরা ব্যান্ড সঙ্গীত নিয়েছি। কিছু কিছু ভালো কাজ হয়েছে, সুন্দর সুন্দর দেশাত্মবোধক গানও হয়েছে, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার গানও হয়েছে। আর একটি কথা, পশ্চিমবঙ্গে যে ব্যান্ড সংগীত আগে এসেছে পরে তারা আমাদেরকে অনুসরণ করেছে। এটা একটা বিরাট ব্যাপার। তাই বলছি—ব্যান্ড সঙ্গীত আমরা নিতে পারি মানুষের মনকে উন্নত করার জন্য, উন্মত্ত করার জন্য নয়। আমরা সংস্কৃতি দিয়ে মানুষকে উন্মত্ত নয়, উন্নত করতে চাই।


তুষার চন্দন : সম্প্রতি সময়ে শিক্ষার সিলেবাসে বেশ একটা পরিবর্তন এসেছে। প্রগিতিশীল অনেক লেখকদের লেখা বাদ দেয়া হয়েছে। সেটা করা হয়েছে কোনো একটি গোষ্ঠীকে খুশি করার জন্য। এ ব্যাপারটিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
সৈয়দ হাসান ইমাম : আমার মনে হয় এটা অবশ্যই উচিত হয়নি। আবার এটাকে সংশোধন করা দরকার। একবার করে ফেললে সেটা সংশোধন করা দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। এই পরিবর্তন করার আগে আরো অনেক দিক ভাবা উচিত ছিল। আমি যে বলেছি পরিস্থিতির কারণে যে কৌশল করা হয় এটা সেটার ব্যাপারও না। এটা আত্মসমর্পণ। সেই আত্মসমর্পণ করা উচিত হয়নি।


তুষার চন্দন : গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলন আপনি দেখেছেন। আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদেরকে একটু জানান—আমরা যারা সাংস্কৃতিক আন্দোলন করছি তারা কতটুকু ভূমিকা পালন করছি এ সময়ে সমাজকে একটি উন্নত জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য?
সৈয়দ হাসান ইমাম : আমি বলেছিলাম—কৌশলটা আমি নেব কিন্তু কর্তৃত্বটা আমার থাকবে। কৌশল নিতে গিয়ে যদি আমার হাত থেকে কর্তৃত্ব বের হয়ে যায় তাহলে তো সেটা কৌশল হলো না, আমার নিয়ন্ত্রণে থাকল না। আমাদের সংস্কৃতিকর্মী আছে, আমাদের সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে, সাংস্কৃতিক জোট আছে—এরা সবাই কাজ করছে। তবে এটা তো ঠিক যে আমাদের শত্রুপক্ষ বেশ তৎপর। সব সময়ই তারা কোনো একটা ইস্যু ব্যবহার করতে চায়, যেকোনো ইস্যুকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে চায়। সেজন্য অত্যন্ত সচেতন থাকতে হয় আমাদেরকে। এমন একটা ঘটনা ঘটে না যায় একেবারে দান উল্টে যায়। এমন একটি জায়গায় যেন আমরা না নিয়ে যাই। আমরা বর্তমান শাসক দলকে সংশোধিত করতে চাই কিন্তু তাদেরকে উৎখাত করতে চাই না। উৎখাত করলে পরবর্তীতে যে শক্তি এখানে আসার সম্ভাবনা সেটা একেবারেই ফ্যাসিস্ট শক্তি।


তুষার চন্দন : পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশে শিল্পকলার চর্চার মাধ্যমে যে সাংস্কৃতিক আবহ সারা দেশের নগর, গ্রামে যেভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যেত তা সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো এবং সরকার কতটুকু করেছে? আপনার দেখা এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের গতিপথ সম্পর্কে জানতে চাই।
সৈয়দ হাসান ইমাম : প্রথম কথা হলো—শিল্পচর্চা যারা করছেন তারা শিল্পী হতে চান। রাজনৈতিক বক্তব্য রাজনৈতিক দল থেকেই আসবে। কিন্তু শিল্পের যে কর্মকাণ্ড—শিল্পীর কণ্ঠে যদি সুর না থাকে, যদি হাতে সুর না থাকে, মাথায় সুর না থাকে, যদি অভিনয় করতে না পারে তাহলে কাজটি কেউ দেখবে না এবং তাতে শিল্পের উন্নতি হবে না, সংস্কৃতিরও উন্নতি হবে না। আমার প্রথম কাজ হবে শিল্পের চর্চা করে আমাকে শিল্পী হতে হবে। এটা একটা প্রাথমিক কাজ। যেমন আমাকে যদি সাহিত্যিক হতে হয় তাহলে আমাকে ভাষাজ্ঞান থাকতে হবে তেমনি শিল্পী হতে হলে আমাকে শিল্পের জ্ঞান থাকতে হবে। আমাদের অসুবিধাটা হচ্ছে—শিল্পীর চেয়ে শিল্প সংগঠক বেশি। রাজনৈতিক বক্তব্য গানের মাধ্যমে বলে দিলে তো হয় না, বক্তৃতা দিলেই তো হয়। কিন্তু শিল্পী যখন সেটা করবে তখন শিল্পের ভাষায় হতে হবে এবং সেটা শিল্পমানসম্পন্ন হতে হবে। এটা সব শিল্পসংগঠনের নেই। আবার অনেক আগের দিনের গান দিয়ে আজকের দিনের কথা বলা যাবে না। কারণ প্রেক্ষাপট ভিন্ন। সেই সময়টা ছিল আলাদা। আজও যদি গণনাট্যের গান দিয়ে আজকের দিনের সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার বলে চালাতে চাই তাহলে চলবে না, রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে চাই তাহলে সেটা চলবে না। আজকে নতুন কথা, নতুন সুর, নতুন বাস্তবতা, নতুন সমস্যা, নতুন সংকট—এগুলো নিয়ে গান তৈরি করতে হবে, নাটক লিখতে হবে, কবিতা লিখতে হবে এবং সেরকম আবৃত্তি করতে হবে। আমাদেরকে পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গী হতে হবে। এখনো যদি বলি ‘রানার ছুটেছে ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে...’ তাহলে কি হবে? রানার কি এখন আছে? তাই আজকের দিনের সমস্যা, সংকট নিয়ে শিল্পিতভাবে এবং শিল্পীদের দিয়ে উপস্থাপন করতে হবে। আর চেতনার ব্যাপারে আমাদের ঐক্যমত থাকতে হবে। আমাদের চার মূলনীতি আছে, আমাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে। সেটার সাথে সাংঘর্ষিক যে সংস্কৃতি সে সংস্কৃতিকে বর্জন করতে হবে। এটা একটা মোটাদাগের বিষয়।

আমার মনে হয় , আমাদের যে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো আছে যেমন এই উদীচী যখন সত্যেন দা করেছিলেন তখন সেটা স্বতন্ত্র সংগঠন ছিলো, যদিও আদর্শগতভাবে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত। তারপরও এটা স্বনিয়ন্ত্রিত। তেমনি আওয়ামী লীগেরও সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে কিন্তু আমি রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুরোধ করব যে, আপনারা এটাকে নিয়ন্ত্রণ করবেন না। শিল্পীদের হাতে ছেড়ে দেন। আদর্শের মিল আছে যাদের সাথে তাদেরকে যুক্ত করুন সংগঠনটির সাথে এবং তারপর তাদের কাছে ছেড়ে দিন। তারাই এটাকে চালাবে।


তুষার চন্দন : অনেকেই বলে থাকেন, অবকাঠামোগতভাবে দেশের অনেক উন্নয়ন হয়েছে এবং হচ্ছে, এবং পরিকল্পনাগুলোও সেরকম আছে কিন্তু শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে আমরা সভ্যতার কোন স্তরে আছি?
সৈয়দ হাসান ইমাম : সভ্যতার সংকট আমি বলব না। যেটা আছে সেটা হলো প্রশাসনিক সংকট। প্রশাসন এবং সমাজ। সেখানে যেহেতু বিত্তের ছড়াছড়ি হয়েছে; কেউ কেউ অতি ধনী হয়েছেন। সাধারণ মানুষের উন্নয়ন হয়েছে তবে যে পরিমাণ হওয়ার কথা ছিল সে পরিমাণ হয়নি। অতি ধনী অনেকে হয়ে গেছেন। এবং তাদের অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন সমাজকে কলুষিত করছে। দেশের অবস্থা যা তার থেকে অনেক বেশি আরাম-আয়েশ প্রদর্শন করছেন। সাধারণ মানুষ প্রলুব্ধ হয়ে সেদিকে যাওয়ার জন্য অসৎ পথে টাকা রোজগার করার চেষ্টা করছে। এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অন্যদিকে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। শুধু পাঠ্যপুস্তক হলেই হবে না, ভালো শিক্ষক তৈরি করতে হবে। শিক্ষকদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে ভালোভাবে। আমি ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থীদের একটি কর্মশালা করাতে গিয়ে দেখলাম—তারা আমাদের ইহিহাস জানে না। আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য জানে না। ফলে একটা অসম্পূর্ণতা থেকেই যাচ্ছে। এজন্য পরিপূর্ণ একজন মানুষ গড়ার শিক্ষা থাকতে হবে। যিনি শিক্ষক হবেন তাকে সম্পূর্ণ মানুষ হতে হবে যাতে তিনি শিক্ষার্থীদের সম্পূর্ণ মানুষ গড়তে সহায়ক হন।


তুষার চন্দন : আমাদের অনেক সমস্যা, সংকট আছে। আবার আছে অর্জন, সম্ভাবনাও। সামনের দিনগুলো কেমন হবে?
সৈয়দ হাসান ইমাম : আমাদের সম্ভাবনা হলো নতুন প্রজন্ম। নতুন প্রজন্ম খুবই প্রতিভাবান। তারা অনেক বেশি পৃথিবীকে দেখতে পাচ্ছে সহজে; হাতের মুঠোর মধ্যে দেখতে পাচ্ছে। আমি শুধু তাদেরকে বলব তোমাদের দৃষ্টিটা পশ্চিমের দিকে না রেখে দেশের দিকে তাকাও, দেশের মানুষকে জানো। আমরা যতটা ইউরোপ-আমেরিকাকে জানি ততটা আমাদের গ্রামকে জানি না। যারা প্রশাসনের বড় বড় জায়গায় বসে আছেন, যারা দেশ চালাচ্ছেন তাদের অনেকের সাথেই এখন আর গ্রামের তেমন যোগাযোগ নেই এবং দেশটাকে অতটা জানেন না। দেশটাকে জানতে হবে, দেশের মানুষকে জানতে হবে এবং তাদেরকে ভালোবাসতে হবে। রাজনীতি আর শিল্পের সমন্বয় করে মানুষের কাছে উপস্থাপন করলেই তো একটা সুন্দর সংস্কৃতি গড়ে ওঠে যা মাটির সংস্কৃতি।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ