X
শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫
২১ আষাঢ় ১৪৩২

হলি আর্টিজানে হামলার পাঁচ বছর: যা ঘটেছিল সেই রাতে

নুরুজ্জামান লাবু
০১ জুলাই ২০২১, ০২:২৯আপডেট : ০১ জুলাই ২০২১, ০৯:২৬

রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পাঁচ বছর পূর্ণ হলো আজ। পাঁচ বছর আগে এই দিনে নব্য জেএমবির পাঁচ জঙ্গি বেকারিতে ঢুকে প্রথমে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ দেশি-বিদেশি ২২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এছাড়া রাতভর জিম্মি করে রাখে বেকারিতে আসা বেশ কয়েকজন অতিথি ও বেকারির স্টাফদের। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্য দিযে পার হওয়া সেই রাত শেষে ভোরে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ইউনিটের নেতৃত্বে পুলিশ ও র‌্যাব যৌথভাবে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ নামে অভিযান চালায়। ওই অভিযানে নিহত হয় পাঁচ জঙ্গি। উদ্ধার করা হয় হলি আর্টিজান বেকারিতে জিম্মি অবস্থায় থাকা দেশি-বিদেশি অতিথি ও বেকারির স্টাফসহ প্রায় ৩৫ জনকে।

হলি আর্টিজান বেকারিতে নারকীয় জঙ্গি হামলার পাঁচ বছর উপলক্ষে আজ বুধবার (১ জুলাই) সকাল ৭টা থেকে গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের পাঁচ নম্বর প্লটের ওই বাড়িটি নিহতদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য খুলে দেওয়া হবে। গুলশান থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোফাজ্জল হোসেন জানান, করোনা মহামারির কারণে কঠোর লকডাউনের মধ্যেও সীমিত পরিসরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিশেষ করে বিদেশি নাগরিকদের জন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে সেখানে বেশি মানুষের ভিড় করতে দেওয়া হবে না।

পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী ও মামলার নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, জঙ্গিদের ওই হামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তা— সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও ওসি সালাউদ্দিনসহ ২২ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ৯ জন ইতালির নাগরিক, ৭ জন জাপানি, একজন ভারতীয় এবং একজন বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিক। বাকি দুজন ইশরাত আকন্দ ও ফারাজ আইয়াজ হোসেন বাংলাদেশি নাগরিক।

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, ঘটনার সেই রাতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসা থেকে পাঁচ জঙ্গি রোহান ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কে যান। রাত ৮টা ৪২ মিনিটে প্রথমে তিন জন ও এক মিনিট পরে দুই জন ব্যাগে অস্ত্র ও বোমা নিয়ে ওই রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করেন। হলি আর্টিজান বেকারিতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানকার বিভিন্ন টেবিলে বসে থাকা বিদেশি নাগরিকদের এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকেন। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য তাদের গলায় ও শরীরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেন। একইসঙ্গে বেকারির টেবিলে বসে থাকা হাসনাত করিম নামে এক ব্যক্তির পরিবার, সাত প্রকাশ নামে একজন ইন্ডিয়ান নাগরিক, তাহমিদ ও তার দুই বান্ধবীকে জিম্মি করে রাখেন তারা। তাদের সঙ্গে জিম্মি করে রাখেন বেকারির প্রায় ১৫ জন কর্মীকে।

ভয়াবহ সেই রাতের বর্ণনা দিয়ে বেকারির স্টাফ শিশির সরকার বিভিন্ন সময়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘সেই রাত ছিল ভয়াবহ। হঠাৎ করেই এলোপাতাড়ি গুলি। আমি আর একজন জাপানি নাগরিক দৌড়ে গিয়ে চিলার রুমে আশ্রয় নিয়েছিলাম। রাত ১২টা থেকে একটার মধ্যে সেই চিলার রুম থেকে আমাদের বের করা হয়। এরপর আমার সামনেই সেই জাপানি নাগরিককে গুলি করে হত্যা করে জঙ্গিরা। আমি বেকারির স্টাফ বলে আমাকে মারেনি। কিন্তু পরে তারা আমি হিন্দু না মুসলিম জিজ্ঞাসা করে। আমি ভয়ে ও প্রাণ বাঁচাতে বলি মুসলিম। তারা আমাকে একটি সুরা বলতে বললে আমি লা ইলাহা বলি। তারা আমার কথা বিশ্বাস করে আমাকে হত্যা করেনি।’

শিশির সরকার বিভিন্ন সময়ে এই প্রতিবেদককে বলেছেন, ‘আমি চিলার রুম থেকে বের হয়ে দেখি অতিথিদের বসার টেবিলের আশেপাশে লাশ পড়ে আছে। রক্তে ভিজে গেছে পুরো মেঝে। আমি ভয়ে হামাগুড়ি দিয়ে লাশের ওপর দিয়ে আরেক দিকে যাই। পরে জঙ্গিরা আমাকে অভয় দেয়। বলে, মুসলমানদের হত্যা করা হবে না। শেষ রাতে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে আমাকে দিয়ে রান্নাও করিয়ে নেয় তারা।’

হলি আর্টিজান বেকারির আরেক স্টাফ আকাশ খানও এই প্রতিবেদকের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে আলাপকালে বলেন, ‘সেই রাত ছিল আমাদের জন্য ভয়ংকর একটা রাত। আমাদের সবাইকে বাথরুমে আটকে রেখেছিল। সকালে বাথরুম থেকে বের করলে রেস্তোরাঁর মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লাশ পড়ে থাকতে দেখি। এই দৃশ্য আমি কখনও ভুলবো না। জঙ্গিরা আমাদের স্টাফ পরিচয় পেয়ে হত্যা করেনি। তাদের টার্গেট ছিল বিদেশি নাগরিক। এখনও সেই রাতের কথা মনে পড়লে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি।’

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ এই হামলার দুই বছরের মাথায় ২১ জনের সম্পৃক্ততা থাকার প্রমাণ পেয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় মামলার তদন্ত সংস্থা-কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। তবে ২১ জনের মধ্যে ১৩ জন অপারেশন থান্ডারবোল্টসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য অভিযানে মারা যাওয়ায় জীবিত ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনাল এই মামলার যুক্তিতর্ক শেষে রায়ে ৭ আসামির মৃত্যুদণ্ড দেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন—জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র‌্যাশ, হাদিসুর রহমান সাগর, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আব্দুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন। মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান নামে একজনকে খালাশ দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা আদালতে আপিল করেছেন। রাষ্ট্রপক্ষও খালাস পাওয়া আসামির মৃত্যুদণ্ড চেয়ে আপিল করেছেন। বর্তমানে এই মামলাটি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট জঙ্গিবাদবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। এর মধ্যে ঢাকার জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গঠিত বিশেষ ইউনিট কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ২০টি অভিযান চালায়। এসব অভিযানে ৬৩ জন জঙ্গি নিহত হয়। হোলি আর্টিজান বেকারিতে নব্য জেএমবি নামে যে জঙ্গি সংগঠনটি হামলা চালিয়েছিল, তাদের প্রায় কোণঠাসা করে দেওয়া হয়েছে।

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বুধবার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নব্য জেএমবিকে একেবারে কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে। তাদের আর আগের মতো শক্তি-সামর্থ্য নেই। এই সংগঠনসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই হয় অভিযানে নিহত হয়েছেন, নয়তো গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছে। আমরা নিয়মিত নজরদারি ও অভিযানের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ অনেকটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এনেছি। হোলি আর্টিজানের মতো ঘটনা ঘটাবার মতো শক্তি-সামর্থ্য জঙ্গিদের এখন আর নেই।’

 

/আইএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বৈদেশিক মুদ্রা ডাকাতি: একজন কারাগারে, রিমান্ডে ৫  
বৈদেশিক মুদ্রা ডাকাতি: একজন কারাগারে, রিমান্ডে ৫  
প্রকৃতিকন্যা মিম
প্রকৃতিকন্যা মিম
পঞ্চগড় সীমান্তে আবারও ১৫ জনকে পুশইন করেছে বিএসএফ
পঞ্চগড় সীমান্তে আবারও ১৫ জনকে পুশইন করেছে বিএসএফ
‘ভাইরাল আলভি’সহ গ্রেফতার ৪ জন কারাগারে
‘ভাইরাল আলভি’সহ গ্রেফতার ৪ জন কারাগারে
সর্বাধিক পঠিত
৯ ধরনের মামলার আগে মধ্যস্থতার বাধ্যবাধকতা: বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি কমবে?
৯ ধরনের মামলার আগে মধ্যস্থতার বাধ্যবাধকতা: বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি কমবে?
দেশের এই পরিস্থিতিতে কীসের নির্বাচন: জামায়াত আমির
দেশের এই পরিস্থিতিতে কীসের নির্বাচন: জামায়াত আমির
জামায়াতের অনুষ্ঠানে ‘সৎ’ লোককে ভোট দিতে বলা পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা
জামায়াতের অনুষ্ঠানে ‘সৎ’ লোককে ভোট দিতে বলা পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা
আই উইল বি আ মাদার: জায়েদ খানকে তিশা
আই উইল বি আ মাদার: জায়েদ খানকে তিশা
জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম অংশ অবশ্যই মেটিকুলাসলি ডিজাইনড: মাহফুজ আলম
জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম অংশ অবশ্যই মেটিকুলাসলি ডিজাইনড: মাহফুজ আলম