X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

নিজের স্বপ্নপুরুষের সঙ্গে কয়েক জন্মের তফাতে জুলেখার মিলন

দেবেশ রায়
১১ মে ২০২১, ০১:১৩আপডেট : ১১ মে ২০২১, ০১:১৩

হঠাৎই গল্পের ঠাকুরের সঙ্গে একটু কথা বলার বা দুজনের চুপ করে বসে থাকার ইচ্ছে হলো কেন?
বছর চার-পাঁচ হলো একটা বেশ দুহাতের তেলোর মধ্যে পাকানো গল্প আচমকাই আমাকে নিঃসাড়ে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আমি একেবারে অপ্রস্তুত।
একটা গল্প, যে-গল্প যদি আবার হাজার-হাজার বছর ধরে, মহাদেশে-মহাদেশে ঘটে আর সেই গল্প খুদে তুললে হয় ভিৎ থেকে চুড়ো, তা হলে তাড়াহুড়ো করলেই সর্বনাশ। কে কী ভাবে যে এখন সময় জুড়ে ঘটা গল্প লেখার বা তৈরি করে তোলার সময়, পৃথক রাখতে পারেন, তা আমি কেন, একালে কেউই জানেন না। যেন, ও-সব এককালে ঘটত।
অলঙ্কার দিয়ে সাজিয়ে বেশ অহঙ্কার গোপন করে বলা যায় যে উপন্যাস-রচনা একটি মাদুরার মন্দির গড়ে তোলা, তার অসংখ্য অলিন্দ-চৈত্য-তলাসহ, কিন্তু ঘটনাটি তো দাঁড়ায় একজন মানুষকেই সেটা করতে হচ্ছে, একটা মাত্র মানুষকেই প্রতিটি অক্ষর লিখতে হচ্ছে, একটা কথাও তার নিজেকে দিতে হচ্ছে। আর একজন কেউ দিয়ে দেওয়ার নেই। মন্দির তৈরি করে তোলা–এখন সাজানো কথা ভুলে যেতে পারলে কিন্তু এটা স্বাভাবিক ঠেকে–বছর কয়েক ধরে একটা গল্প লেখার চেষ্টা করলে, গল্পটা হারিয়ে যেতেও পারে। সাধারণত যে হারায় না, তার প্রধান বা, বোধহয় একমাত্র কারণ এই যে আমরা লেখকরা অন্ধভাবে গল্পটাকে অনুসরণ করতে থাকি। গল্পের নিজস্ব খাত থাকতেও পারে, নাও পারে। আমি যদি লেখক সেই সব খাত খোঁজাখুঁজির মধ্যে না ঢুকে, পাতার ভেলার আশ্রয়টুকুকে পরম ও চরম ধরেনি তাহলে গল্পটাই আমাকে টেনে নিয়ে যাবে।
ঠিক জানিই না–গল্পের কোনো নিজস্ব খাত থাকে কী না। এও তো জানি না, খাতটা লেখকই বানান বা খোঁড়েন কী না। এক-এক সময় এক-এক রকম ভাবি, এক-এক রকম বলি। এগুলো তো পেশার ব্যাধি। কোনো জেলে যদি বলে তার জলদাদ হয়েছে তা হলে তো তাকে জল ছাড়তে হয়। জলে থাকব অথচ জলদাদ হবে না–তা হলে হয় তোমার জলটা জল নয় আর নয় তুমি মানুষটা মানুষই নয়।
আমার ঘটনাটা উল্টো ঘটে গেছে।
এতকাল ধরে লিখছি তো, এখন অভ্যেস এসে গেছে। একেবারে হিসেব করা অভ্যেসে। লেখাটাই যার একমাত্র কাজ সে সারা দিন যদি অন্য কোনো ধরনের ব্যস্ততায় জড়িয়ে না পড়ে, তাহলে খাওয়া-দাওয়া একটু ভাতঘুমসহ বিনা পরিশ্রমে তার পাঁচ-ছ হাজার শব্দ লেখা হয়ে যাবে–যদি সেই গল্পের মধ্যে হঠাৎ কোনো প্যাঁচ ঢুকে না পড়ে। তেমন অনিশ্চয়তা আজকাল সাধারণত ঘটে না, গল্প গল্পের মতো বয়ে শেষ হয়ে যায়, তার মানে সোজা হিসেবে চার-পাঁচ দিনে একটা হাজার বিশেক শব্দের উপন্যাস শেষ হতেই পারে। ছাপা-ব্যবস্থার আধুনিকতার ফলে পাতাপিছু শব্দসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণের বেশি বেড়ে যাওয়ায় লেখকদের শ্রমলাঘব হয়েছে। কিংবা হয়নি। কিন্তু কী একটা বদল ঘটেছে যাতে আগে যে-গল্পকে বেশ মোটা মনে হতো, এখনো সে-গল্পকে তেমনই মোটা মোটা মনে হয় কিন্তু সেগুলি নতুন ছাপানোর পদ্ধতির ফলে অনেক-অনেক রোগা দেখায়। নিজে পরীক্ষা করার জন্য তারাশঙ্করের ‘গণদেবতা’ উপন্যাসটির ফাল্গুন ১৪২৫-এ ছাপা বইটি এনে দেখি সেটা প্রায় আড়াইশ পৃষ্ঠার বই ও তার সহযোগী ‘পঞ্চগ্রাম’ বইটির আষাঢ় ১৪২৩-এ ছাপা মুদ্রণও পৌনে তিনশ পৃষ্ঠার মধ্যে এঁটে গেছে।
এসব কী করে উপন্যাস রচনার সমস্যার সঙ্গে জড়িয়ে যায়, সেটা খুব ন্যায্য প্রশ্ন হলেও আমার মন এখন খুঁতখুঁতিয়ে ওঠে কেন–‘গণদেবতা’ ও ‘পঞ্চগ্রাম’ মিলে দেশ বা স্থান বা পরিসরের, আজকাল যাকে ইংরেজিতে সহজবোধ্য ও ব্যাপকতম অর্থে অর্থে ‘স্পেস’ বলা হয়, সেই ‘স্পেস’ যে উচ্ছ্বসিত, উচ্ছিত, শ্রুত, প্রতিধ্বনিময় হয়ে ওঠে সেই ‘দেশ’ বা স্পেস তা হলে আছে কোথায়, যদি তার আয়তনগত শীর্ণতা ছাপার কারিগরির সঙ্গেই এমন বাঁধা থাকে?
আমি জানি–অনেকের কাছেই এমন একটা কথা তোলা উদ্ভট মনে হবে। জানি বলেই–উদ্ভট মনে হবে না এমন একটা ভাষাতেও আমি কথাটা ভেবে রেখেছি। ‘উপন্যাস’-এর দেশ বা স্পেসটা, তা হলে আছে কোথায়, থাকে কোথায়, যে-দেশ বা স্পেস হারিয়ে গেলে আর খুঁজে পাওয়া যায় না, তার পুনরুদ্ধারও অসম্ভব।
আমার তো তাই ঘটেছে।
বা, তাই ঘটেছে কী না আন্দাজ করতে গল্পের ঠাকুরের ঘরে এসে বসে আছি। কথায়-কথায় বা চুপচাপের মধ্যে একটা আন্দাজ পাওয়া যায়–ঘটনাটা কী?


দুই

কথাটা একটু গুছিয়ে বলতে হবে নইলে আমার সংকটটা বোঝানো যাবে না। কার কাছে বোঝানো যাবে না? গল্পের ঠাকুরের কাছে? ওটা তো বানানো ঠাকুর। সে কী করে বুঝবে আমার সংকট।
হ্যাঁ, তা তো হতেই পারে।
তা হলে নিজের কাছেই স্পষ্ট করা দরকার–ঘটেছেটা কী? সেটাই স্পষ্ট করা যাক, যতটা পারা যায়।
ঐ যে আমি একটা হিসাব দিলাম দিন দশেকে একটা বিশ হাজার শব্দের উপন্যাস নামানো হেসেখেলে করে ফেলার ব্যাপার।
এই হিসাব থেকেই, একজন দিনমজুর যেমন নির্ভুল জানে তাকে বাড়ি ফেরার সময় কত টাকা নিয়ে ফিরতে হবে, আমিও সে-রকম শারদীয় সংখ্যাগুলোর লেখা লিখে ফেলতে পারতাম। বড় আকারের উপন্যাসগুলোর অনেকগুলিই শারদীয় সংখ্যায় বেরিয়েছে কয়েক বছর ধরে। আমি কখনো কোনো গল্প হারাইনি। এই রকম উপন্যাসের গল্প।
বছর পাঁচ-সাত আগে একটা এমন উপন্যাস শুরু করেছিলাম।
গল্পটার শুরু ওল্ড টেস্টাবেন্টের সময়, ‘অ্যান্ড জ্যাকব ডুয়েল্ট ইন দি ল্যান্ড অব কানান’। এরাই জ্যাকবের বংশ। সতেরো বছর বয়সের জোসেফ বা ইউসুফ গরুভেড়া চড়াত, তাদের খাওয়াত, তার অন্য ভাইরাও ছিল–তার বাবার অন্য স্ত্রী বিল্লা, জিলফা। ইজ্রায়েল তার অন্য ছেলেদের চাইতে জোসেফ কে (ইউসুফকে) বেশি ভালোবাসতেন। শেষবয়সের ছেলে। তিনি জোসেফের জন্য নিজের হাতে নানা রঙের উটের চামড়া মিলিয়ে একটা কাঁথা বুনে দিয়ে ছিলেন। এই সব কারণে জোসেফ বা ইউসুফের অন্য ভাইরা তাকে খুব হিংসে করত।
এ সব জায়গা ও লোকজন তো এখনো আছে। বিরাট বিরাট তেলের খনি আছে। সারা দুনিয়ার লোক, বড়লোকরা, সে সব জায়গায় বেড়াতে যায়। যাকে বিশ্বের আধুনিক পর্যটন মানচিত্র বলে–এই জায়গাগুলি তার মধ্যে পড়ে। বিশ্বের পর্যটন বলয় বলতে যা বোঝায় তার যোগ্য বড়লোকিও এখানে চালু। ইউয়োরেপর চাইতে এরা অনেক বড়লোক। আমেরিকার চাইতে নয়। তাই যুদ্ধযুদ্ধও চলে।
সুতরাং, আধুনিক কালের গল্প-উপন্যাসের ঘটনা তো এ-সব জায়গায় ঘটতেই পারে।
এই গল্পটার বেলায় সমস্যা ছিল, সমস্যাও ঠিক না, ঘটনা ছিল–৭০০০ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ থেকে জোসেফ বা ইউসুফ স্বপ্নে ৫০০ খ্রিষ্টাব্দের এক রাজকন্যা জুলেখাকে ভালোবেসেছে ও তার সঙ্গেই তার জীবন রচিত হবে। কিন্তু বাধা আছে অনেকগুলি। জোসেফ বা ইউসুফকে জন্ম নিতে হবে, দাস হতে হবে, দাস হয়ে তাকে পৃথিবীকে রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে ও এই সব কাজের শেষে তার সঙ্গে জুলেখার মিলন হবে। জোসেফ বা ইউসুফ এও, স্বপ্নে, শেষ স্বপ্নে, জানিয়েছিল–তার নাম জোসেফ ও সে আজিজমিশিরি অর্থাৎ মিশরের অধিপতি।


তিন

সব তো ঠিকই ছিল, গল্পও এগোচ্ছিল, গল্প, প্রায় দশ হাজার বছরজুড়ে, ঘটনা-ঘটনাগুলোই সবার জানা, তাতে প্রচুর স্বপ্ন, প্রচুর অদ্ভুত, প্রচুর উদ্ভট বরাবরই ঘটে ও ঘটনা বদলে বদলে দেয়। একজন লেখকের বিশেষ কিছু করারও নেই যদি তার এই প্রায় দশ হাজার বছর সময়ের লিখিত গল্প, দি বাইবল, তার আবার দুই ভাগ–ওল্ড টেস্টামেন্ট আর নিউ টেস্টামেন্ট ভালো করে জানা থাকে আর কোরানের গল্প। এমন একটা জানা গল্প ফিরে বলার সুখ আলাদা। খুব হালকা হয়ে লেখা যায়।
আর আমাকে তো লিখতে হচ্ছে, দিনমজুরের মতো বছরে দিন দশ-পনেরো। তাতেই সে-বছরের বরাত শেষ।
এই পদ্ধতিতে ও অভ্যাসে লেখাটা দিব্যি এগোচ্ছিল। ঠিকঠাক বলতে পারব না, তা, প্রায় অনেকটাই লেখা হয়ে গিয়েছিল, অন্তত ৬০ হাজারের বেশি শব্দ আর তাতে নানা ধরনের ঘটনাও ঘটে যাচ্ছিল–যা এখনকার গল্প-উপন্যাসে ঘটানো যায় না। গল্পের তো একটা হিসাব থাকে। সেই হিসাব অনুযায়ী আমি এই কৌতুকে পৌঁছে গিয়েছিলাম যে ইউসুফের জীবনের সব কিছু জুলেখার জীবনটা তৈরি করে ইউসুফের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে কিন্তু জুলেখাকে তো ইউসুফ চেনেও না, জানেও না। অথচ তাদের পরিচয় ও প্রেম দিয়েই তৈরি হবে নতুন পৃথিবী।
লেখক হিসেবে আমার কাজ এই পরিচয়, প্রেম ও প্রতিশ্রুতি মিলিয়ে দেওয়া। পরন্তু দুজনের মধ্যে একজনের, জুলেখার, পুরো গল্পের অতীত ও ভবিষ্যৎ জানা, সেই জ্ঞান দিয়ে সে নিজেকে প্রস্তুত করেছে।
চার বছর ধরেই লেখাটা চলছিল।
মানে, বছরে বিশ হাজার শব্দ।
বিশ হাজার শব্দের মধ্যে দুজনকে দুজনের চেনা করে দেয়া যাবে না?
দুজন দুজনকে চিনল, জন্ম-জন্মান্তরের চেনা, এই পর্যন্ত পৌঁছলেই আমার কাজ শেষ।
ভালোই লাগছিল–শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়ে একটা পরিচয়ের সত্য হয়ে ওঠার কাহিনির সমাপ্তির কাছে পৌঁছুতে। এ এক বিরল অভিজ্ঞতা–যা প্রধানত কবি-ঔপন্যাসিকদের জন্যই নির্দিষ্ট, কচিৎ চিত্রশিল্পীদের জন্য, কিন্তু চিত্রশিল্পীদের তো এমন কোনো জায়গা বা বিন্দু নির্দিষ্ট নেই, যে-পর্যন্ত পৌঁছুলে তাদের কাজের সমাপ্তি চিহ্নিত। কবি-ঔপন্যাসিকদের গল্পের সেই জায়গাটা একেবারে অতিচিহ্নিত। সেটাকে অতিক্রমের অধিকার কারো নেই। কারো নেই। বস্তুত–এই পুরো যাত্রাটা সম্পন্ন করাই তার রচনার বিষয় বা ক্রিয়া। তার ব্রত। তার প্রতিশ্রুতি।
এই যে ষাট হাজারের বেশি শব্দ জুড়ে দুজন দুজনের দিকে নিশ্চিত এগিয়ে আসছে, আবার, একজন আর-একজনকে সারা জীবনব্যাপী চেনে, যদিও তেমন চেনার মধ্যেও কত গভীর অচেনার খাত, আর-একজন জানেও না তার জন্ম-জন্মান্তরের জীবন এই মিলনটি ঘটানোর জন্যই যাপন করে সে এসেছে–একজন কবি বা লেখকের পক্ষে এ এক পরম মুহূর্ত। ঘটল বা ঘটেছিল কী। বড়জোর তো আর দিন দশেকের কাজ। একেবারে দিনমজুরের মতো নিশ্চয়তায় কাজটা শেষ হয়ে যাবে। সন্ধের পর বাড়ি ফিরব–এই তো ঘটনা। দিনমজুরের তো কাজটুকুই শেষ করা দরকার। কাজ পাওয়াটা সমস্যা হতে পারে। কাজ পেয়ে গেলে যে-কাজ শেষ হওয়ার তো কোনো ঝামেলা নেই–একই নেহাতই দিনমজুরের এমন দুশ্চিন্তাটুকু ছাড়া, ক্ষণিক এমন দুশ্চিন্তাটুকু ছাড়া–হাতের কাজটা শেষ হয়ে গেলে পরের এমন টানা কাজ কী করে জুটবে। তবে, এগুলো একটু বাড়িয়ে বলা, একটু বেশি বাড়িয়ে বলা। একজন লেখকের কাজের অভ্যাস বা ধরনকে, একটু বেশি কাপড়-চোপড় খুলে দেখানো বা দাগানো যে একজন লেখকের কাজ একজন দিনমজুরের কাজ থেকে এমন কিছু আলাদা নয়।
উপমাটা ভেঙে পড়বে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে।
এই শেষ দফায়, যখন আমি সবচেয়ে নিশ্চিত ও আশ্বস্ত, কোনো উদ্বেগও নেই, বরং, এত লম্বা একটা কাজ যে পরিকল্পিত শেষ পর্যন্ত আসছে, তাতে সুসম্পন্ন কর্মের জন্য একটু আহ্লাদিত ক্লান্তির অপেক্ষা সারা শরীরে প্রত্যাশিত হয়ে উঠছিল, পায়ের বুড়ো আঙুল থেকে কেশাগ্র পর্যন্ত। এই প্রত্যাশাটুকু কবি-সাহিত্যিকদের একেবারে নিজস্ব। যত ছোট লেখাই হোক, লেখাই তো। সে চার-ছয় লাইনের একটা ছোট কবিতাই হোক। জানা নেই তো কী বিপুল অন্ধকার ও ঊষরতা ছেদন করে, কোনো এক পথহারা নামহারা ফুল সকালের প্রথম আলোকে বন্দনা করবে বলে সেই বিপুল অন্ধকার পাড়ি দিচ্ছিল আর সেই বিপুল অন্ধকার তার গন্ধ ছড়িয়ে দিলো ঘুমেরও প্রান্তে, যদি সেই ঘুমন্ত, ঘুমেও জেগে থাকে ততটুকু, যতটুকু জেগে থাকায় সে বিপুল অন্ধকার বাহিত গন্ধটুকু পেতে পারে।
এর বেশি আর কী প্রত্যাশা থাকতে পারে একজন কবির বা লেখকের রচনার উপান্তে।
যত ছোট কবিতাই হোক বা যত সহস্রাব্দব্যাপ্ত দীর্ঘ উপন্যাসই হোক–একজন কবি তার শেষ শব্দে পৌঁছানোর জন্য নিজে অপ্রস্তুত থাকতে চায়, নিজের সমস্ত স্বাতন্ত্র্য ঢেকে যাচ্ছে এমন অন্ধকারের বিপুলতা চায় আর তার অদৃশ্য ঝড়ে-যাওয়াটুকু চায় আর তেমন এক ঘুমন্তকে চায় যার ঘুমের গন্ধগ্রাহী প্রান্ত থাকে।
এই সবই মিলল কী না বোঝা যায় না। কিন্তু সেই মুহূর্তে সমস্ত শরীর গোপন স্বেদে তরল হয়ে যেতে থাকে। কোনো অপ্রস্তুত নেই। শুধুই নিজের শরীরের বিগলন আছে, শুধুই সেই চরমে পৌঁছানোর জন্য ধীরতম অগ্রসরণ আছে। সাবধানতা থাকে–কারণ জানা নেই, স্খলন কোথায় ঘটতে পারে কিন্তু জানা আছে, স্খলন যেকোনো মুহূর্তেই ঘটতে পারে ও সেই সম্ভাব্যতা থেকে কোনো আত্মরক্ষা নেই।
এই তাবৎ জ্ঞান ও অজ্ঞান, অনুভবের সত্য ও সমস্ত চেষ্টার অসত্য, নিজের ক্ষমতার সীমা ও আকাঙ্ক্ষা, নিজের সত্তার সকল বিনয় ও সামর্থ্য দিয়ে কোনো বিশ্বযুদ্ধের প্রধান নির্ভরের মতো নিশ্চয়তায়, বা তেমন কোনো মহাযুদ্ধের ঘোষণা না থাকলেও ভুবনবিজয়ই যেখানে একমাত্র কর্মসূচি, সেই ধ্রুব অকম্পিত ও নিশ্চিত পদক্ষেপের পূর্বমুহূর্তে কোনো কবি বা লেখক নিজেকে ছাড়া আর-কাউকে চেনে না আমি খুব নিশ্চিতভাবেই ও খুব অভিজ্ঞ অভ্যস্থতায় এই শেষ মানুর জন্য প্রস্তুত হয়ে এগোচ্ছিলাম। খেলাধুলোর কিছুই আমি জানি না, এমনকি তাও না যা সবাই জানে। ক্রিকেট-ফুটবল-অ্যাথলেটিকস-এর নানা গল্প শুনেছি। সেই সব গল্পের নিজস্ব অর্থ আমার পক্ষে বোঝা মুশকিল। প্রায় অসম্ভবই। কিন্তু সে-সব গল্পের একটা নিহিত অর্থ আমার কাছে কখনো-কখনো তৈরি হয়ে যেত। যেমন, শচীনের কোনো এক পাকিস্তান টেস্টের গল্প। সেখানে দুদিক থেকে পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ শক্তিধর বোলারদের দিয়ে বল করানো হচ্ছিল শচীনকে ধূলিসাৎ করতে আর শচীন নাকি প্রত্যেকটি বলকেই ওভার-বাউন্ডারি করছে। এগুলো ঘটে মনঃসংযোগের বিরল মুহূর্তে। সব সময় যে নিশ্চিত ঘটেই তা নয় কিন্তু ঘটে গেলে তাকে সেই সংযোগ থেকে ছিন্ন করা যায় না। আমিই তো একবার বাঙ্গালোর টেস্টে টিভিতে দেখছিলাম–কী এক গোলফলে খেলা স্থগিত হয়ে আছে। গাভাসকর তখন খেলছেন। খেলা স্থগিত হয়ে যাওয়ায় গাভাসকর পিচের পাশেই উপুড় হয়ে শুয়েছিলেন। পরদিন কাগজে পড়েছিলাম–তখন তাঁর ১০২ রান। খেলা আবার শুরু হলে–উঠে পিচে দাঁড়ালেন ও তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ইনিংস খেললেন। আরো কোনো খেলোয়াড়ের গল্প শুনেছি। প্রতিটি অলিম্পিক নিজের আগের রেকর্ড ভাঙতেন। এমন নাকি ১৮-বার ঘটেছিল। আমি অজবুক বুঝতামই-না, এখনো বুঝি না–এই সামর্থ্যই বা কী আর উনি একবারেই তাঁর সবচেয়ে উঁচু লাফটা দিতেন না কেন। আমার এক ক্রীড়া-বিশেষজ্ঞ বন্ধু মানস চক্রবর্তী অনেক চেষ্টা করেও আমাকে স্থির নিশ্চিত, সম্বিত, এই সব শব্দ দিয়ে বোঝাতে পারছিল না, শেষে মানস ‘স্টক’ শব্দটি ব্যবহার করায় আমি খানিকটা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম, ক্ষমতা ব্যক্তিরই ক্ষমতা বটে কিন্তু বিস্ময়টা এইখানে–সেই ক্ষমতা এতগুলো বছর ধরে একই রকম থেকে গেছে, তাঁর, সেই খেলোয়াড়ের, লাফ দেয়ার খেলোয়াড়, বুবকার ও আমার মূর্খতা আন্দাজ করে মানস বলেছিল–তাঁর ক্ষমতা একই রকম থেকে গেছে তাঁর, কথাটার মানে, তাঁর ক্ষমতা একই রকম রেখে যেতে পেরেছেন তিনি, কারণ, ক্ষমতাটা একান্তই তাঁর, একান্তই তাঁর, যে-ক্ষমতার কোনো ভাগিদার হয় না। মানস দাগিয়ে দিয়েছিল, কেমন সুন্দর বলে, ‘উনি আসলে নিজের স্মৃতিস্তম্ভ নিজেই ডিঙিয়ে যেতেন। এখন ইউক্রেনের মন্ত্রী।’
আমি নেহাতই বাংলা ভাষার এক গল্পলেখক, শুধু লিখে খাওয়ার জোর নেই বলে অন্য চাকরি করেছি আর তার সঙ্গে একটু-আধটু লিখেছি। ঐ পার্টটাইম লেখক হওয়ার সুবাদে কিছু মস্তানি হয়তো লেখায় এসে গেছে কিন্তু সেগুলো চব্বিশ ঘণ্টা লেখা নিয়ে থাকার ফলে যেমন রক্তে ঢুকে যেতে পারত, তেমন ঢোকেনি। রক্তে ঢুকে যেতে পারত কী না সেটাও তো আনুমানিক কথা। রক্ত থাকলেই কি সে-রক্ত সব উপাদান বইতে পারে? আমাকে তো খুব হিসেব করে লেখক হতে হয়েছে, লেখক থাকতে হয়েছে। সেই প্রক্রিয়ায় এই ছোটখাটো হিসেব বড় বেশি জরুরি–দিনে ক-পাতা লিখলে, ক-দিনে বিশ হাজার মতো শব্দ লেখা যায় ও পুজোর সময় কার দেয়া কথা রাখা যায়। এত ছোট, এত ছোট, এত হিসেবি, এত আত্মরক্ষণশীল, ভিতু, বাৎসরিক কৃত্যের মতো লেখালেখিতে–এ-সব কথা অবান্তর, সে যতই ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে কোরান পর্যন্ত প্রায় হাজার দশেক বছরের ভিতর স্বপ্নবিনিময় ও জন্মবিনিময় ঘটুক।
আমাদের পাড়ার বাচ্চারাও তো শচীনের একত্রে ১০-লেখা গেঞ্জি পরে খেলতে নামে।
এই সব জেনেশুনেও, এই সব অভ্যেস সত্ত্বেও, এই সব বয়স্ক কাণ্ডজ্ঞান সত্ত্বেও, এই সব ঘোর অন্ধকারেও চোখ বুজে চেনা রাস্তায় হাঁটার নিরাপত্তাবোধ সত্ত্বেও আমার জানা আছে বিপর্যয়ের অনিশ্চয়। বিপর্যয় ঘটতে পারে–এমন বোধ থেকে একটা সাবধানতা শরীরে এসে যায়। সেই সাবধানতা লেখাটিকেও সাবধানী করে তোলে। সাবধানী সেই লেখার প্রতিটি শব্দই সেই উপসংহারে যেন সুতোর ওপর দিয়ে হাঁটে। কথাটি ঠিক হলো না। সুতোর ওপর দিয়ে হাঁটার কাজের মধ্যে দীর্ঘ দীর্ঘ অভ্যাস নিহিত থাকে, যা শেষ পর্যন্ত পারদর্শিতা হয়ে ওঠে, নির্ভুল পারদর্শিতা হয়ে ওঠে। আমি সেই পারদর্শিতার নিত্য নির্ভুলতার ওপরও নির্ভর রাখিনি। জানি–অভ্যাস খুব বিপজ্জনক নির্ভর।
এত সাবধানতা সত্ত্বেও শেষ রক্ষা হলো না।
গল্পটা আমাকে একেবারে ছেড়ে চলে গেল, শবদেহের মতো। কে শবদেহ সেটাও নির্ণয় করা যায় না। একটা জীবন্ত অস্তিত্ব যখন অজৈব বস্তু হয়ে যায় তখন তো সে তার চারপাশকেও অজৈবেরই অংশ করে নেয়। বাকি যেটা থাকে, সেটা তো তার চারপাশে যে-জীবন ছিল সেই জীবন, প্রথা অনুযায়ী তাকে দগ্ধ ও সমাধিস্থ করে অজৈবের অংশ করে নেয়। অন্তত পক্ষে ছ-আট বছর ধরে যে-গল্পটা তৈরি হচ্ছিল, সেই গল্পটা আমাকে ছেড়ে চলে গেল, তার কোনো বিন্দু-বিসর্গ আমার স্মরণে নেই।


চার

এই অভিজ্ঞতাটা আমার কাছে একেবারে নতুন ছিল যে আমার গল্প আমাকে ছেড়ে চলে গেল।
সে-ও তো বছর ছ-সাত কি তার বেশিই হয়ে গেল।
গল্পটা আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর অভ্যাসবশে হয়তো কিছু দিন কিছু কারণ খুঁজেছি : এমন তো কখনো ঘটেনি, তা হলে এই গল্পে হলো কেন।
এরও একটা স্বাভাবিক উত্তর জুটে যায়–মানুষ তো চিরকালই বেঁচে থাকার কথা, মাত্র এক দিনই মরে যাওয়ার কথা, যে-দিনের পর আর বাঁচা বলে থাকে সেই বাঁচা যায় না।
এ-সব কথা ঠিক যুক্তি না হলেও, একটু অস্পষ্টতাসহ প্রায় যুক্তির মতোই শোনায়, একটু ভাবুকতাসহ। সান্ত্বনা হিসেবে দু-এক সময় কাজে লাগে।
আর, আমার গল্প যে আমাকে ছেড়ে গেল, সেটাও তো দেখতে-দেখতে বছর কয়েক, প্রায় বছর ছ-সাত হয়ে গেল। ইতিমধ্যে ডিজিটাল টেকনোলজি প্রায় পৃথিবীর প্রথমতম কৃষি-উৎপাদনের মতো জায়গায় পৌঁছে গেছে। ডাইমেনশিয়া, অ্যামনেশিয়া এই সব শব্দের মধ্যে যে-সক্রিয়তার সংকেত নিহিত ছিল, সেগুলো আর সংকেতমাত্র নেই। টেকনোলজি এখন স্বাধীন ও স্বকীয়তা অর্জন করে ফেলছে যে তার সঙ্গে মানুষের সচেতনতার কোনো সম্বন্ধই প্রয়োজনীয় থাকবে না। তা হলে এমনও তো হতে পারে–ঐ গল্পটির ঐ উপসংহারে সমস্ত অভিজ্ঞতা ও অভ্যাস সত্ত্বেও আমি গল্প তৈরির প্রক্রিয়াটাই সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলাম। গল্প বা কবিতা তৈরি মানুষের মস্তিষ্ক বা শরীরের আবশ্যিক অনিবার্য কাজ নয়, যেমন চোষণ বা সঞ্চরণ, সুতরাং কোনো একটা বিন্দুতে একটা গল্প তার লেখককে ছেড়ে যেতে পারেই–এটা এমন কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনাই নয়। তা ছাড়া আমার তো পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল ও এখনো আছে যে, যে-জায়গাতে গল্পটা আমাকে ছেড়ে গেল, সেই জায়গাটিতেই লেখাটি শেষ করে দেওয়ার। এখনো তো তেমনই পারি। সুতরাং, একদিক থেকে তো গল্পটা শুরুতে যেমন আমার ছিল, যে-জায়গায় সে আমাকে ছেড়ে গেল, সেই জায়গাতেও সে আমারই ছিল।
এ-সব যুক্তি, প্রায়-যুক্তি, ভাবনাচিন্তা, ইত্যাদিও পুরনো হয়ে গেছে। আমার লেখালেখির কোনো কাল্পনিক সীমার মধ্যেও আর সেই গল্পের অসমাপ্তির কোনো অস্তিত্ব নেই।
কয়েক দিন আগে, আমার ছেলে, বৌমা, নাতি, নাতনি আমার কাছে এসেছিল।
এখন তো এমন আসা-যাওয়াই দস্তুর। আমার বৌমা, নাতি-নাতনিকে নিয়ে এলো পশ্চিমতম ভারত থেকে, বাধ্যত ট্রেনে, কারণ, প্লেনে প্রয়োজনীয় সংযোগগুলো ঘটাতে দুটো দিন নষ্ট হতো, মূল্যবান দুটো দিন। আর, আমার ছেলেকে পৌঁছুতে হলো দেশের পূর্বতম প্রান্ত থেকে, প্লেনের ভিতরে তার যত ঘণ্টা কাটল, তার চাইতে অনেক বেশি কাটল নানা রকম এয়ারপোর্টে প্লেনের জন্য অপেক্ষায়।
মানুষের দেখাসাক্ষাৎ এত কমে গেছে, যাতায়াত এত বেড়ে গেছে, বাড়িঘরও তো ক্রমেই বাড়ছে। আমার ছেলে-বৌমার সঙ্গে যদি কথা বলা যেত, তা হলে। তাদের এই ধাঁধায় ফেলা যেত–কলকাতার এয়ারপোর্ট-উপকণ্ঠে এক হাজার বর্গফুট এই জায়গাটা কেন তাদের নিজেদের বাড়ি মনে হয়, তবে, তাদের একমাত্র উত্তর হতো–তুমি আছ বলে।
কথাটা, বলা বা না-বলা, এই অনুভবটা খুব মহৎ। মানুষ এখনো কোনো-না-কোনো আইকন, বিগ্রহ বা কেন্দ্র খোঁজে।
এক মেঘলা বিকেলে ওরা বলল, ‘বাবা, যাবে? কাছেই একটা খুব সুন্দর নতুন জায়গা তৈরি হয়েছে। একটা জলাভূমি। ওয়াটারস্পেস। হাঁটতে হবে না। ‘একান্তে’।
‘সে কী রে? কোথায়?’
‘এই একেবারে কাছে। নিউটাউনে। তোমার খুব ভালো লেগে যেতে পারে। চলো-না!’
তখন প্রায় শেষ-বিকেল ও আসন্ন-সন্ধ্যা। এটা এমন লগ্ন–যখন জলস্থানের ভিতর রহস্য উঠে আসে। আমার সে অভিজ্ঞতা আছে। আনুভূমিক জল যেন আকাশের দিকে উঠতে চায়। নদী হলে অবিশ্যি অন্য রকম আকার নেয়।
জিজ্ঞেস করি, ‘এদিকে তো নদী নেই–’
ওরা বলে, ‘নদী না, নদী না, অন্য রকম জল, শুধু জল কিন্তু বইছে না।’
‘বা, হয়তো অন্য সময় এক রকম বয়।’
আমি একটু বেশি সাবধান হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘পাটুলির দিকে কী একটা ফ্লোটিং মার্কেট করেছে। তেমন কিছু নয় তো?’
ততক্ষণে আমার নাতনি আমাকে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করেছে, নাতি পেছন থেকে ধাক্কা দিচ্ছে। আমি বাধ্যত এগোচ্ছি।
নিউটাউনের জায়গাগুলির নাম আমি জানি না। সব রাস্তাই চওড়া, সব রাস্তাই ফাঁকা, সব রাস্তাই অনেক গোলচাক্কি পার হয়ে বয়ে যায়, সব রাস্তাই যেন অনেক দূরের নিশানা দেয়। গাড়ি চালিয়ে সুখ। গাড়ি চড়েও সুখ–যদি কোথাও যাবার না থাকে। মিছিমিছি গাড়ি চড়তেও বেশ ভালো লাগে।
যেকোনো জায়গাতেই থামা যায়–এমন একটা স্বাধীন পরিসরে ওরা গাড়ি দাঁড় করাল। বা, হয়তো ড্রাইভার, জানেই–ওটাই দাঁড়াবার জায়গা।
নেমে, দাঁড়িয়ে দশদিকে চোখ বুলোতে-বুলোতে মনে হলো–সেই দশ বা ততোধিক দিক আমাকে লুপ্ত করে নিল।
এমন প্রান্তর পেরুনো আমার সত্তার গভীরতমে প্রোথিত–জন্মান্তর থেকে। এ প্রান্তরে আকাশমুখী কোনো উত্থান ছিল না। কিংবা, আমি সেই জন্মান্তরের অভিজ্ঞতায় জানি এই প্রান্তরের ব্যাপ্তি এতটাই যেকোনো আকাশমুখী উত্থান এ-প্রান্তরের পরিধিকে অতিক্রম করতে পারে না।
তখন, ততটা সন্ধ্যা ঘটেছে, পরিসরের ব্যাপ্তিতে যে-সন্ধ্যা তত গভীর হয় না। সারাটা রাত এমন সন্ধ্যাই থাকে। আর চারদিকে আমাদের ঘিরে ঘিরে শুধুই জল ও শুধু জলই বলে অনির্দিষ্ট আকাশের প্রতিফলনে সন্ধ্যা অনেক তরল ও তরলতর হয়ে আছে। জলে পা ভেজে না। কাঠের সাঁকোর পথ দিয়ে জলের ওপর দিয়েই প্রায় হাঁটা যায়। সাঁকোগুলি ততই চওড়া যে অটোর মতো কিছু যান যাতায়াত করতে পারে। ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, হাঁটতে পারবে? না, অটো নেব?’ আমি বললাম, ‘হাঁটছি তো–’।
ততক্ষণে আমি পুরো নকশাটা বুঝতে পেরেছি ও অত্যন্ত দ্রুত, খুব গভীরে, সেই বুঝে-ওঠা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছি ও প্রকৃতির আদি ও স্বাভাবিক নকশাহীনতায় ঢুকে পড়তে চাইছি–যে-নকশাহীন প্রকৃতি এই বাণিজ্যিক জলাঞ্চলের উৎস, যে-নকশাহীন প্রকৃতিকে এই পরিকল্পিত পরিসরে প্রতিবিম্বিত করা হয়েছে।
তেমন জলময় অসংখ্য প্রতিবিম্বনে, যার কিছু-বা খুব দুর্নিরীক্ষ্য গতিবান রেখাময়, আমি দেখে ফেলি : যে-গল্প আমাকে অপ্রস্তুত ছেড়ে চলে গিয়েছিল, সেই কবে, প্রায়, হতেও পারে দশ বছর আগে, সেই গল্প আমার কাছে ফিরে আসতে চাইতে ও সেই সব ঘটনাই জলে প্রতিবিম্বিত হয়ে আকাশের দিকের শূন্যতায় ক্রীড়াময় হয়ে উঠছিল–এমন ক্রীড়ায় যা ৭০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৫০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত হাজার-হাজার বছরকে বাস্তব করে তুলছে।
কিন্তু কোনো একটা কারণে সেই ঘটনাপুঞ্জ আমার দিকে এগোতে পারছে না।
এমন কিছু দুর্বোধ্য কারণ নয়।
আমার গল্পের সাঁকো তৈরি হয়নি। সেই সাঁকো তৈরি হয়ে উঠলে সমস্ত ঘটনা যথাকল্পিত ঘটে যেতে থাকবে।
গল্পের ঠাকুরের কাছে একটু বসে থাকতে এসেছি।
এমনকি সম্ভব–গল্পের এমন ফিরে আসা? অথবা এ অন্য কোনো গল্পের ভগ্নাংশ?
আমার দেখায় কি কোনো বিভ্রম ঘটেছে?
যে-গল্প আমাকে প্রত্যাখ্যান করে গেল–চার বছর ধরে আশি হাজার শব্দ লেখার পর, সে কি আর আমার থাকে?


পাঁচ

গল্পের ঠাকুরের ঘরের দরজাটা খোলাই ছিল–সাধারণত বন্ধই থাকে। দরজা খোলার জন্য একটু অপেক্ষা করতে হয়। আজ তো দেখছি হাটখোলা। অনেক দিন আসা হয়নি। এর মধ্যে ঠাকুর আবার পার্ট-টাইম অন্য ব্যবসা ধরেছে কী না, তাই-বা কে জানে। একটা ইনকামে আজকাল একজনেরও ঠাকুরগিরি চলে না।
আমি ঠাকুরের ঘরের ছড়িয়ে থাকা টুন-ঠুলের মধ্যে বেশ অসুবিধেজনক একটা টুলের মতো জায়গায় বসলাম। ঠাকুরদের ঘরে সবই থাকবে নৈবেদ্য রাখার জন্য। একজনের সুবিধেজনক বসার জন্য যতটুকু জায়গা দরকার হয়, কোনো নৈবেদ্যের থালা কি তার চাইতে বড় হতে পারে? এটা তো, দেখে মনে হচ্ছে, নৈবেদ্যের ঘরে বদলে গেছে, তা হলে আমি নৈবেদ্য হয়েই বসি, নিজেকে যতটা অস্বস্তিকর দেখানো যায়। ঠাকুরের চোখ ভালো, আমার ঠাট্টাটা তাঁর দৃষ্টি এড়াবে না।
একটু পরে ভিতর থেকে বেরিয়ে ঠাকুর আমাকে আবিষ্কার করলেন, ‘আরে তুমি? কতক্ষণ? এতদিন আসোনি যে ভাবলাম তুমিও বোধ হয় পাড়ি দিয়েছ। বছর খানেক তোমাদের কিন্তু বেশ মড়ক লেগেছে, লেখকদের মধ্যে। সেটা ভালো।’
‘এর মধ্যে ভালোটা কী দেখলে, ঠাকুর।’
‘বাঃ, মরা মানেই তো অমরত্বের কাছাকাছি যাওয়া। না মরলে অমর হবে কী করে। তোমরা তো অমরত্বের জন্যই লেখো, না কী?’
‘এ সব বুজরুকি কবে থেকে প্র্যাকটিস করছেন। মার্কেটের কোনো খবর-টবর রাখেন?’
‘কী খবর?’
‘কীসের মার্কেট?’
‘আপনি কীসের ঠাকুর?’
‘আরে, ঠাকুর হলে গেলে কি আর কেউ একটা কিছুরই ঠাকুর থাকে? ঠাকুর-হওয়াটা কঠিনও বটে, তেমন কঠিন নয়ও বটে। আসল ব্যাপারটা হলো লোকজনকে বিশ্বাস করানো যে তুমি ঠাকুর। আমার তো একটা সাইড বিজনেস জুটেছে ঠাকুরগিরির–একটু-আধটু মন দিলে দাঁড়িয়ে যেতে পারে গো–।’
‘আমার ঢুকেই তেমন সন্দেহ হয়েছিল। তবে বেশি গন্ধ নিইনি।’
‘এই-যে বাইপাসের চারপাশজুড়ে কত বড়-বড় প্রাইভেট হাসপাতাল হয়েছে–খেয়াল করো?’ ‘খেয়াল না করে উপায় আছে? বাইপাস দিয়ে যাতায়াত করতে করতে প্রত্যেকটা পোস্টে তো রংচঙে ছবি, দেখতে দেখতে মনে হয়, কী রে বাবা, বেঁচে আছি তো? আর ভাষাগুলো যেন বাড়ির লোক জিজ্ঞেস করছে–‘আপনার প্রস্রাবের দিকে নজর রাখেন তো?’ আচ্ছা, বলো তো ঠাকুর, পেচ্ছাব আবার একটা রঙিন ছবি, ‘প্রস্টেট যদি সন্দেহ হয়, সারিয়ে নিন। নইলে বিপদ ঘটতে পারে।’ ব্যস, হয়ে গেল। ভাগ্যিস চারদিকে এত গোলমাল, ‘জয় হিন্দ’, ‘জয় বাংলা’, ‘জয় রাম’ নিয়ে–তাই মানুষজন আত্মরক্ষায় ব্যস্ত, এক প্রস্টেট নিয়ে বেশিক্ষণ সময় দিতে পারে না নইলে তো প্রস্টেটই জীবন খেয়ে নিত। আবার একটা পোস্ট থেকে শুরু হলো, ‘অকেজো হাঁটু নিয়ে বসে দিন কাটানোর চাইতে হাঁটুটা বদলে ফেলা কিন্তু অনেক বেশি সহজ।’ এত সুন্দর ছবি, ভাষা। লোভ হয়।
‘নিজের সুস্থ অঙ্গের চাইতে বিকৃত অঙ্গের টান বেশি বোধ হয় না কি তোমার?’
‘টান কী না বুঝি না ঠাকুর, সেটাই বিপদ। সে তো একটা মেয়ের বা পুরুষের ভালো সঙ্গত একটি ছবি ভালো লাগতেই পারে। তেমন ছবিও তো বাইপাসের হোর্ডিংগুলোতে থাকে, বারে বারে দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এ তো সে-রকম নয়। আমার শলীরের একটা সম্ভাব্য দুষ্ট অঙ্গের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতার এমন হেরফের ঘটিয়ে একটা ছবি টাঙানো হয়, যেটাকে আমি এক পলকে আমার হাঁটুর ছবি বা হৃৎপিণ্ডের ছবি বলে চিনতেই পারি না। আর, সেই অচেনা সুন্দর ভয়ংকর হয়ে। দু-একটি ইংরেজি শব্দের ধাবমানতায়। ভয় ছড়িয়ে পড়ে ঐ ছবির সুন্দর থেকে–আমার শরীরের ভিতরের ভয়, ভয়, ভয়। আমি জানি ঠাকুর এমন ভয় আমার একার নয়। আমি এও জানি, ঠাকুর, এমন ভয় আমার একার নয়। আমি এও জানি, ঠাকুর, এমন ভয় আমার একার নয়। আমি এও জানি, ঠাকুর, এই সুন্দর সন্ত্রাস আমাদের তাড়া করছে বা ঘিরে ধরছে। আমি যা লিখি তাতে এই সুন্দর সন্ত্রাসের কথাও না লিখে পারি না। কিন্তু, ঠাকুর, কিছুতেই সেই সন্ত্রাসটাকে সন্ত্রাস বলে প্রমাণ করতে পারি না। হতে পারে কোনো তুক আছে, যা আমার জানা নেই। তাই এই হারানো গল্পটাকে নিয়ে ঝুলবার আগে আপনার কথা একটু শুনতে এলাম।’
‘আমার কথা শুনতে আসোনি গো, তোমার প্রশ্নটা তৈরি করতে এসেছ। তা তো ভালোই তৈরি করেছ–সুন্দর যখন অবধারিত সন্ত্রাস। তুমি অবিশ্যি এতটা স্পষ্ট করে বোঝোনি। বা, বলোনি। ঐটুকু পুষিয়ে নিয়েছ। সুন্দরই যখন অবধারিত সন্ত্রাস। অবধারিত সন্ত্রাস।’


ছয়

ইউসুফে তো জুলেখার ন্যায্য অধিকার। নিজের জন্মের আগে ইউসুফ জুলেখাকে তিন-তিনটি স্বপ্নে জানিয়েছে যে সে ইউসুফই জুলেখার স্বপ্নপুরুষ। ইউসুফ তার পরিচয়ও জুলেখাকে জানিয়েছে–সে আজিজমিশর। মিশরের রাজা। সেই তিনটি স্বপ্নের ভিত্তিতে জুলেখা কামবতী হয়েছে, তার কামকে একমুখী রেখেছে ও উত্তাল গভীর করেছে। বিস্মিত তৎকালীন আজিজ মিশরের শর্ত মেনে জুলেখা মিশরের সীমান্তের মধ্যে নিজের বিবাহ সম্পন্ন করেছে ও সেই বিবাহের আগেই সে জেনে ফেলেছে যে এই যে-বরবেশী আজিজমিশির সে তার নির্ধারিত স্বপ্নপুরুষ নয়। তবু জুলেখা নিজের রতির নিশানা ঠিক রেখেছে। সে নিজের রতি রক্ষা করতে পেরেছে।
অবশেষে জন্মজন্মান্তর পেরিয়ে ইউসুফ যখন দাস হয়ে তার কাছে এলো, তখন জুলেখার তো ইষ্টপ্রাপ্তি ঘটল ও ইউসুফের প্রতিশ্রুত স্বপ্নজীবন যাপনের সম্পূর্ণ একক অধিকার জন্মাল তার। সে, জুলেখাই তো ইউসুফের স্বপ্ন ও জন্মমোতাবেক স্বপ্নপুরুষ।
কিন্তু, এর ভিতর, এই হাজার-হাজার-হাজার বছরের জীবনান্তরগুলির মধ্যে ইউসুফের একটা বিস্মরণ ঘটে গেল–সে দাস হিসেবে নিজের প্রথম প্রাধান্য প্রমাণ করতে চায় ও সেই তার জীবন-অভিযানে অন্য তার সব পরিচয় লুপ্ত হয়ে গেল, এতটাই, যে ইউসুফের ওপর তার কামনার ও স্বপ্নের অধিকার কায়েম করতে ইউসুফের কামিজের একটি অংশ তার তীব্র মুষ্টিতে ও নখরে ছিঁড়ে ফেলে আর ছিন্ন সেই কামিজ পরে দৌড়াতে-দৌড়াতে ইউসুফ কারাগারে ঢুকে পড়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে।
এই বিপরীতের জীবন ইউসুফ ও জুলেখাকে বিদীর্ণ করে ফেলল।
যে-ইউসুফ তার নিজেরও জন্মের আগে জুলেখাকে ধারাবাহিক তিন-তিনটি স্বপ্ন দেখিয়ে জুলেখার কামনার শরীরকে প্রবাহমান ও খরস্রোতা করে তোলেও তার সেই একমাত্র স্বপ্নপুরুষ হিসেবে আত্মপরিচয় দিয়ে নতুন জন্মের জন্য নতুন গর্ভে প্রবেশ করেছিল ও তার পর সেই নতুন জন্মে ও জীবনে, নতুন জন্ম ও জীবনের রীতি অনুযায়ী গভীর কূপের ভিতর অন্ধ পাখিদের আবর্তনময় আশ্রয়ে বেঁচে থাকে ও শেষে এক যাযাবর বণিক কতৃক উত্থিত হয় ও দাসের জীবনযাপন শুরু করে, বাধ্য হয়ে নয়, স্বেচ্ছায়, সেটাই তার আল্লাহ-নির্দিষ্ট জীবন এমন গভীর বিশ্বাস থেকে ও দাস হিসেবে এক রাজকোষ মূল্যে আজিজমিশিরের ছুতোয় আসলে জুলেখার কাছেই বিক্রীত হয়, সেই জন্মান্তরিত ইউসুফ, কীনা অন্তরে-বাহিরে জুলেখার অস্তিত্ব একেবারে অস্বীকার করে আর আত্মরক্ষার উদ্দেশে কারাগারে আশ্রয় নেয় ও কারাগারকেই সে দাসের কর্তব্য পালনের যোগ্যতম স্থান হিসেবে গড়ে তোলে স্বপ্নের অর্থ সঠিক বলে দিয়ে ও সেই স্বপ্নপাঠ অনুযায়ী দেশের অর্থ-ব্যবসা-বিনিয়োগ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে করে আর তার বিপরীতে জুলেখা তার ন্যায়সঙ্গত যৌবন, কামনা ও তৃপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে নিজের ভিতরে এক সিক্ততাহীন মরুভূমির প্রসার ঘটাতে থাকে–তার স্বপ্নজাগ্রত যৌবন বৃথা যায় আর ইউসুফের স্বপ্নপাঠবিদ্যা থেকে মিশর সুজলা-সুফলা-শস্যভান্ডার পূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। ইউসুফ শেষ পর্যন্ত আজিজমিশির পদে বাধ্যত উন্নীত হয়, কিন্তু জুলেখা দুই-দুই আজিজমিশিরের নির্বাচিত দয়িতা হয়েও তার শরীরের অন্তর্নিহিত অনিবার্য ঈষরতা নিবারণ করতে পারে না। মিশর এই দুই অস্তিত্বে দীর্ণ হয়ে যায়।
ইউসুফ যখন কারাগারেই গোপনে বসবাস করছে তখন মিশরের রাজার মদের ভাঁড়ারি ও তার বেকার রাজার বিরক্তির কারণ হওয়ায় তাদের জেলখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো, ঐ একই জেলখানা, যেখানে জোসেফ প্রায় আত্মগোপন করে ছিল। জোসেফ তাদেরও খিদমত খাটত।
তারা দুজনই একটা স্বপ্ন দেখল।
দুজনই একটা স্বপ্ন দেখল কিন্তু আলাদা-আলাদা করে, সে-স্বপ্ন দুটো দেখা দিলো ও মিলিয়ে গেল। জোসেফ সকালে এসে দেখে সেই মদের ভাঁড়ারি ও বেকার, দুই অফিসার মন খারাপ করে বসে আছে। তাদের মন খারাপ কেন জিজ্ঞেস করায় তারা বলল–তারা দু-দুটো স্বপ্ন দেখে রাত কাটিয়েছে কাল কিন্তু স্বপ্নের মানে বলার মতো কেউ এই জেলখানায় নেই।
জোসেফ বলল, ‘স্বপ্ন তো দেন ভগবান, কেন দেন তা তিনিই একা জানেন। তবু বলে দেখতে পারেন, আমি একটু চেষ্টা করতে পারি।’
মদের ভাঁড়ারি বলল, ‘দেখেছি ফ্যারাওকে গ্লাস দিচ্ছি, এমন সময় কোত্থেকে একটা ডাল এসে পড়ল, তাতে তিনটি আঙুর। আমি সেগুলোকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ফ্যারাওয়ের গ্লাসে চিপে দিলাম।’
জোসেফ বলল, ‘তিন দিনের মধ্যে আপনি ছাড়া পাবেন ও পুরনো কাজটাই পাবেন।’ সত্যি তাই হলো, তিন দিন পর ছিল ফ্যারাওয়ের জন্মদিন। সেই উপলক্ষ্যে ভাঁড়ারি ছাড়া পেল আর পুরনো চাকরিটাও পেল।
বেকার বলল, সে স্বপ্ন দেখেছে–সে তিনটি ঝুড়ি মাথায় করে যাচ্ছিল, ভিতরে ছিল রুটির কাঁচা টুকরো। পাখিগুলো সেই টুকরোগুলো ঠোকরাচ্ছিল।
জোসেফ বলল, ‘তিন দিনের মধ্যে ফ্যারাও তোমাকে কোতল করে গাছের মাথায় ঝুলিয়ে দেবে আর পাখিরা তোমাকে ঠোকরাবে।
সে স্বপ্নটাও তেমনি ঘটল।
এই ঘটনার দু-বছরের মাথায় ফ্যারাও নিজেই স্বপ্ন দেখলেন, বলা চলে একসঙ্গে দুটো স্বপ্ন, বেশ লম্বা স্বপ্ন। ফ্যারাও নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন আর নদী থেকে সার বেঁধে উঠল সাত-সাতটি তিমি মাছ–কী পুষ্ট, তেলওয়ালা, লম্বা। তারপরই উঠল সাতটা রোগা, খটখটে, মাসছুট, সাতটা একই প্রাণী। ফ্যারাওয়ের ঘুম ভাঙল না। কিন্তু তার স্বপ্ন বাড়তেই লাগল। একটা ধানের বা গমের দাঁড়ায় কতগুলো মোটা মোটা দান লেগে আছে। কী ভালো ফসল, দেখলেই মনে হয় ঐ দানাগুলো কত মানুষের ক্ষিধে মেটাবে। কিন্তু তার পরেই সেগুলো হয়েছে দাঁড়াল খিটখিটে পাটকাঠি, কোনো একটা লোকও চিবুতে পারবে না।’
সকাল থেকে ফ্যারাও বিমর্ষ হয়ে তাঁর রাজত্বের সমস্ত জাদুকর, জ্যোতিষী ও স্বপ্নপাঠকদের ডেকে তাঁর স্বপ্নের অর্থ জিজ্ঞেস করেছেন। কেউ কোনো অর্থ বলতে পারেনি। ফ্যারাও আরো বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন। স্বপ্নের অর্থ জানার আগেই ফ্যারাও অসুস্থ হয়ে না পড়েন এমন দুশ্চিন্তা রাজপুরিকে ছেয়ে ফেলেছে।
ফ্যারাওয়ের প্রাসাদে সূর্য তার প্রথম রশ্মি ফেলে। সেই রশ্মি আজ মলিন। যেন মনে হচ্ছে–সূর্য তার রশ্মিপাতে কোনো বিভ্রম ঘটিয়ে ফেলেছে অভাতে। ফ্যারাও তাঁর প্রাসাদে থাকেন বটে কিন্তু কেউ তো তাঁর দেখা পায় না। তিনি তাঁর ক্ষমতার স্বীকৃত শীর্ষে একক। তিনি আছেন–এটাই এই মর্ত্যবাসীদের সবচেয়ে বড় আশ্বাস। সেই ফ্যারাও যদি স্বপ্নের অর্থহীনতায় আক্রান্ত হয়ে তার মীমাংসা খুঁজে না পান–সেটা তো প্রায় এই পৃথিবীর ধ্বংসের মতো কারণ হয়ে উঠতে পারে। সূর্য তাঁর প্রাসাদে প্রথম রশ্মি ফেলেন তিনি যদি কোনো নিদ্রাভঙ্গের পর আবিষ্কার করেন যে তাঁর অসীম সাম্রাজ্যে এত মানুষ থাকা সত্ত্বেও এমন বিশেষজ্ঞ কেউ নেই যে তাঁর নিদ্রার বিপরীত দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারে ও নিদ্রার ভিতরে স্বপ্নের কারিগরির হদিস দিতে পারে। এই এমন যুগ যুগান্ত সঞ্চিত সংস্কারেই তো ফ্যারাও এমন শক্তিমান যে তাঁর ক্ষমতা তাঁকে তাঁর মৃত্যুর মতো নিদ্রার পরও জাগরুক রাখে–নইলে পিরামিডগুলো তৈরি হয়েছে কেন, তা হলে মৃত ফ্যারাওয়ের শক্তিরক্ষার জন্য এমন চিরকালীন ব্যবস্থা কেন। ফ্যারাও যদি নিজের নিদ্রাটুকু ভেদ করতে না পারেন, তা হলে ফ্যারাওয়ের অস্তিত্বের নিহিত শক্তি কোথায়?
অব্যাখ্যাত স্বপ্নের ভিতর থেকে ফ্যারাওয়ের অস্তিত্বের প্রশ্ন যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, তখনই সবচেয়ে বড় সংকট।
তা হলে জ্ঞানবিজ্ঞানের যে অধিকার ফ্যারাওয়ের রাজত্বকে এমন স্থায়িত্ব, ব্যাপ্তি ও প্রতিষ্ঠা দেয়, গণিতবিদ্যার ওপর যে-অধিকার ভৌতিক কল্পনাকেও পরাস্ত করে ও রসায়নবিজ্ঞান যেখানে মৃত্যুর ক্ষয়কে পর্যন্ত নিবারণ করতে পারে আর হাজার হাজার শ্রমিকের মিলিত শ্রমের সংগঠিত বিনিয়োগ যেখানে গণিতশাস্ত্রের নির্ভুলতায় পিরামিডের সৌধ নির্মাণ করে চলে, আসলে তো ফ্যারাওয়ের সে রাজ্য সামান্যতম ঘুমের প্রচ্ছদও ভেদ করতে পারে না। পারে না। ফ্যারাও এতই অসহায়, অসহায়তম। তা হলে মানুষ বাঁচবে কী করে?
ফ্যারাওয়ের মতো ক্ষমতাবান ও এই জগতের অধীশ্বরও তাঁর সমস্ত শক্তি নিয়ে একটা স্বপ্নের অর্থ জানতে পারছেন না–এমন অসহায়তাই কিন্তু পরিস্থিতিটাকে বদলে দিচ্ছিল–ক্ষমতার অধীশ্বরকে ক্ষমতাহীন দেখলে, সেই ক্ষমতার পরিধির মধ্যে যারা বাস করে, তারাও ক্রমেই অসহায় হয়ে যেতে থাকে। মিশরে, মিশরজুড়ে সেই অসহায়তাবোধ মারির মতো ছড়িয়ে পড়ছিল এক সপলের মধ্যে। যারা সারা জীবনে কখনো হয়তো মাত্র একবারের জন্য ফ্যারাওয়ের মুখদর্শন করার সুযোগ পায়, তারা আজ রাজসভা ছেয়ে ফেলেছিল। তাদের এক সারিতে মিশরের বিখ্যাত সব পণ্ডিতরা বসে আছেন। তারা ফ্যারাওয়ের স্বপ্নগুলো বারবার শুনেছেন কিন্তু একজনও কেউ সে স্বপ্নের পর্দা একটুও নাড়াতে পারেননি। তাঁরা তাঁদের চর্চিত বিদ্যার সব পদ্ধতি ফ্যারাওয়ের সামনেই ব্যবহার করেছেন এটা প্রমাণ করতে যে তাঁরা তাঁদের আবিষ্কৃত ও ব্যবহৃত সব পদ্ধতিই এমন প্রকাশ্য করে দিয়েও ফ্যারাওয়ের দৃষ্ট স্বপ্নের কোনো একটি দিকের পর্দাও ভেদ করতে পারছেন না।
বিদ্যাচর্চার পদ্ধতিগুলো ফ্যারাওকে ঘিরে এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। কেউ সেগুলো পরিষ্কার করে ফেলার ঔচিত্য বিবেচনা করেনি। যে পদ্ধতি ফ্যারাওকে তার স্বপ্নের অর্থ বলতে পারেনি, সে পদ্ধতিগুলো তো খেলনা মাত্র, ফ্যারাওয়ের। এখন। কিন্তু সেগুলি তো পদ্ধতি হিসেবে আবিষ্কৃত ও স্বীকৃত। তাদের প্রয়োগ ও প্রয়োজন যে শেষ সেকথা ঘোষণা করার অধিকার তো এক ফ্যারাওয়ের তাঁর রটিত ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রয়োগে। কিন্তু যে-মানুষটি এই পদ্ধতিগুলোর ভিতর ব্যালোল-স্বভাব শিশুর মতো গড়াগড়ি দিচ্ছে ও তার মুখ দিয়ে লালা পড়ছে ও সে লালা মুছিয়ে দেওয়ার কোনো পদ নির্দিষ্ট হয়নি বলে মোছানো হচ্ছে না। বেলা যত বাড়তে লাগল ফ্যারাওয়ের এই শারীরিক পতন যেন, যেন-বা তার শক্তির পতনের প্রতীক হয়ে উঠতে লাগল। ফ্যারাওয়ের উবেশনের বা গড়াগড়ি দেওয়ার জায়গাটি ঘিরে দর্পণ সাজানো থাকে–এটা তাঁর ক্ষমতার নিশ্চয়তার প্রতীক যে তিনি নিজেকে ছাড়া দশদিকে আর কাউকে দেখতে পান না। কিন্তু এখন সমবেত সাধারণ মানুষও দেখছে, দশদিকে সাজানো দর্পণে একটি শিশু যেন ব্যাহতবুদ্ধি নিয়ে অর্থহীন লালসিক্ত হাসি হেসে চলেছে ও ঐ দর্পণগুলির প্রতিবিম্ব–অক্ষম বিপরীত দিকের নিরেট অন্ধকার জানান দিচ্ছে দশদিকজুড়ে যে ফ্যারাওয়ের ঐশ্বরিক ক্ষমতা শেষ হয়ে যাচ্ছে, যেন তিনি আর সেই পুরনো ফ্যারাও থাকছেন না। এটা, এমন একটা সন্দেহ, যতই বেলা বাড়ছিল, ততই যেন প্রাধান্য পাচ্ছিল। আর, দু-একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ফ্যারাওয়ের এই দশা দেখে সমাবেশস্থল থেকে চলে যাচ্ছিলেন এমন গুজবকে সত্যের আভাস দিয়ে–যে-রাজত্বের প্রধান তাঁর ঐশিতা থেকে প্রকাশ্যে এমন বঞ্চিত হন, সে-রাজত্ব বসবাসের পক্ষে আর নিরাপদ থাকছে না। তাঁদের প্রস্থানের মধ্যে কোনো সমবেত সিদ্ধান্ত প্রকট হচ্ছিল না যদিও, তবুও, তাঁদের প্রস্থানের ত্রস্ততা সেই সত্যকে আর ঢাকা দিতেও পারছিল না।
ফ্যারাও তাঁর স্বপ্নের অর্থ জানতে পারছেন না। তাঁর এই ব্যর্থতা শাসক ও ক্ষমতাধারী হিসেবে তাঁর পঙ্গু তো করছিলই কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই পঙ্গুতা তাঁর শরীরেও লক্ষিত হতে লাগল। সেই লক্ষণগুলি থেকে এমন কথাও ধীরে ধীরে আভাসিত হচ্ছিল যা গভীরতর ব্যাখ্যায় এমন কথাও হয়ে উঠতে পারে–যে-শাসক তার নিজের দেখা স্বপ্ন ভেদ করতে পারেন না, তিনি কোন বলে তাঁর প্রজাদের রক্ষা করবেন। কিন্তু এমন রাজদ্রোহ জনসাধারণ নিজেরা নিজের চোখে পরীক্ষাও করতে চাইছিল। তাই স্বপ্নরুদ্ধ ফ্যারাওকে ঘিরে ভিড় বাড়ছিল।
রাজধানীতে যে সব গুজব ছড়াচ্ছিল সেগুলোকে সাজানো যায়। সত্যি কি ঈশ্বর ফ্যারাওয়ের ওপর থেকে তাঁর প্রতিশ্রুত আশ্রয় প্রত্যাখ্যান করেছেন। সেই প্রত্যাখ্যানের লক্ষণ কি ফ্যারাওয়ের চলাচলে ও ব্যবহারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে?
অর্থাৎ, ফ্যারাওকে শারীরিকভাবে দেখা, প্রত্যক্ষ করা ও নিজের নিজের সিদ্ধান্ত করার একটা সুযোগের হাওয়া মিশরে ফ্যারাওয়ের প্রাসাদ ঘিরে ঘুরপাক খেতে খেতে গতিমুখই পেয়ে যায় বুঝি-বা।
প্রাসাদ ঘিরে এমন গুজবে মিশরবাসীরা অভ্যস্ত। প্রথমে দাস-দাসী মহলে এমন গুজব চোখের ইশারায় ও ক্বচিৎ পায়ের গতিতে ধরা পড়ে। প্রতিদিনের অতিবাহিত অলিগলিতে আচমকা কোনো পুরনো দাস হোঁচট খায়, এত জোরে, যে তার হাতের বাসনগুলোর ছিটকে পড়ার আওয়াজ প্রাসাদের অলিন্দে-অলিন্দে প্রতিধ্বনিত পর্যন্ত হয়। পরিচারক যদি বয়স্ক দাস হয় তা হলে সবাই নিশ্চিত হয়ে যায়–প্রাসাদে কিছু একটা ঘটছে।
দাসদাসী মহলের আর বিবিমহলের মাঝখানে একটু বড় ফাঁক।
সেই ফাঁক সত্ত্বেও বিবিমহলে গুজবগুলি প্রথম হাওয়া পায়।
জুলেখা বিবিমহলে থাকে না। তার আলাদা প্রাসাদ। তার কাছে এই জরুরি খবর পৌঁছে যায় : স্বপ্নের কথা জানতে না পেরে স্বয়ং ফ্যারাও শিশু হয়ে যাচ্ছেন ও তাঁর ঐশ্বরিক ক্ষমতা সকলের চোখের সম্মুখে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। জুলেখা নিজের চোখে যাচাই করে ফ্যারাওকে ইউসুফয়ের কথা জানাতে চাইল–এই এক স্বপ্নদ্রষ্টা তার জন্মের আগেই জুলেখাকে স্বপ্ন দেখিয়ে পরে আজ নিজের স্বপ্নে ফিরতে না পেরে ফ্যারাওয়ের বন্দিশালায় আত্মগোপন করে আছে জুলেখার কাছ থেকে আত্মরক্ষা করতে। তাকে কি ফ্যারাও জুলেখার সামনে ডাকতে অনুমতি করবেন?

ফ্যারাও সমীপে     জুলেখা হাজির
          যেন এক শিশু দেখে
নিজের স্বপ্নের     দোরে সেই শিশু
         গুঙারি গুঙারি কান্দে।।
জুলেখা বার্তা     কহে জীবনের
        ইউসুফ নামের এক মানুষ
স্বপনে স্বপনে     আমারে রচিয়া
         স্বপন ভুলিয়া গেল।
তোমারই মতো     সে নিজের স্বপন
         নিজেই ভুলিয়া থাকে।
তারে ডাকা করো     জেলখানা থিকে
         আমার সমুখে খাড়াক।
সে কি পারে আর     আমারে দেখিয়া
         নিজের বানানো স্বপন।
তার পরে তারে     কহ প্রবেশিতে
         তোমার স্বপন ভেদি।
রাজা ‘ইউসুফ’     কহিবার আগে
          ইউসুফ হাজির হয়।
রাজা কহে, ‘দেখো,   এই বিবিজান কি
          তোমার স্বপন হয়?
কহে ইউসুফ,     ‘কত যে জন্ম
       মাঝখানে উজরায়।
আমার স্বপন     আমারই স্বপন
        কতগুলা জন্ম ধরি।
চিনিবার চাই     জন্ম দেয় বাধা
       এ তো মোর
জন্মের আগের স্বপন।
রাজার আদেশে     স্বীকার না গেলে
         পাপ হইবে তো আরো।

ফ্যারাও তারপর তাঁর স্বপ্নের কথা বলে অর্থ জানতে চান।
ইউসুফ বলে–‘স্বপ্ন তো এক ঈশ্বর জানেন। তিনি কী অর্থে কাকে কী স্বপ্ন দেন তা আমরা জানতে পারি না। আপনার স্বপ্নের যে অর্থ আমার কাছে প্রতিভাত হচ্ছে তা হলো : সামনের সাত বছর মিশর দেশে শস্য ফলন এমন হবে যা আগে কখনো হয়নি। কিন্তু পরের সাত বছর দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। তাই ঈশ্বরের নির্দেশ এই অধিক ফলনের সাত বছর সব ফলন ব্যবহার না করে মজুত করতে হবে যাতে পরের সাত বছর আকালের সময় মিশর ঐ সঞ্চিত শস্য বিক্রি করে আকাল কাটাতে পারে।’
ইউসুফয়ের জুলেখা-স্বীকারোক্তি থেকেই ফ্যারাও তার রাজকীয়তা ফিরে পেতে শুরু করেছিলেন আর স্বপ্নের অর্থ শোনার পর ফ্যারাও সম্পূর্ণ রাজবেশে আদেশ দেন–
তোমারে আমি দেই
আজিজ-মিশিরের পদ,
তোমার উপরে কথা কহিবার
কেহ থাকিবে না। তুমি করো
ব্যবস্থা সারা মিশর জুড়ি এই
চৌদ্দ বছরের। তার আগে
তোমার বিবাহ জুলেখার সনে।

পূর্ণাবয়ব রাজার সম্মুখে ও আদেশে সে বিবাহ সম্পন্ন হয় মুহূর্তে ফেরেশতাগণের অদৃশ্য উপস্থিতিতে ও অদৃশ্য পুষ্পবৃষ্টিতে ইউসুফের স্বপ্নের দুটি স্থগিত শর্ত পূরণ হয়ে গেল : সে সত্যি-সত্যি আজিজমিশির নিযুক্ত হলো ও সে দৈব ও রাজাদেশে বিবাহের ফলে সে জুলেখার যে কামনা কোনো এক জন্মে জাগ্রত করেছিল তা তৃপ্ত করার অধিকার সে পেল।
রাজার আদেশে তার দ্বিতীয় অশ্বে আরোহণ করে ইউসুফ ও জুলেখা সমগ্র মিশর পরিক্রমায় বেরোল।
জুলেখা ব্রতকথা আপাতত এই পর্যন্তই!

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
হলমার্কের দুর্নীতির এক মামলার রায় আজ
হলমার্কের দুর্নীতির এক মামলার রায় আজ
৫ ঘণ্টা পর ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের ট্রেন চলাচল স্বাভা‌বিক
৫ ঘণ্টা পর ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের ট্রেন চলাচল স্বাভা‌বিক
সুইডেনের বিপক্ষে পর্তুগাল দলে জায়গা হয়নি রোনালদোর
সুইডেনের বিপক্ষে পর্তুগাল দলে জায়গা হয়নি রোনালদোর
সর্বাধিক পঠিত
লিটনের বাদ পড়া নিয়ে যা বললেন হাথুরুসিংহে
লিটনের বাদ পড়া নিয়ে যা বললেন হাথুরুসিংহে
পদ্মার গ্রাহকরা এক্সিম ব্যাংক থেকে আমানত তুলতে পারবেন
একীভূত হলো দুই ব্যাংকপদ্মার গ্রাহকরা এক্সিম ব্যাংক থেকে আমানত তুলতে পারবেন
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার
‘সরলতার প্রতিমা’ খ্যাত গায়ক খালিদ আর নেই
‘সরলতার প্রতিমা’ খ্যাত গায়ক খালিদ আর নেই