X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

দাওয়াই ।। জন কলিয়ের

অনুবাদ : কবির চান্দ
০৪ মে ২০২১, ১১:৫৩আপডেট : ০৪ মে ২০২১, ১১:৫৯

[জন কলিয়ের ব্রিটিশ সাহিত্যিক ও চিত্রনাট্যকার। ছোটগল্পের জন্য অধিক খ্যাতিমান। রোয়ল্ড ডাল, রয় ব্রডবেরি, পল থরোর মতো বিখ্যাত লেখকরা তার গল্প পছন্দ করতেন। ব্রডবেরির মতে, কলিয়ের লেখায় সমারসেট মম, রুডইয়ার্ড কিপলিং আর ইভেলিন ওয়ার শৈলী সমন্বিত হয়েছে।]


পল স্ট্রিটের একটা বাড়ির অন্ধকার আর ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করা সিঁড়ি দিয়ে অ্যালান অস্টিন বেড়ালছানার মতো ভয়ে ভয়ে উপরে উঠল। তার মতো একজন তরুণের জন্য সিঁড়ি ডিঙোনো কোনো ব্যাপার ছিল না, কিন্তু নির্দিষ্ট তলায় উঠে কাঙ্ক্ষিত নামটা খুঁজে পেতে কষ্ট হলো। একে তো আলো নেই, নামফলকটাও অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।

তাকে যেমনটি বলা হয়েছিল, সে তাই করল, আস্তে করে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকল। ছোট একটা কক্ষ। তেমন কিছু নেই, আসবাব বলতে কেবল একটা সাদামাটা টেবিল, একটা দোল-চেয়ার আর একটা সাধারণ চেয়ার। একপাশের বিবর্ণ হলুদ রঙের ময়লা দেয়ালে কয়েকটা তাক। সেগুলোতে সব মিলিয়ে ডজনখানে বোতল আর কাচের বয়াম।

দোল-চেয়ারে বসে একজন বৃদ্ধ পত্রিকা পড়ছিল। অ্যালান কোনো কথা বলল না। তাকে যে এখানকার কথা বলেছিল সে একটা কার্ডের মধ্যে পরিচয়সূচক কিছু কথা লিখে দিয়েছিল। অ্যালান কার্ডটা এগিয়ে দিলো।

‘বসুন, জনাব অস্টিন,’ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বৃদ্ধ বলল। ‘আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।’

‘এটা কি সত্যি যে, আপনার কাছে এমন দাওয়াই আছে, যেগুলো...’, এ পর্যন্ত বলে অ্যালান শব্দ হাতড়াতে লাগল, তারপর যোগ করল, ‘যেগুলো অসাধারণ কাজ করে?’

‘প্রিয় মহোদয়,’ বুড়ো জবাব দিলো, ‘আমার কাছে খুব বেশি কিছু নেই। আমি কোষ্ঠকাঠিন্যের বড়ি বা দাঁতে ব্যথার ওষুধ বিক্রি করি না। তবে যা আছে, সেগুলো নানান কাজের। এগুলোর কোনোটিকেই ঠিক সাধারণ ওষুধ বলা যাবে না।’

‘তাহলে তো ভালোই। সত্যি বলতে কি...,’ অ্যালান আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। বুড়ো তাকে থামিয়ে দিলো।

‘এই যে, এটার কথাই ধরুন,’ তাক থেকে একটা শিশি নামিয়ে সে বলল, ‘দেখছেন তো যে এটা দেখতে একেবারে পানির মতো, কোনো বর্ণগন্ধ নেই, এমনকি আলাদা স্বাদও নেই। কফি, মদ, বা যেকোনো পানীয়ের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে দেওয়ার জন্য একেবারে আদর্শ। আর ময়নাতদন্তেও কিছু ধরা পড়ে না।’

অ্যালান ভয় পেয়ে গেল। আতঙ্কিত গলায় বলল, ‘তার মানে আপনি বলতে চান এটা একটা বিষ?’

‘আপনার ইচ্ছে হলে এটাকে হাতের দস্তানা পরিষ্কারক বলতে পারেন,’ নিরাসক্ত গলায় বৃদ্ধ জবাব দিলো। ‘হয়তো এটা দিয়ে দস্তানা ধোয়া যাবে, তবে আমি কখনো চেষ্টা করে দেখিনি। ইচ্ছে করলে এটাকে জীবন সাফকারীও বলা যায়। কখনো কখনো প্রাণ মুছে ফেলার দরকার পড়ে।’

‘না, না, আমি সেরকম কিছু চাই না,’ অ্যালান বলল।

‘না চাওয়াটাই ভালো,’ বুড়ো বলল। ‘তবে আপনি কি জানেন এর দাম কত? মাত্র একচামচের দাম চার লাখ টাকা, এর এক পয়সাও কম নয়।’

অ্যালান একটু দমে গেল। বলল, ‘আশা করি আপনার সব ওষুধই এরকম দামি নয়।’

‘না প্রিয় আমার, অবশ্যই না,’ বুড়ো বলল। ‘মন ভোলানোর জন্য এত দাম হাঁকা অর্থহীন। যে তরুণ বয়সীদের এটা দরকার তাদের এত টাকা থাকে না। যাদের থাকে তাদের দাওয়াই লাগে না।’

‘কম দামের ওষুধ আছে জেনে খুশি হলাম,’ অ্যালান বলল।

‘ব্যবসাটাকে আমি এভাবেই দেখি,’ বুড়ো বলল, ‘কোনো একটা জিনিস দিয়ে ক্রেতাকে খুশি করো, তাহলে সে আবার আসবে, যখন তার অন্যকিছু লাগবে। দরকার হলে সে টাকা জমিয়ে ওটা কিনবে।’

‘তাহলে, আপনার কাছে সত্যিই মন ভোলানোর দাওয়াই আছে?’ অ্যালান জিজ্ঞাসা করল।

‘না থাকলে তো আমি অন্য জিনিসটা দেখাতাম না।’ আরেকটা শিশির দিকে হাত বাড়াতে বুড়ো বলল, ‘সব ধরনের জিনিস দেওয়ার মতো আস্থা থাকলেই শুধু ওরকম গোপনীয় ব্যাপার জানানো যায়।’

‘আর এই দাওয়াই নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই...’ এটুকু বলে অ্যালান থেমে গেল, সে যা বলতে চায় তা মুখে আনতে পারছিল না।

‘না, না, এগুলোর প্রভাব স্থায়ী, আর কেবল উপরি উপরি নয়, একেবারে গভীরে গিয়ে কাজ করে। পর্যাপ্তভাবে, জোরালোভাবে, স্থায়ীভাবে।’

‘তাই নাকি? বেশ ভালো তো,’ অ্যালান যতটা সম্ভব নিস্পৃহ গলায় বলার চেষ্টা করল।

‘মনের ওপর এর কাজের কথাটাও ভাবুন একবার,’ বুড়ো বলল।

‘বলুন, আমি শুনছি।’

‘এমন কিছু ওষুধ আছে যেগুলো আসক্তি কমিয়ে নিস্পৃহভাব এনে দেয়। তাচ্ছিল্যের যেমন প্রতিকার আছে, তেমনি আছে আদরেরও। এই যে, এই ওষুধটার কথাই ধরুন—হলুদ রঙের সরবত; স্যুপ বা পানীয়ের সঙ্গে এই এতটুকু সামান্য মিশিয়ে কোনো তরুণীকে খাইয়ে দিন—সে যতই হইচই আর ফুর্তি পছন্দ করুক না কেন এরপর একেবারেই বদলে যাবে। কেবল আপনাকে আর নির্জনতা ছাড়া আর কিচ্ছু চাইবে না।’

‘আমি যার জন্য এসেছি সে এত বেশি পার্টি পছন্দ করে যে আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না এটা কাজ করবে।’

‘সে আর এসব পছন্দ করবে না। বরং পার্টিতে আপনার সঙ্গে যেসব সুন্দরীর সাক্ষাৎ হবে তাদের নিয়ে ভয়ে থাকবে।’

‘বলেন কী, সে আমাকে নিয়ে ঈর্ষায় ভুগবে?’ অ্যালানের গলায় খানিকটা উচ্ছ্বাসের আভাস।

‘জি।, সে চাইবে আপনার পুরোটা জুড়ে যেন শুধু সেই থাকে।’

‘আমি কবেই আমার পুরোটা তাকে দিয়ে দিয়েছি, কিন্তু সে কোনো গুরুত্ব দেয় না।’

‘এটা খেলে অবশ্যই দেবে। অত্যন্ত নিবিড়ভাবে দেবে। আপনিই হবেন তার জীবনের একমাত্র আগ্রহের জায়গা।’

‘দারুণ’, আনন্দের আতিশয্যে অ্যালান প্রায় চিৎকার করে উঠল।

‘আপনি যা যা করেছেন, সারা দিনে যা যা ঘটেছে, সবকিছুই সে অক্ষরে অক্ষরে জানতে চাইবে,’ বৃদ্ধ বলল। ‘আপনি কী ভাবছেন, কেন কখনও হেসে উঠেছেন, কেন আপনাকে দুঃখিত দেখাচ্ছে, এসব নিয়েই সে মেতে থাকবে।’

‘এর নামই তো প্রেম,’ অ্যালান বলল।

‘জি।’ বুড়ো একমত হলো। ‘কী মায়াভরা চোখেই না সে আপনার দিকে তাকাবে। আপনাকে সে কখনো ক্লান্ত হতে, মনমরা হয়ে বসে থাকতে বা খাবারদাবারের প্রতি অবহেলা করতে দেবে না। যদি আপনার বাসায় ফিরতে ঘণ্টা খানিকও দেরি হয়, সে চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়বে। আপনি খুন হয়ে গেলেন কি না বা কোনো মোহিনী রমণীর ফাঁদে পড়েছেন কি না সে নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে।’

‘আমি কল্পনাই করতে পারছি না যে আমার জন্য ডায়ানা এরকম করবে,’ এই প্রথম অ্যালান মেয়েটির নাম নিল।

‘আপনাকে আর কষ্ট করে কল্পনা করতে হবে না বাস্তবেই এরূপ ঘটবে। আর হ্যাঁ, মোহিনী পরিদের কথা যখন উঠলই তখন বলে রাখি যে ছেলেদের একটুআধটু পা পিছলাতেই পারে। সেটাও সে ক্ষমা করে দেবে। অনেক আঘাত পাবে সত্যি, তবু শেষ পর্যন্ত সে ক্ষমা করবে।’

‘আমার বেলায় এরূপ ঘটবে না, কক্ষনো ঘটবে না।’

‘অবশ্যই না,’ বুড়ো বলল, ‘তবে বলছি কি, যদি ঘটেই যায়, আপনার দুশ্চিন্তার কারণ নেই। সে কখনো আপনাকে ছেড়ে যাবে না। আপনি বিন্দুমাত্র অস্বস্তিতে পড়েন, এমন কিছুই সে করবে না।’

‘এটার দাম কত?’

‘এটা দস্তানা পরিষ্কারক বা, আমি যেমন মাঝে মাঝে বলি, জীবন সাফকারীর মতো এত দামি নয়। ওটার দাম চার লক্ষ টাকা, এক পয়সাও কম নয়। ও ধরনের জিনিসের জন্য আরেকটু বেশি বয়সের দরকার হয়, টাকাটা জমাতে সময় লাগে।’

‘আর মন ভোলানোটার দাম?’ অ্যালান জিজ্ঞেস করল।

‘ওহ! ওটা?’ বুড়ো লোকটা টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা ছোট শিশি বের করে বলল, ‘এই পরিমাণ মাত্র একশো টাকা।’

‘আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না আমার কী যে উপকার হলো,’ অ্যালান আনন্দিত গলায় বুড়োকে বলল।

‘উপকার করতে পারলে আমারও ভালো লাগে,’ শিশিতে তরল পদার্থ ঢালতে ঢালতে বুড়ো বলল। ‘ক্রেতারা তখন আমার কাছে ফিরে আসে, যখন তাদের অবস্থা ভালো হয় আর তারা দামি ওষুধ চায়। এই যে, এই নিন আপনার দাওয়াই। দেখবেন এটা কত ভালো কাজ করে।’

‘ধন্যবাদ,’ অ্যালান বলল, এরপর যোগ করল, ‘আসি তাহলে।’

‘আবার দেখা হবে,’ বুড়ো বলল।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অতীত ফিরিয়ে আনলেন শান্ত-রানারা
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অতীত ফিরিয়ে আনলেন শান্ত-রানারা
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয় ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ জেনে নিন
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয় ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ জেনে নিন
হাতিরঝিলে ভাসমান অবস্থায় যুবকের মরদেহ
হাতিরঝিলে ভাসমান অবস্থায় যুবকের মরদেহ
ইউক্রেনীয় ড্রোন হামলায় রুশ সাংবাদিক নিহত
ইউক্রেনীয় ড্রোন হামলায় রুশ সাংবাদিক নিহত
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি