X
শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫
২০ আষাঢ় ১৪৩২

গুম হওয়া সন্তানের খোঁজে মাটি খুঁড়ে চলেছেন এক কাশ্মিরি পিতা

বিদেশ ডেস্ক
৩১ মে ২০২১, ০৯:২৮আপডেট : ৩১ মে ২০২১, ০৯:২৮

২০২০ সালের আগস্টে ভারত অধিকৃত কাশ্মিরে এক ভারতীয় সেনাকে অপহরণ করেছিল একদল লোক। তার পরিবারের বিশ্বাস, সে আর জীবিত নেই। সেই সৈনিকের পিতা এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছেন তার ছেলের দেহাবশেষ।

মঞ্জুর আহমেদ ওয়াগাই প্রথম যেদিন শুনেছিলেন যে, তার ছেলে শাকির মঞ্জুরকে অপহরণ করা হয়েছে; তার এক দিন পরই পুলিশ তার গাড়িটি খুঁজে পেয়েছিল। আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিল গাড়িটি। সেখান থেকে প্রায় ৯ মাইল দূরে একটি আপেলের বাগানে পাওয়া গিয়েছিল তার হালকা বাদামী রঙের শার্ট আর কালো রঙের টি-শার্ট। সেগুলো ছিল ছিন্নভিন্ন। তাতে লেগে ছিল ছোপ ছোপ রক্ত। এটুকুই, তারপর আর কিছুই পাওয়া যায়নি।

২০২০ সালের ২ আগস্ট সন্ধ্যা। ২৪ বছর বয়স্ক শাকির মঞ্জুর তার নিজ শহর শোপিয়ানে অল্প কিছু সময়ের জন্য ঈদের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাড়িতে গিয়েছিলেন। জায়গাটা হিমালয়ের পাদদেশে, যেখানে প্রচুর আপেলের চাষ হয়। শাকির মঞ্জুর একজন কাশ্মিরি মুসলিম; যিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন। ২০২০ সালের আগস্টে অপহৃত হন শাকির মঞ্জুর

তার পরিবার বলছে, ঘটনার দিন শাকির তার ঘাঁটিতে ফিরছিলেন। মাঝপথে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীরা তার গাড়ি থামায়। প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে শাকিরের কনিষ্ঠতম ভাই শাহনেওয়াজ মঞ্জুর বলেন, ‘তাদের কয়েকজন লাফিয়ে তার গাড়িতে উঠে পড়ে এবং এরপর গাড়িটি চলে যায়।’ তারপর গাড়িটি কোথায় গিয়েছিল কেউ জানে না।

শাহনেওয়াজ একজন আইনের ছাত্র। তিনি বলছেন, তিনি মোটরবাইকে করে বাড়ি ফেরার সময় শাকিরের গাড়িটি দেখেছিলেন। তা উল্টো দিক থেকে আসছিল। তার মনে আছে, গাড়িটা তখন অপরিচিত লোকে ভর্তি ছিল। শাহনেওয়াজ বাইক থামিয়ে চিৎকার করে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ গাড়ি থেকে তার ভাই জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমার পেছন পেছন এসো না।’ শাকির মঞ্জুরের অপহরণের পর ৯ মাস পেরিয়ে গেছে। তার পিতা মঞ্জুর এখনও ছেলের মৃতদেহ খুঁজে ফিরছেন।

তিনি তার খোঁজ শুরু করেছিলেন সেই গ্রাম থেকে- যেখানে তার ছেঁড়া কাপড়চোপড় পাওয়া গিয়েছিল। এর আশপাশে আরও ৫০ কিলোমিটার জায়গা- যেখানে আছে ফলের বাগান, ছোট ছোট পাহাড়ী নদী, ঘন জঙ্গল আর গ্রাম- সবখানে তিনি তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন। শাকির মঞ্জুরের পরিবার প্রায়ই মৃতদেহের সন্ধানে নানা জায়গায় খোঁড়াখুঁড়ি করতে যায়

শাহনেওয়াজ তার বাবাকে সাহায্য করার জন্য গত বছর কলেজে যাওয়া ছেড়ে দেন। তারা কিছু নদী খোঁড়ার জন্য কয়েক বার খনন করার যন্ত্রও ভাড়া করেছিলেন। তার ভাষায়, ‘কখনও কখনও আমাদের বন্ধু আর প্রতিবেশীরাও কোদাল-শাবল নিয়ে আমাদের সঙ্গে অনুসন্ধানে যোগ দিয়েছে।’

শাকির নিখোঁজ হবার পরপরই তারা একটি মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা ছিল গ্রামেরই একজন বয়স্ক লোকের- যাকে পুলিশের বর্ণনা অনুযায়ী বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীদের হাতে অপহরণ এবং খুন হতে হয়েছিল।

স্থানীয় পুলিশের প্রধান দিলবাগ সিং সম্প্রতি বলেছেন, শাকিরের অনুসন্ধান শেষ হয়নি। যদিও তিনি তদন্তের বিস্তারিত তথ্য দিতে অস্বীকার করেন। বিবিসি স্থানীয় ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (কাশ্মির) বিজয় কুমারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কোন জবাব মেলেনি।

স্থানীয় আইন অনুযায়ী কোনও ব্যক্তি নিখোঁজ হলে সাত বছর পর তাদের মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। সরকারি দলিলপত্রে শাকিরকে 'নিখোঁজ' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মঞ্জুর আহমেদ ওয়াগাই-এর পরিবার এই ট্রাজেডির পর নিজেদের অপমানিত বলে বোধ করে।

মঞ্জুর আহমেদ ওয়াগাই বলেন, ‘আমার ছেলে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। সে যদি জঙ্গিদের সঙ্গে যোগ দিয়ে থাকে; তাহলে সরকার সেটা খোলাখুলি বললেই তো পারে। আর যদি সে  জঙ্গিদের হাতে নিহত হয়ে থাকে, তাহলে কেন তারা তার শহীদ হওয়াকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না?’

কাশ্মিরে ভারতের শাসনের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহী তৎপরতা চলছে, সেই গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে লোকজনের হঠাৎ করে এ রকম উধাও হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। গত ২০ বছরে এ রকম হাজার হাজার মানুষ নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। কিন্তু শোপিয়ান শহর রাজধানী শ্রীনগর থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরে। সেখানে সামরিক উপস্থিতিও ব্যাপক। এমন জায়গা থেকে একজন সৈনিককে গুম করা সহজ কথা নয়। গ্রাম, ফলের বাগান, জঙ্গল- বহু জায়গায় শাকিরের লাশের খোঁজ করেছে তার পরিবার

ওয়াগাই একজন মধ্যবিত্ত কৃষক। যেসব লোক নিরাপত্তা বাহিনীতে যোগ দেবার পর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মারা গেছেন- তাদের অনেকের পরিবারকেই একটা দোটানার মধ্যে কাটাতে হচ্ছে। একটি কারণ হচ্ছে, যেসব পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে কাজ করে- তাদের ক্ষেত্রে সামাজিকভাবে বয়কট হবার ঝুঁকি। অন্যদিকে, অনেকে মনে করে যে, ভারতীয় নিরাপত্তা ইস্টাব্লিশমেন্ট তাদের সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে না।

ওয়াগাই বলছেন, তিনি তার ছেলেকে সাবধান করেছিলেন সে যেন সামরিক বাহিনীতে যোগ না দেয়। তার ভাষায়, ‘কিন্তু সে আমার কথা শোনেনি। তার ভীষণ আগ্রহ ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার। সে কখনও হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে পার্থক্য করেনি।’ নিরুপায় হয়ে শাকিরের পরিবার এখন পীর-ফকির আর মাজারের শরণাপন্ন হয়েছেন।

মঞ্জুর আহমেদ ওয়াগাই মাত্রই একজন ফকিরের সঙ্গে দেখা করে ফিরেছেন। তার নাকি ঐশী ক্ষমতা আছে যা দিয়ে তিনি তার ছেলের মৃতদেহ কোথায় আছে তা বের করতে পারবেন। তবে স্ত্রী আয়েশাকে তিনি বলেছেন, ‘আমার ধীরে ধীরে এসব পীর-ফকিরের ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে।’

বেশ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে স্ত্রীকে তিনি বলছিলেন, ‘সেই ফকির আমাকে বললো, যেখানে শাকিরের কাপড় পাওয়া গিয়েছিল সেই জায়গাটা ভালো করে খুঁজতে। কিন্তু তা তো আমরা আগেই করেছি।’

শাকিরের মা আয়শা ওয়াগাই বলেন, ‘কাশ্মিরের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত এমন কোনও ফকির নেই যার সঙ্গে আমরা দেখা করিনি। আমার মেয়েরা তাদের সোনার গয়না পর্যন্ত এসব মাজারে দান করেছে। আমরা হাল ছাড়ছি না।’

মঞ্জুর আহমেদ ওয়াগাই বলছিলেন, নতুন কোনও খবর পেলেই তিনি আবার খননকাজ শুরু করবেন। তার ভাষায়, ‘আল্লাহ আমাকে যথেষ্ট দিয়েছেন। যেদিন তার কাপড়চোপড় পাওয়া গিয়েছিল, সেদিনই আমরা বুঝেছি যে, সে আর বেঁচে নেই। আমরা তার জানাজাও পড়েছি। কিন্তু আমি যতদিন বেঁচে থাকবো, ততদিন ওর মরদেহের সন্ধান চালিয়েই যাবো।’ সূত্র: বিবিসি বাংলা।

/এমপি/
সম্পর্কিত
আফগান সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ৩০ জঙ্গিকে হত্যার দাবি পাকিস্তানের
আইএস নেটওয়ার্ক ভেঙে দিলো মালয়েশিয়া, জড়িত বাংলাদেশি শ্রমিকরা
ভারতীয় পর্যটন প্রচারের আকর্ষণ এখন ব্রিটিশ এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান
সর্বশেষ খবর
শাহাদাতের সুযোগ এলে পিছপা হবো না: আসিফ মাহমুদ
শাহাদাতের সুযোগ এলে পিছপা হবো না: আসিফ মাহমুদ
চুয়াডাঙ্গায় ট্যাংকলরি-ইজিবাইকের সংঘর্ষে নিহত ৩
চুয়াডাঙ্গায় ট্যাংকলরি-ইজিবাইকের সংঘর্ষে নিহত ৩
ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে আ.লীগ নেতা বাবাকে গ্রেফতারের দাবিতে বিক্ষোভ
ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে আ.লীগ নেতা বাবাকে গ্রেফতারের দাবিতে বিক্ষোভ
জামায়াতের অনুষ্ঠানে ‘সৎ’ লোককে ভোট দিতে বলা পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা
জামায়াতের অনুষ্ঠানে ‘সৎ’ লোককে ভোট দিতে বলা পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা
সর্বাধিক পঠিত
দেশের এই পরিস্থিতিতে কীসের নির্বাচন: জামায়াত আমির
দেশের এই পরিস্থিতিতে কীসের নির্বাচন: জামায়াত আমির
ইরানি তেল বাণিজ্যে আবারও আঘাত যুক্তরাষ্ট্রের
ইরানি তেল বাণিজ্যে আবারও আঘাত যুক্তরাষ্ট্রের
৯ ধরনের মামলার আগে মধ্যস্থতার বাধ্যবাধকতা: বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি কমবে?
৯ ধরনের মামলার আগে মধ্যস্থতার বাধ্যবাধকতা: বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি কমবে?
জামায়াতের অনুষ্ঠানে ‘সৎ’ লোককে ভোট দিতে বলা পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা
জামায়াতের অনুষ্ঠানে ‘সৎ’ লোককে ভোট দিতে বলা পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা
দুই ভাইয়ের বিরোধে মুরাদনগরের সেই ঘটনার ভিডিও ছড়ানো হয়: র‌্যাব
দুই ভাইয়ের বিরোধে মুরাদনগরের সেই ঘটনার ভিডিও ছড়ানো হয়: র‌্যাব