X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীরা যা বললেন

হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
২৬ মার্চ ২০২১, ২৩:২৫আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২১, ২৩:৫০

সুযোগ পেলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে বিতর্কের অপচেষ্টা চালায় একটি মহল। বাস্তবে কী ঘটেছিল সেদিন? কী করে দিকে দিকে পৌঁছেছিল সেই ঘোষণাপত্র? কারা ছিলেন সম্প্রচার কক্ষে? বিশেষ করে ঘোষণার আগের মুহূর্তগুলো কেমন উত্তেজনায় কেটেছিল? কারা ছিলেন সাক্ষী? বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্ট চট্টগ্রামের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান তাঁর ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ বইটিতে সেটাই তুলে আনার চেষ্টা করেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে।

এ নিয়ে ডা. মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে আলাপ হয় বাংলা ট্রিবিউনের। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আছেন এমন যারা দাবি করেন, তাদের মধ্যেও অনেকে কিন্তু এই ঘোষণার আদ্যপান্ত নিয়ে বিভ্রান্তিতে আছেন। যা তাদের লেখা বইগুলোতেও দেখা যায়। নিরপেক্ষ একটা জায়গা থেকে আমার বইতে বিষয়টি তুলে আনার চেষ্টা করেছি। এতে সংশ্লিষ্ট অনেকের বক্তব্য আনা হয়েছে। আশা করি বইটি স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত বিভ্রান্তির অবসান ঘটাবে।’

স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে ডা. মাহফুজুর রহমান লেখেন, '১৯৭১ সালে মগবাজার ওয়ারলেস কেন্দ্রে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন মো. আব্দুল কাইয়ুম। আব্দুল কাইয়ুম তার এক লেখায় জানান, ২৫ মার্চ রাত ৯টার দিকে সেনা চলাচল দেখে বিবাহিত স্টাফদের বাসায় চলে যেতে বলেন তিনি। এক অবিবাহিত স্টাফকে নিয়ে তিনি ওয়ারলেস স্টেশনে থাকেন। কিছুক্ষণ পর তিনিও বাসায় চলে যান। অবস্থা বেগতিক মনে হলে ওই স্টাফকেও চলে যেতে বলেন।’

আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘ভোর ৪-৫টার দিকে অফিসে ফেলে আসা চাদর আনতে গিয়ে সাদা ফুলস্কেপ কাগজ হাতে এক লোককে দেখেন আমার অপারেটর। কাগজটি নিয়ে অপারেটর এলেন আমার কাছে। বললেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি মেসেজ পাঠিয়েছেন। বিভিন্ন জায়গায় এটা পাঠানো যাবে কিনা? লোকটা কে তা দেখার জন্য মেসেজটা হাতে নিয়ে অপারেটরের সঙ্গে অফিসে গেলাম। অফিসে লোকটিকে আর দেখা গেল না। যে লোকটি আমার সহকর্মীকে মেসেজটি দিয়ে যান তিনি সহকর্মীকে বলে গিয়েছিলেন, সম্ভব হলে আওয়ামী লীগ নেতাসহ দেশের সব স্থানে মেসেজটি পাঠাতে। আমি ও সেই সহকর্মী সকাল ৬টার দিকে ওয়ারলেসের মাধ্যমে মেসেজটি চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন ওয়ারলেস কেন্দ্রে পাঠাই।’

১৯৭১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান টিঅ্যান্ডটিতে ইঞ্জিনিয়ারিং সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ। আব্দুল কাইয়ুম যে সহকর্মীর নাম বলতে পারেননি ইনিই সেই সহকর্মী।

সাদা ফুলস্কেপ কাগজ হাতে এক লোককে দেখেন আমার অপারেটর। কাগজটি নিয়ে অপারেটর এলেন আমার কাছে। বললেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি মেসেজ পাঠিয়েছেন।

মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘২৫ মার্চ রাত ৮টা থেকে ওয়ারলেস স্টেশনে আমার ডিউটি ছিল। ডিউটিতে যাওয়ার সময় আমি উত্তেজিত ছিলাম, কারণ ঢাকায় একটি গুজব তখন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে যে, আজ রাতেই কোনও বড় ঘটনা ঘটতে পারে। অফিসে যাওয়ার পথে রাস্তায় ব্যারিকেড ও লোকজনকে উত্তেজিত অবস্থায় দেখতে পাই। রাত দশটার পর থেকে ঢাকার খবর জানার জন্য কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থান থেকে সার্ভিস চ্যানেলে ও ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্রমাগত টেলিফোন পেতে থাকি। রাত আনুমানিক ১২টায় ভারী গোলাগুলির শব্দ শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। ট্যাংক ও মেশিনগানের শব্দ শুনি। অফিসে থাকাটা নিরাপদ হবে না ভেবে বাসায় চলে আসি। সকালে আমার বাসার সামনে ফিরোজ কবির, কালাম সাহেব, খালেক সাহেবসহ কয়েকজন দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। এমন সময় আব্বাস নামের এক পরিচিত রিকসাওয়ালা একটি কাগজ আমার হাতে দেয়। কাগজটিতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার কথা লেখা দেখে আমার অন্তরে হাজার আলোর এক ঝলকানি দিয়ে যায়।

ভাবলাম, বঙ্গবন্ধু তাহলে শত্রুর হাতে বন্দি হননি। তিনি নিরাপদে আছেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। আমি আব্বাসকে কাগজটি কোথায় পেয়েছে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, সে এলাকার অবস্থা জানার জন্য যখন মেইন রোডে দিয়ে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ একজন লোক সাইকেলে এসে কাগজটি তাকে দিয়ে যায় এবং বলে, "ওয়ারলেসে চাকরি করে এমন কাউকে কাগজটি দিও"।

“কাগজটি আমরা সবাই দেখি। কামাল সাহেব আমাকে স্বাধীনতার বাণীটি ওয়ারলেসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো যায় কিনা তা ভেবে দেখতে বললেন। সঙ্গে সঙ্গে এটা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিই। লেখাটি ছিল বাংলায়। প্রথমে ওটা ইংরেজিতে অনুবাদ করি। কারণ তখনকার দিনে টিঅ্যান্ডটি অফিসের যাবতীয় মেসেজ ইংরেজিতে পাঠানোর রেওয়াজ ছিল।"

তিনি বলেন, "বিদেশে পাঠানোর জন্য ‘মোর্স কোড’ ব্যবহার করতে হতো যা ইংরেজি ছাড়া সম্ভব ছিল না। মূল মেসেজটি ছিল, 'গত মধ্যরাতে দুর্বৃত্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ট্যাংক, মেশিনগান ও অন্যান্য ভারী অস্ত্রশস্ত্র সহযোগে পিলখানার ইপিআর সদরদফতর ও রাজারবাগের পুলিশ ভবনে অতর্কিতে হামলা পরিচালনা করে এবং শত-সহস্র নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করে। ঢাকাবাসী অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় শত্রু সেনাদের মোকাবিলা করিয়া যাচ্ছে।..এতদ্বারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হইল। প্রিয় দেশবাসী, আপনারা দেশের প্রতিটি অঞ্চলে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়ুন। আমাদের সংগ্রামে বিশ্বের প্রতিটি শান্তিপ্রিয় নাগরিকের সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করি। খোদা আপনাদের সহায় হোক। জয় বাংলা।”

তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এম আর সিদ্দিকি বলেন, ‘২৬ মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা পেয়ে দ্রুত সে বার্তা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের কাছে পৌঁছানো হয়। সংগ্রাম পরিষদের নেতারা বৈঠক করে বার্তাটি বেতারে প্রচারের সিদ্ধান্ত নেন। এরপর বেতার চালুর প্রক্রিয়া শুরু হয়। এম এ হান্নান ভাষণটি পড়েন এবং ডা. জাফরসহ অনেকে তাকে সহায়তা দেন।’

তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান বলেন, ‘২৬ মার্চ খুব ভোরে আমি, আতাউর রহমান খান কায়সার ও এম এ মান্নান সেনানিবাসের দিকে যাওয়ার পথে পাঁচলাইশ থানার সামনে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের দেখা পাই। তাদের কাছ থেকে জানি মেজর জিয়া কালুরঘাটের দিকে গেছেন। আমরা বোয়ালখালী করলডেঙ্গা পাহাড়ের কাছে জিয়ার দেখা পাই। তাকে শহরে সেনা শিবির স্থাপন করতে বলি। তিনি ২৭ মার্চ শহরে আসবেন বলে জানান। আমাদের শহরে আসার পর সিদ্ধান্ত হয় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র চালু করার। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করি। আমাকে সহযোগিতা করেন রাখাল চন্দ্র বণিক, মীর্জা আবু মনসুর, আতাউর রহমান খান কায়সার, মোশারফ হোসেন এমপি। ২৭ মার্চ বিকালে মেজর জিয়া স্বাধীনতার একটি ঘোষণা পাঠ করেন। তার ঘোষণা নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। সেদিন রাতে আমি, মীর্জা মনসুর ও মোশারফ হোসেন ফটিকছড়িতে অবস্থানরত সাবেক মন্ত্রী এ কে খানের সঙ্গেসাক্ষাৎ করি। পুনর্ঘোষণার জন্য তিনি একটি খসড়া দেন। আমরা ফটিকছড়ি থেকে কালুরঘাট আসি। মেজর জিয়াকে সেই খসড়াটি দেই। ২৮ মার্চ সেই খসড়া ঘোষণা পড়েন জিয়া।’

তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ মান্নান বলেন, ‘২৬ মার্চ আমি হান্নান সাহেবের সঙ্গে পটিয়ায় যাই। সেখানে মেজর জিয়া, মেজর শওকত, ক্যাপ্টেন হারুন, ক্যাপ্টেন অলি, লে. মাহফুজ, লে. শমসের মবিনসহ জোয়ানদের দেখা পাই। মেজর জিয়াকে সৈন্যসহ শহরে আসতে অনুরোধ করি। পথে ঢাকা বেতার থেকে টিক্কা খানের ঘোষণা শুনি। শহরে আসার পর জুপিটার হাউজে সংগ্রাম পরিষদের এক বৈঠক হয়। সিদ্ধান্ত হয় বেতার চালু করার। সেই মোতাবেক জনাব হান্নান বেতারে যান ও ভাষণ দেন। ২৭ মার্চ বেতারে জিয়ার ভাষণ নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। ২৮ মার্চ জিয়া আবার বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন।’

ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘২৬ মার্চ বেলা ১২টার দিকে আওয়ামী লীগ অফিসে আসি। দেখা হয় এম এ হান্নান, কায়সার ভাই, রাখাল বণিক, বাঁশখালীর শাহ ই জাহানের সঙ্গে। হান্নান ভাইয়ের সঙ্গে আমি আগ্রাবাদ বেতারে যাই। ওখান থেকে কালুরঘাট বেতার। বেলা আনুমানিক দেড়টার দিকে বেতার চালু হয়। প্রথম ঘোষণা দেন রাখাল বণিক। এরপর হান্নান ভাই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন।’

তৎকালীন আগ্রাবাদ বেতার এলাকার বাসিন্দা শুল্ক বিভাগীয় কর্মকর্তা এম এ হালিম এক প্রতিবেদনে লেখেন, ‘২৬ মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধুর বেতার বার্তাটি আগ্রাবাদ সরকারি কলোনি অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি শফিউদ্দিন সাহেব মাইকে প্রচার করছিলেন এবং তাঁকে সহযোগিতা করছিলেন আমদানি-রফতানি দফতরের মোজাম্মেল সাহেব আগ্রাবাদ বেতারে। সেখানে কাউকে না পেয়ে যোগাযোগ করে হান্নান সাহেবের বাসায় যাই এবং বেতার চালু করার অনুরোধ করি। হান্নান সাহেব তাঁর লোকজনদের সঙ্গে আলাপ করে আগ্রাবাদ বেতারে যান। সেখানে কাউকে না পেয়ে বেতারের আঞ্চলিক প্রকৌশলী মীর্জা নাসিরুদ্দিনকে আনিয়ে নেন। মীর্জা নাসিরকে আনেন জনাব হালিম, ফজলুল হকসহ স্থানীয় কয়েকজন। মীর্জা নাসির হান্নান সাহেবকে নিয়ে যান কালুরঘাট কেন্দ্রে। সঙ্গে নেন রেডিও ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সোবহানকে। পথে চকবাজার থেকে তুলে নেওয়া হয় বেতার প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনকে। বেতারের লোকজনকে দেখে আনসার আমিনুর গেট খুলে দেন। সেখানে এম এ হান্নান, আতাউর রহমান খান কায়সার, ডা. এম এ মান্নান, শাহ ই জাহান চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ প্রমুখ মিলে রাখাল চন্দ্র বণিককে অনুষ্ঠান ঘোষক হিসেবে নির্বাচিত করেন। বেতার অন করা হলে প্রথম রাখাল বণিক ঘোষণা দেন, 'চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র, একটি বিশেষ ঘোষণা, একটু পরেই জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের বিপ্লবী সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান। আপনারা যারা রেডিও খুলে বসে আছেন তারা রেডিও বন্ধ করবেন না।' এরপর হান্নান ঘোষণাটি পাঠ করেন। ভাষণ দিয়ে হান্নান সাহেব আন্দরকিল্লাহ আওয়ামী লীগ অফিসে চলে আসেন।’

ক্যাপ্টেন রফিক (’৭১ সালে চট্টগ্রাম ইপিআর-এর অ্যাডজ্যুডেন্ট, যুদ্ধে ১ নং সেক্টর কমান্ডার) বলেন, ‘২৫ মার্চ রাত ১১.৪৫ মিনিটের মধ্যেই সন্তোষজনক সফলতা অর্জনের পর আমি ৮ ইস্ট বেঙ্গল এবং ইবিআরসি’র বাঙালি অফিসার ও সৈন্যদের অভিযানের খবর পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম।

সীমান্ত এলাকাসমূহ থেকে কখন আমার বাকি সৈন্যরা এসে পৌঁছাবে সেটা নিয়েও আমি যথেষ্ট উদগ্রীব। শহরে রেডিও স্টেশন এবং টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখল করার জন্য কিছু সৈন্য পাঠানো হয়েছিল আগেই।’ এই সৈন্যদের অবস্থান সম্পর্কে কোনও কিছু অবশ্য জানা যায়নি। তিনি আরও বলেন, ‘একজন লোক এসেছিল তার সাক্ষাৎকার টেপ করবে বলে। টেপ আনার কথা বলে তিনি চলে যান, আর ফিরে আসেননি।’

রাখাল চন্দ্র বণিক (১৯৭১ সালে উত্তর মহকুমা ছাত্রলীগের সভাপতি ও বিএলএফ যোদ্ধা) বলেন, ‘২৫ মার্চ রাতে আমরা খবর পাই, হানাদাররা আমাদের ওপর আক্রমণ করেছে। আমরা তখন আন্দরকিল্লাহ শাম্মী হোটেলে ছিলাম। ১২০ আন্দরকিল্লায় ছিল আওয়ামী লীগ অফিস। পেছনে ছিল ছাত্রলীগ অফিস। রাতেই আওয়ামী লীগ অফিসে আবুল কালাম আজাদসহ বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। ২৬ তারিখ সকালে আখতারুজ্জামান চৌধুরীর জুপিটার হাউজে বৈঠক বসে। সেখানে আমিও ছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘এই বৈঠকের আগেও ২৫ তারিখ রাত ৯টায় এম আর সিদ্দিকীর বাসভবনে এক সভা হয়েছিল। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ডা. এম এ মান্নান, জহুর আহমদ চৌধুরী, এম এ হান্নান, আতাউর রহমান খান কায়সার, মোশাররফ হোসেন, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদসহ বেশ কয়েকজন এমসিএ, এমপিএ। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এম আর সিদ্দিকির আলাপ হওয়ার পর নেতারা ওই বাসভবনকে নিরাপদ মনে না করে চলে আসেন ফিরিঙ্গি বাজারে জানে আলম দোভাষের বাসভবনে। সেখানেও বেতারের ব্যাপারে আলোচনা হয়। এরপরের বৈঠক বসে জুপিটার হাউজে। বৈঠক শেষে আতাউর রহমান খান কায়সারের জিপে এম এ হান্নান, মোশারফ হোসেন, ডা. এম এ মান্নান, আতাউর রহমান খান কায়সার, শাহ ই জাহান চৌধুরী, মীর্জা মনসুর ও আমি আগ্রাবাদ বেতার ভবনের দিকে রওনা হই। পথে রেস্ট হাউজের কাছে থেমে জিপ থেকে এম এ হান্নান নামেন ও জহুর আহমদ চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলে আবার ফেরত আসেন। আমরা আগ্রাবাদ বেতার ভবনে গিয়ে কাউকে না পেয়ে খোঁজ করে আঞ্চলিক প্রকৌশলী মীর্জা নাসিরউদ্দিন ও বেতার প্রকৌশলী সোবহানকে জোর করে গাড়িতে তুলে নেই ও কালুরঘাটের দিকে রওনা দেই। এই সময় আগ্রাবাদের এক লোক তার গাড়ি নিয়ে আমাদের সঙ্গে যায়। পথে চকবাজার থেকে এক বেতার প্রকৌশলীকেও তুলে নেওয়া হয়। দুপুর ১২ টার দিকে কালুরঘাট পৌঁছায়। এই সময়ে আবদুস শুক্কুর নামে এক বেতার টেকনিসিয়ান সেখানে পৌঁছেন। পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন কায়সার ভাই, মোশাররফ ভাই, শাহ ই জাহান ভাই ও মোহাম্মদ হোসেন মিলে। ঘোষণার দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। আমি শুরু করলাম, চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র, একটি বিশেষ ঘোষণা...। প্রথমে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র বলে শুরু করলেও পরে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র বলতে থাকি। ঘোষণাটি বেশ কয়েকবার বলি। জনাব হান্নান ভাষণটি বারবার পাঠ করেন।’

‘ঢাকাবাসী অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় শত্রু সেনাদের মোকাবিলা করিয়া যাচ্ছে।...এতদ্বারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হইল। প্রিয় দেশবাসী, আপনারা দেশের প্রতিটি অঞ্চলে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়ুন।’

বেগম মুশতারী শফি (চট্টগ্রামের নারী আন্দোলনের কর্মী, শহীদ ডা. শফির স্ত্রী , শহীদ খন্দকার এহসানের বোন ও মুক্তিযোদ্ধা) বলেন, “২৫ মার্চ ঘরে যেতে না পেরে ফটিকছড়ি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম সন্দীপ, বেতার কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল ফারুক, কাজী হাবিব উদ্দিন আমার বাসায় চলে আসেন। এরপর আসেন বেলাল মোহাম্মদ। সবাই আমার ঘনিষ্ঠ। আন্দোলন সংগ্রামে জড়িত থাকার কারণেই এই ঘনিষ্ঠতা। ২৬ মার্চ সকালে বেলাল রেডিওর কথা বললেন। সবাই আলোচনা করে বেরিয়ে গেলেন। বিকালে বেলাল ফোন করে রেডিও খোলা রাখতে বললেন। ৭.৪০ মিনিটে বেতার শুনি। এর মাঝে আবুল কাসেম, আবদুস সালাম, ফারুকের কণ্ঠ চিনতে পারি। ফারুক ইংরেজিতে সংবাদ পড়েছিলেন। নিজের নাম প্রকাশ না করে হান্নান সাহেব ভাষণ দেন। আমাকে বলা হলো ‘ভয়েস অব আমেরিকা’, ‘বিবিসি’, ‘রেডিও পিকিং’, ‘আকাশবাণী’ ইত্যাদি খোলা রেখে সেগুলো থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে রাখার জন্য। এইভাবে বেতারে সহযোগিতা করি ৩০ মার্চ পর্যন্ত। এর মাঝে ২৮ মার্চ আমার ছেলে এসে জানায়, সে শুনে এসেছে টিক্কা খান নিহত হয়েছেন (২৭ মার্চ সকালের অধিবেশনে এই সংবাদটি পাঠ করা হয়েছিল।)।”

বেলাল মোহাম্মদ (বেতার কর্মী ও সংগঠক) বলেন, “২৬ মার্চ সকালে সামরিক প্রশাসক প্রবর্তিত ঘোষণা প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে বেতারকর্মীরা বেতার ছেড়ে বেরিয়ে যান। এর পরের ঘটনাগুলো অসম্ভব ধরনের বিচিত্র ও বিক্ষিপ্ত।

২৬ মার্চ সকালে আমি ছিলাম এনায়েত বাজারে ডা. শফির বাসায়। একটা কিছু করতে হবে। বেগম মুশতারী শফি উৎসাহ দেন। আমি স্টেশন রোডে আওয়ামী লীগ অফিসে যাই। অধ্যাপক মমতাজউদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়। আওয়ামী লীগ অফিস থেকে তিনি একখানা জিপ চেয়ে নেন। ২টার দিকে ক্যাপ্টেন রফিকের দফতরে যাই। বেতার চালু করার কথা জানিয়ে তার কাছে নিরাপত্তা চাই। তিনি সৈন্য পাঠানোর আশ্বাস দেন। আমরা যাই মাহবুব হাসানের বাসায়।

এরপর যাই চকবাজারে দু’জন প্রকৌশলীর কাছে। তারা শর্ত দিলেন এমন পরিবেশ সৃষ্টি করার যাতে মনে হয়, তাদের জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওদের দু’জনকে সঙ্গে নিই। পরে মমতাজ সাহেব নেমে যান দুজন লোককে নিয়ে আসবেন বলে। মাহবুব হাসানসহ আমরা আগ্রাবাদ বেতারে পৌঁছায়।

মাহবুব হাসান আগ্রাবাদ বেতার অন করেন। প্রকৌশলীরা জানান তারা অনুষ্ঠান এয়ারে দিতে পারবেন না, কারণ আঞ্চলিক প্রকৌশলী অনুমতি দেননি। আমি আঞ্চলিক প্রকৌশলী ও এ আর ডি কাহহারকে টেলিফোন করি। এই সময় আসেন আবুল কাসেম সন্দীপ ও আবদুল্লাহ আল ফারুখ। এরপর আসেন চট্টগ্রাম বেতারের একজন নৈমিত্তিক ঘোষক ডা.সুলতান উল আলম। তাঁকে যুক্ত করা হয়। যোগ দিয়েছিলেন মেকানিক সৈয়দ আবদুস শুক্কুর। নাজমুল সাহেবের সঙ্গে আলাপ করে কাহহার সাহেব আমাদের কালুরঘাট যেতে বলেন। মাহবুব হাসানসহ অনেককে নিয়ে ডা.আনোয়ার আলীর গাড়িতে করে রওনা দেই। আমি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কপি পাই আগ্রাবাদ বেতারের সামনে ডা. আনোয়ার আলীর কাছ থেকে। সঙ্গে ছিলেন হোসনে আরা।

পথে মাহবুব হাসান জানান বেতারকর্মীদের বাধ্য করতে সৈন্যের প্রয়োজন হতে পারে। তিনি সৈন্য সংগ্রহ করতে নেমে যান আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে। আমরা কালুরঘাট বেতারে পৌঁছাই। ডা. আনোয়ার আলী পাশের ছাউনি থেকে সৈন্য আনেন।

এর মাঝে সুলতান আলী ফোন করে তাড়াতাড়ি প্রচার শুরু করতে বলেন, কারণ কিছুক্ষণ পর কোলকাতা বেতারের সংবাদ প্রচারিত হবে বলে তিনি জানান। প্রথম ঘোষণা দেন আবুল কাসেম সন্দীপ। সংবাদ পড়েন সুলতান উল আলম। এভাবেই শুরু হয় বেতারের দ্বিতীয় অধিবেশন।

কালুরঘাট বেতারে পাই জনাব হান্নান ও ডা. জাফরকে। আমি জানতাম না হান্নান সাহেব দুপুরে জনাব নাসির, সোবহান, দেলোয়ার ও মোসলেম খানের সহযোগিতা নিয়ে বেতার চালু করেছিলেন। নাসির সাহেব থেকে প্রথম তা জানি। এবার আমার অনুরোধে নিজের নাম প্রকাশ না করে হান্নান সাহেব আবার বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি পাঠ করেন।

প্রাকৌশলিক দায়িত্বে ছিলেন প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন, আবদুস সোবহান ও মেকানিক আবদুস শুক্কুর। উপদেশক ছিলেন অধ্যাপক মো. খালেদ, চট্টগ্রাম বেতারের বার্তা সম্পাদক সুলতান আলী। সার্বিকভবে সহায়তা দিয়েছেন সেকান্দর হায়াত খান ও হারুণ অর রশিদ খান। বেতারের নিয়মিত ঘোষক ফজলে হোসেন ও কাজী হোসনে আরা উপস্থিত থাকলেও তাদের সংবাদ পাঠের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। অনুষ্ঠান শেষে গাড়ি না পেয়ে আমি পায়ে হেঁটে এনায়েত বাজারে ফিরে আসি।"

বেলাল মোহাম্মদ আরও বলেন, "বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এই সংবাদটি ’৭১-এর ২৬ মার্চ সকালে চট্টগ্রাম বেতারের ডিউটি রুমে টেলিফোনে জানান হয়েছিল। তখন আগ্রাবাদ বেতারে ছিলেন হাফিজ আহমদ ও আবদুল হালিম সর্দার।  তিনি সলিমপুর থেকে খুব ভোরে আগ্রাবাদ বেতারে সংবাদটি জানিয়ে ছিলেন।”

বেলাল মোহাম্মদ বলেন, “২৭ মার্চ চন্দনপুরার তাহের সোবহান ফোনে আমাকে বলেন বেতার চালু রাখতে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার প্রয়োজন। তার পরামর্শে আমি ২৭ মার্চ মাহমুদ হোসেনকে নিয়ে সকালে পটিয়ায় গিয়ে মেজর জিয়ার সাক্ষাৎ পাই। মাহমুদ হোসেন ২৬ মার্চ রাতে কালুরঘাট থেকে একটি অনুষ্ঠান প্রচার করেছিলেন স্বকণ্ঠে। মেজর জিয়াকে বেতারের নিরাপত্তা দেওয়ার অনুরোধ জানালে তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হন ও আমাদের সঙ্গে কিছু সৈন্য পাঠিয়ে দেন। মেজর জিয়া নিজে আসেন বেলা আনুমানিক ৫টার দিকে। প্রচার ভবনের অফিসে ছিলাম আমরা তিনজন। মেজর জিয়া, ক্যাপ্টেন অলি ও আমি। মেজর জিয়াকে স্বকণ্ঠে কিছু বলার প্রস্তাব দিলে তিনি রাজি হন। অধ্যাপক মমতাজউদ্দিন আহমদও ছিলেন। তিনি ইংরেজি ঘোষণার বাংলা অনুবাদ করেন। আলোচনাক্রমে ঠিক করা ভাষণটি মেজর জিয়া স্বকণ্ঠে প্রথম ঘোষণা করেন।” তা হলো-“I Major Zia, on behalf of our great national leader Bangabandhu Sheik Mujibur Rahman, do hearly declare Independence of Bangladesh.”

 

/আইএ/এফএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া