X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

মহাবনের বানরের গল্প ।। ইনতেজার হুসেইন

অনুবাদ : সালেহ ফুয়াদ
৩০ এপ্রিল ২০২১, ১৫:০০আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০২১, ১৫:০০

[কথাসাহিত্যিক ইনতেজার হুসেইনকে তুলনা করা হয় প্রখ্যাত উর্দু ছোটগল্পকার সাদত হাসান মান্টোর সঙ্গে। কেউ কেউ তাকে মান্টোর চেয়েও শক্তিশালী গল্পকার বলে দাবি করেন। মান্টোপরবর্তী উর্দু ছোটগল্পের সবচেয়ে শক্তিমান স্রষ্টা ইনতেজার হুসেইন প্রথম কোনো পাকিস্তানি লেখক হিসেবে ম্যানবুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন। বিখ্যাত উপন্যাস ‘বাস্তি’-র জন্য ২০১৩ সালে ম্যানবুকার হ্রস্বতালিকার চতুর্থ নামটি ছিল তার। পৌরাণিক আখ্যান, এরাবিয়ান নাইটস্ ও কাফকাকে ছেনে সৃষ্টি করেছেন ছোটগল্পের নিজস্ব ভুবন। তার গল্পের প্লট, চরিত্র কিংবা ভাষা সবই প্রতীকী। এ ছাড়াও দেশভাগের সময় ভারত ছেড়ে আসা এই লেখকের লেখায় বারবার ঘুরেফিরে এসেছে নস্টালজিয়া।
ইনতেজার হুসেইন উর্দু ছাড়াও ইংরেজিতে লেখালেখি করেছেন। পেশাজীবনে পাকিস্তানের বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ডন-এ কাজ করেছেন। অনুবাদ করেছেন চেখভসহ বিশ্বসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ নানা লেখাজোখা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষের এই কথাসাহিত্যিক আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও লিখেছেন একাধিক অসাধারণ ছোটগল্প। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার বিখ্যাত দুটি ছোটগল্প হচ্ছে, ‘নিঁদ’, ‘আসির’ এবং ‘শেহরে আফসোস’। এ ছাড়াও তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘বাস্তি’র একটি বড় অংশজুড়েই রয়েছে সাতচল্লিশ, উনসত্তর এবং একাত্তরের দিল্লি, ঢাকা এবং লাহোর। ২০১৬ সালের দুসরা ফেব্রুয়ারি উর্দু সাহিত্যের এই শক্তিমান লেখক মারা যান।
‘মহাবনের বানরের গল্প’ ইনতেজার হুসেইনের ‘মহাবান কে বান্দরোঁ কা কিসসা’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি সরাসরি উর্দু থেকে অনূদিত। ভূমিকা : অনুবাদক]



এ একটি মহাবনের বানরদের শিক্ষণীয় গল্প। সে বানরদের নামনিশানা মুছে গেছে। যেখানে ওদের আবাস ছিল সেখানে এখন গড়ে উঠেছে মানববসতি। উঁচু বৃক্ষের বদলে আকাশছোঁয়া অট্টালিকা দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। বলা হয়ে থাকে, কোনো এক সময় এখানে ছিল গভীর ঘন বন। গাছে গাছে বানর। গুনে শেষ করা যেত না। সেই বানরদের ছিল ধারালো দাঁত, শক্ত নখ আর শক্তপোক্ত দেহ। কাছের কিংবা দূরের বাগানে তাণ্ডব চালানো, গাছে গাছে এলোমেলো লম্ফঝম্ফ করা, কাঁচাপাকা ফল পেড়ে খাওয়া—এসবই ছিল তাদের জীবন। ওদের ছিল দুরন্ত সাহস আর প্রবল উৎসাহ। বানরের দল সারা দিন এলোমেলো ঘুরে বেড়ায়, আসমানের সঙ্গে কথা বলে আর গাছের ডালে ঝুলে; লম্বা লম্বা লাফ দেয়।

বাগান ও ফসলের খেতের পাহারাদারেরা এই বানরদের হাতে বেশ জেরবার হতো। বানরগুলো এতটাই মারমুখী ছিল যে পাহারাদারদের সামর্থ্য ছিল না এদের মোকাবিলা করার। একবার একজন কৃষক ফন্দি আঁটল। একদিন বেশ কিছুটা চিনি, গুড়ের টুকরো এবং কয়েকটি লাঠি নিয়ে মহাবনের একটি গাছের নিচে রেখে আসে। ফিরে এসে সেই কৃষক খেত ও বাগানওয়ালাদের বলল এবার তোমাদের ফসল নিরাপদ। মুসাফিরদের সফর এখন শান্তিময় হবে, বানরদের ব্যবস্থা আমি করে এসেছি।

চিনি ও গুড় দেখে সমস্ত বানর গাছের নিচে নেমে আসে। মুঠি মুঠি চিনি সবাই মিলে খাচ্ছিল বটে, কিন্তু একটি লোভী বানর এক টুকরো গুড় নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। তা দেখে একটি ঘাট্টাঘুট্টা বানর লাফ মেরে সেটির পাশে গিয়ে বসে। ছোঁ মেরে গুড়ের টুকরোটি নিয়ে অন্যত্র গিয়ে বসে পড়ে। আরেকটি দুষ্টু বানর সুযোগ পেয়ে সেই গুড়ের টুকরো নিয়ে দে দৌড়। গুড়ের টুকরো হাতছাড়া হতে চলেছে দেখে সব বানর ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর সেই গুড়ের টুকরো একবার এর হাতে যায় তো আরেকবার ওর হাতে যায়। এই হাঙ্গামার ভেতর একটি বানর অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল। লাঠি হাতে তুলে নিয়ে সে গুড়ওয়ালা বানরের মাথায় এক গা বসিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ফেটে যায়, গুড়ের টুকরোটি হাত থেকে গড়িয়ে পড়ে। লাঠিওয়ালা বানরটি দ্রুত গুড়ের টুকরোর দখল নেয়। অন্যান্য বানরেরা এ দৃশ্য দেখে প্রথমত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই দেখতে পায় এখনো অনেক লাঠি পড়ে আছে। ঘাট্টাঘোট্টা বানরের দল চট করে হাতে হাতে লাঠি তুলে নেয়। ব্যস, এরপর কেমন লড়াই হয়েছিল তা জানতে চাওয়া নিষ্প্রয়োজনীয়। কারো মাথা ফেটেছে তো কারো পা ভেঙেছে, কারো বা নাকমুখ রক্তাক্ত।

একে অন্যের সঙ্গে লড়তে লড়তে বানরেরা যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে তখন জিরিয়ে নেওয়ার জন্য প্রত্যেকে পৃথক পৃথক স্থানে বসে পড়ল। এ সময় তারা দেখল তাদের মাঝে সবচে’ বয়োজ্যেষ্ঠ বানরটি পিপুলগাছের উঁচু ডালে চোখ বন্ধ করে নিচু মাথায় বসে আছে। এই বয়োজ্যেষ্ঠ বানরটি বানরের পৃথিবীতে সবচে’ প্রাজ্ঞজন। সব বানর তাকে শ্রদ্ধা করে। তাকে এভাবে নত মাথায় চুপচাপ বসে থাকতে দেখে সবাই তার দরবারে হাজির হয়ে নিশ্চুপ থাকার কারণ জিজ্ঞেস করে। বয়োজ্যেষ্ঠ বানর এবার মাথা তুলে চোখ লাল করে সবাইকে দেখে নেয়। তারপর দুঃখভরা গলায় বলে, বানরদের জাতীয় চরিত্র ভেঙে পড়েছে। ‘আমি দেখতে পাচ্ছি বানরেরা মানুষের ফাঁদে পা দিয়ে বসে আছে। বানরীয় ঐক্য ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।’

বুদ্ধিমান বানরের এই কথা বানরদের ওপর বেশ প্রভাব ফেলল। পরের দিন তারা আর ঝগড়া করল না। হলো কী, কৃষক যখন এবার চিনি–গুড় আর লাঠি গাছের নিচে রেখে গেল তখন হাতে লাঠি পাওয়া বানরেরা এই সম্পদকে বুঝে নিলো। তারপর সব বানরদের মাঝে সমানভাবে বণ্টন করে দিলো। বানরেরা বেশ খুশি, আজ মাথাও ফাটল না আবার গুড়ের ভাগও মিলল।

সে কৃষকও বড় অদ্ভুত! রোজ চিনি–গুড় রেখে যেতেই লাগল। বাগানে কোনো রকম আক্রমণ করা ছাড়াই খাবার পাওয়াকে বানরেরা বিশেষ প্রাপ্তি হিসেবে ধরা শুরু করল। বানরদের বণ্টন বেশ প্রসিদ্ধ। তবু কখনো কখনো কোনো কোনো বানর বণ্টনে একটু–আধটু কম–বেশি করে ফেলত। কখনো কখনো কোনো সুন্দরী বানরের ভাগে বেশি পড়ে যেত। এ নিয়ে বাকি বানরেরা গাছের ডালে উঠে বিকটভাবে চেঁচামেচি করত। মাঝেমধ্যে একে অন্যের সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তিও বেঁধে যেত। কিছুটা যুদ্ধ হওয়ার পর আপসে আপ সবার মাঝে শান্তি বিরাজ করত।

একদিন চিনি কিছুটা কম পড়ে গেল। একে অন্যের ওপর খুব চিল্লাচিল্লি করল বানরেরা। কেউ কেউ চিল্লাতে চিল্লাতে গাছের একদম উপরের ডাল থেকে নিচের ডালে নেমে আসলো। নাকমুখ অঙ্গারের মতো লাল হয়ে গেল। কিন্তু একসময় ক্লান্ত হয়ে সবাই নীরব হয়ে গেল। দ্বিতীয় দিন চিনি আরো কমে গেল। অবস্থা এমন হলো, কেউ মুঠি ভরে নিলো তো কারো ভাগ্যে দু–চার দানার বেশি মিলল না।

তৃতীয় দিন গুড় আর চিনি নিয়ে এসে রাখার কিছুক্ষণ পরই গুড় গায়েব, রয়ে গেল সব চিনি। জানা যায়নি, কোন বানর গুড় উঠিয়েছে এবং কোথায় লুকিয়ে রেখেছে। তারপর এটি নিত্যকার ঘটনা হয়ে গেল, গুড় তো তখনই গায়েব হয়ে যেত, বাকি চিনি কেউ পেলে পেত না পেলে নাই। শুরুতে বানরেরা খুব চিল্লাচিল্লি করলেও আস্তে আস্তে তাদের রাগ পড়ে আসতে থাকে। সবচে’ আশ্চর্যের কথা হলো ফসলের ওপর আক্রমণ করা তারা একদম ছেড়ে দিয়েছিল। তাদের সমস্ত মনোযোগ ছিল গাছের নিচে রেখে যাওয়া এই চিনি–গুড়ের প্রতি।

একদিন চিনি না পাওয়ায় বানরেরা খুব চেঁচামেচি শুরু করে দিলো। এই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একটি তরুণ বানর ডালের প্রান্তে দাঁড়িয়ে চিনির অস্থৈর্যের ব্যাপারে বক্তৃতা দিতে শুরু করে। বানরদের কাছে এ ছিল এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। সবাই চোখ বড় বড় করে বক্তৃতারত বানরটিকে দেখতে থাকে। কিছুই বোধগম্য না হলে তারা চোখ বন্ধ করে ফেলে। একটি বানর তার সঙ্গীনির মাথার উকুন বাছতে শুরু করে। একটি ছোট বাঁদরনী গাছের ডালে ভর দেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে উল্টে যায়। সেই তরুণ বানরটি বক্তৃতা শেষ করলে বয়োজ্যেষ্ঠ বানর তাকে গভীরভাবে দেখে এবং দুঃখের সঙ্গে ঘোষণা করে—‘এই বানর মানুষ হতে চায়।’

এই ঘোষণার কারণে সবার মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সবাই সেই বানরটিকে খুঁটে খুঁটে দেখতে লাগল। কিন্তু তাদের বুঝে এলো না তরুণ বানরটি মানুষ হলো কোন দিক থেকে। বক্তৃতা দেওয়া সে বানর ক্ষোভের সঙ্গে বলল, ‘এ আমার নামে অপবাদ ছাড়া কিছুই না।’

এবার প্রজ্ঞাবান সেই বয়োজ্যেষ্ঠ বানর বলল, ‘হে বানরসকল, বানরেরা চিনি খায়, চিনি নিয়ে বক্তৃতা করে না। কোনো বানর বক্তৃতা করা শুরু করলে বোঝা উচিত—বানর জাতির পতন নেমে এসেছে। তার কোনো সদস্য দেহ পাল্টাতে চাইছে।’

বানরেরা জিজ্ঞেস করল, ‘হে আমাদের গুরুজন, দেহ পাল্টানোর মানে কী?’

সেই বুদ্ধিজীবী বানর এবার বলে, ‘হে বানরসকল, যখন কোনো বানর অন্য কোনো অবানরীয় জাতির রঙে নিজেকে রাঙাতে চায় এবং দুদিনের জীবনের জন্য নিজের জীবনপদ্ধতি পাল্টে ফেলে তখন তাকে বলে দেহ পাল্টানো। তোমরা কি ‘জানে আলম’ বানরের গল্প শোনোনি?’

বানরেরা বিস্মিত হয়ে জানতে চায়—‘জানে আলম বানর কে ছিল? তার গল্পটাই বা কী?’

বুদ্ধিজীবী বানরের উত্তর—‘জানে আলমের ব্যাপারে কোনো সঠিক গবেষণা নেই, জানা যায় না সে কে ছিল। আমি মুরব্বিদের কাছে শুনেছি সে বানর ছিল। পরবর্তীতে দেহ পাল্টে মানুষ হয়ে গেছে। কিন্তু এ কথাও শোনা গেছে যে, সে আসলে মানুষ ছিল, দেহ পাল্টে বানর হয়ে গেছে। যাই হোক, মানুষ ও বানরের মৌলিকত্ব সবসময়ই অদলবদল হয়ে আসছে। কখনো মানুষ বানর হয়ে যায় কখনো বানর হয় মানুষ। আমি মুরব্বি বানরদের কাছে শুনেছি, একবার ব্যাপক আকারে বানরদের হত্যা করা হলো। বানরদের রক্ত মানুষের রক্তের চেয়ে সস্তা হয়ে গেল। এই মহাপ্রলয়ের সময়েই জানে আলম বানরকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে হাতির ওপর বসিয়ে চারদিকে ঘোরানো হয়, যেন আগে সবাই তাকে দেখতে পায় এবং তারপর হত্যা করা হয়। এই সময় সে একটা চালাকি করল। হাতির উপর বসে বক্তৃতা দেওয়া করে দিলো। শাহজাদার ক্রোধ থেকে বেঁচে যাওয়া তিনটি বৃদ্ধ বানর চুপচাপ লুকিয়ে বসেছিল। মিছিলটি কাছে এলে গাছের ডালের আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখতে পেল একটি বানর হাতির উপর বসে আছে। সে এই ক্ষণস্থায়ী জগৎ ও প্রবঞ্চক সময়ের উপর উর্দু ছন্দে বক্তৃতা করে যাচ্ছে এবং লোকেরা তা শুনছে।’

প্রথম বানর কিছুটা বিস্মিত ও ব্যথিত হয়ে বলে, ‘এই আল্লাহর বান্দা তো দেখি তার জন্মগত বৈশিষ্ট্য পাল্টে ফেলেছে। একদম মানুষের মতো কথা বলছে।’

দ্বিতীয় বানর দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘এসবই বানর জাতির পতনের আলামত।’

তৃতীয় বানরটি উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, ‘চাল–চলন যদি এই হয়, তাহলে এই ছেলে তো আমাদের যুবকদেরও নষ্ট করবে।’

প্রথমজন এবার হতাশ ভঙ্গীতে বলল, ‘সে আর আমাদের মাঝে ফিরে আসবে কী, আলতুফালতু পঙক্তি আওড়ানো যখন শিখে গেছে তখন ওখানেই কোনো বিদ্যালয়ের শিক্ষক–টিক্ষক হয়ে যাবে। সাহিত্য পড়াবে অথবা উদ্ভট গল্প নিয়ে গবেষণাটবেষণা করবে।’  

দ্বিতীয় বানরটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘মন্দ বানরের মন্দ পরিণতি’ বলে চোখ বন্ধ করে ফেলে।

পৌঢ় ও বিজ্ঞ বানরের কাছ থেকে এই গল্প শুনে বানরের দল বেশ প্রভাবিত হয়। কিন্তু সেই তরুণ বানর বলতে থাকে, ‘ওহে বৃদ্ধ বানর, শিক্ষক হওয়ার জন্য লেখাপড়া জানা জরুরি। আর পড়ালেখা করার জন্য গ্রন্থ অধ্যয়ন করা অত্যাবশ্যক। বানরেরা তো বই পড়তে পারে না, শিক্ষক হবে কী করে আর ভাষা ও সাহিত্যই বা পড়াবে কী করে?’

বুদ্ধিমান বয়োজ্যৈষ্ঠ বানরটি তাকে গভীরভাবে দেখে বলে, ‘ওহে যুবক, তোমার ভাগে কি আজ চিনি জোটেনি?’

যুবক বানর উত্তরে বলে, ‘আমি তিন দিন ধরে চিনি পাচ্ছি না।’

বুদ্ধিমান বানর বলে, ‘এ জন্যই এমন প্রশ্ন করছ। চিনি না পেলে বানরেরা প্রশ্ন করা শুরু করে। ওহে বানরসন্তান, শিক্ষক হওয়ার জন্য শিক্ষিত হওয়া এবং ‘শিক্ষিত’ হওয়ার জন্য লেখাপড়া করা জরুরি নয়। তুমি কি আরব্য রজনির কলমওয়ালা বানরের গল্প শোনোনি?’

যুবক বানর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘ওহে আমাদের গুরুজন, আরব্য রজনির কলমওয়ালা বানরের গল্পটা কেমন?’

এবার সেই প্রাজ্ঞ বানর বলে, ‘ওহে বানরসন্তান, আরব্য রজনিতে কলমওয়ালা বানরের গল্প এভাবে লিখিত আছে যে, একটি জাহাজ উপকূল থেকে কোনোভাবেই নড়াচড়া করছিল না। জাহাজের কোনো ত্রুটি যখন কাপ্তানের চোখে পড়ছিল না তখন সে যাত্রীদের বলল, বন্ধুগণ! এ জাহাজে এমন কোনো যাত্রী রয়েছে যে তার প্রভুর কাছ থেকে পালিয়ে এসেছে। সুতরাং, সবাই নিজ নিজ নাম–পরিচয় লিখে দিন। যিনি লিখবেন না তাকে সন্দেহজনক বলে ধরা হবে এবং তাকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দেওয়া হবে। সবাই আনন্দচিত্তে নিজ নিজ নামধাম লিখে দিলো। কাপ্তান নামের তালিকায় চোখ বুলিয়ে যাত্রীদের গুনে নিলো। হিসাব ঠিকঠাক পাওয়া গেল। এবার কাপ্তান পুরো জাহাজে তল্লাশি চালাল। দেখতে পেল জাহাজের এক কোণে একটি বানর বসে আছে। বানরকে দেখে কাপ্তানের মাথা গরম হয়ে যায়। সে স্থির করে বানরকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দেওয়া হবে।

এ সিদ্ধান্তে বানর বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে এবং মানুষের মতো হাত–পা জোড় করে অনুনয় করতে থাকে। অনুনয়–বিনয় যখন কেউ শুনল না তখন বানরটি লাফ মেরে কলম হাতে নিয়ে নিজের নামঠিকানা লিখে দেয়। এতে জাহাজের উপস্থিত যাত্রীরা আঙুল কামড়ে বিস্ময় প্রকাশ করে, কী অদ্ভুত কাণ্ড, বানরও কলম চালানো শুরু করেছে।

এ পর্যায়ে বানর তার দুঃখের গল্প শোনায় এভাবে—‘বন্ধুরা, আমি তোমাদের শহরেরই কবি সম্রাটের বানর। আমি যখন শিশু তখন থেকে তিনি আমাকে লালনপালন করছেন। আমাকে তিনি বেশ ভালোবাসতেন। তিনি যখন কবিতা লিখতেন আমি তখন তার কোলে গিয়ে বসতাম এবং তাকে লেখাবস্থায় গভীরভাবে দেখতাম। তিনি বাইরে চলে গেলে তার কলম তুলে তার মতো লেখার চেষ্টা করতাম। একদিন তিনি আমাকে লিখতে দেখে ফেলেন। তার কাছে আমার লিখিত কবিতাকে নিজের লেখা কবিতার চেয়ে উত্তম মনে হয়। এই কারণে তিনি ঈর্ষাণ্বিত হয়ে ওঠেন এবং আমাকে মারতে উদ্ধত হন। আমি ভয় পেয়ে ওখান থেকে পালাই এবং তোমাদের এই জাহাজে সওয়ার হয়ে বসি। আমি চাই এমন এক জায়গায় যেতে যেখানে কাব্যের মূল্য আছে। যেখানে আমার রুটিরুজির ব্যবস্থা হবে।’

এই জাহাজেই একজন কলমদার হাকিম যাত্রী হিসেবে ছিলেন। তিনি এ গল্প শোনে নিজেকে দুর্ভাগা মনে করে বললেন, ‘এবার বানরও লেখক হয়ে গেছে। লেখায় আর আনন্দ থাকল কোথায়।’ বলেই তিনি নিজের কলমটিকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে সমুদ্রে ফেলে দিলেন।

প্রাজ্ঞ জ্যেষ্ঠ বানর শিক্ষণীয় হিসেবে বানরদের এই গল্প শুনিয়েছিলেন, কিন্তু সময়টা ছিল বানরদের জাতিগত পতনের। আর জাতিগত পতনের কালে সব শিক্ষাই উল্টো প্রভাব ফেলে। তরুণ বানরটি ওপর এই বিরল গল্প অত্যন্ত বিস্ময়কর প্রভাব ফেলল। তরুণ বানরটি জানে আলম বানর হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করে। সে জানতে চায়, ‘তারপর জানে আলম বানরের কী হলো?’

‘জানে আলম বানর জানে আলম শাহজাদাহ বনে গেল।’ প্রাজ্ঞ বানরের উত্তর।

‘বানর থেকে একদম শাহজাদাহ!’

প্রাজ্ঞ বানরের উত্তর শুনে তরুণের বিস্ময় আর কাটে না যেন। দেহ পাল্টে জানে আলম হওয়ার চিন্তা ছুড়ে ফেলে সে শাহজাদাহ হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করে। তরুণ বানর জানে আলম বানরের হাতির উপর বসে দেওয়া অস্থির সময়ের পুরো ভাষণটি মুখস্থ করে ফেলে। তার সব শব্দের খেলা বুঝে নেয়। একা একা সে গাছের উঁচু শাখায় পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে অলঙ্কারপূর্ণ ভাষায় জানে আলমের বক্তৃতার পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। ‘ভদ্রমহোদয়গণ, শত অফসোস, নীচ লোকদের আকাশ প্রতিশ্রুতিতে ভরা। এর বদৌলতে বানর মানুষ হয়ে যায়, মানুষ হয়ে যায় বানর। ভাগ্যের লিখনের কাছে সবাই অসহায়। একই ব্যাপার স্বাধীনতা ও অধীনতার ক্ষেত্রেও। কাউকে স্বাধীন দেখি না। কোনো না কোনো জঞ্জালে জড়িত পাই। তার কথার কুদরত দেখো, আমার মতো ভাষাহীন অধমকে এই কষ্টভাষ্য দান করেছেন। তোমাদের সবাইকে শ্রোতার অবয়ব দেওয়া হয়েছে। দুনিয়া একটি বুড়ো বেশ্যা। গতকাল পর্যন্ত আমরা বানরেরা গাছে গাছে লাফিয়ে বেড়াতাম আর উঁচু ডালের ফল ছিঁড়ে খেতাম। আর আজ আমাদের হাত–পা ক্লান্ত। পা বসে গেছে। দাঁত ভোঁতা ছুরিতে পরিণত হয়েছে। মানুষের দেয়া চিনি–গুড় খেয়ে বেঁচে আছি। জড় ও অজড় স্থৈর্যহীন খেলাধুলার ক্রেতা আমরা। কী লেনদেন হচ্ছে তা ভাবছি না।’

বানরেরা হতভম্ব হয়ে হা করে এই বক্তৃতা শুনে। তারপর প্রচণ্ড হাসে আর একে মানুষের নকল ভাবে। কিন্তু প্রাজ্ঞ ও বয়োজ্যেষ্ঠ বানর তাকে দেখে দেখে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তার নিতম্ব ও লেজের দিকে তাকায়। মনে হয় বানরটির পেছনের পশম কমে যাচ্ছে এবং তার লেজখানা ছোট হতে হতে অর্ধেক হয়ে গেছে। তবে ঘটনা হলো, এখন সব বানরের লেজই খাটো হয়ে যাচ্ছে এবং পশম পড়ে যাচ্ছে। নখ বসে গেছে। দাঁতের এমন অবস্থা হয়েছে যে, আগে মুখ বন্ধ করে থাকলেও দাঁতগুলো কটমটিয়ে উঠত আর এখন চিনি চিবুতেও বেশ কষ্ট হয়। প্রাজ্ঞ বানর ওদের দেখে আর মনে মনে ভাবে, হে বানরদের প্রভু, বানররা কি এতটাই অসম্মানিত হবে যে, তারা সব হারিয়ে লেজহীন দুপেয়ে প্রাণীতে পরিণত হবে। যে বানর প্রজাতি বাগান ও বনে–জঙ্গলে বানরীয় যুদ্ধ বাজিয়ে ছাড়ত পৃথিবীর খাতা থেকে তাদের নাম মুছে যাবে?

প্রাজ্ঞ বানরের এই সন্দেহ সত্য প্রমাণিত হলো। একদিন তরুণ বানেরর মনে না জানি কোনো অদ্ভুত চিন্তা খেলে গেল, সে বক্তৃতা করতে করতে কৃষকের পিছু নেওয়া শুরু করল। বয়োজ্যেষ্ঠ বানর তাকে বারবার বললেন, হে নওজোয়ান বানর, কেন খামাখা নিজের জীবনটা নষ্ট করছ, মানুষের পিছে ছুটছ কেন। নিজের তারুণ্যের উপর সামান্য করুণা করো। মনুষত্বের অন্ধকার কূপে ডুবে মরা থেকে ফিরে আসো। কিন্তু সে মোটেও পাত্তা দিলো না। পিছে পিছে চলে গেল। একটি বানরশিশু কৌতূহলী হয়ে ওর পিছনে খানিকটা গিয়েছিল। ফিরে এসে সে জানালো, যুবক বানর কৃষকটির পিছে যেতে যেতে মানুষের শহরে ঢুকে পড়ে দুপায়ের উপর ভর দিয়ে হাঁটা শুরু করে। যুবক বানরটি যখন দুপায়ে ভর দিয়ে হাঁটছিল তখন লেজখানা তার ছোট হতে হতে একেবারে অস্পষ্ট সরু রেখায় পরিণত হয়।

এ কথা শুনে প্রাজ্ঞ বয়োজ্যেষ্ঠ বানর কিছুক্ষণ লেজ নেড়ে বসে পড়ে। তার নাকে এসে মাছি বসে। জোরে হাঁচি দিয়ে উড়তে থাকা মাছিকে দেখে বয়োজ্যেষ্ঠ বানর মুখ খুলে। তারপর মাছি মারার জন্য থাপ্পড় দিয়ে ব্যর্থ হয়ে চোখ বন্ধ করে বলে, ‘যে যেখান থেকে এসেছিল সে সেখানে গিয়ে মিশেছে।’

বয়োজ্যেষ্ঠ বানর অনেকক্ষণ পর চোখ মেলে। চোখ মেলার পর দেখতে পেল বানরছানার হাতে এক টুকরো বড়সড় কাগজ। বহু বানর কাগজটির উপর ঝুঁকে আছে। সে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘রে পোড়াকপালের দল, তোমাদের হাতে এ কী জিনিস এসেছে?’

বানরছানাটি উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘হে বয়োজ্যেষ্ঠ বানর এটি খবরের কাগজ। যুবক বানরের পিছে পিছে যখন গিয়েছিলাম তখন শহর থেকে এটি নিয়ে এসেছি। এখানে যুবক বানরের ভাষণ ছাপা হয়েছে।’

প্রাজ্ঞ বানর এ কথা শোনামাত্র সব বানরের চেহারার দিকে চকিতে তাকায়, দেখে তাদের মুখের লালচে ভাব ইতিমধ্যে দূর হয়ে গেছে। তারপর ওদের লেজের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং বলে, ‘ওহে অলসের দল, ও বানরেরা, এবার আর কোনো শক্তি তোমাদেরকে তোমাদের প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করা থেকে রেহাই দিতে পারবে না।’

এ কথা বলেই বয়োজ্যেষ্ঠ প্রাজ্ঞ বানর লাফাতে শুরু করে। লাফ দিয়ে অন্য গাছে চলে যায়। তারপর এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফাতে লাফাতে সে অন্য কোনো বনে চলে যায়। সে যখন আড়াল হয়ে যায় তখন মহাবনের বানরেরা লক্ষ করে তাদের লেজ ছোট হতে চলেছে। এবার তারা আর চারপায়ে হাঁটতে পারছে না। তারা সবাই গাছের নিচে নেমে আসে।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি