X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

উপহারের ঘর তৈরিতে নামমাত্র নির্মাণসামগ্রী

সালেহ টিটু, বরিশাল
২৩ জুলাই ২০২১, ১৫:০০আপডেট : ২৩ জুলাই ২০২১, ১৬:৫৩

বরিশালে হতদরিদ্রদের জন্য মুজিববর্ষের উপহারের ঘর নির্মাণে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঘরগুলোর জায়গা নির্বাচন থেকে শুরু করে নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার– কোনও কিছুই ঠিকভাবে করা হয়নি বলে জানা গেছে। এমনকি সচ্ছল ব্যক্তির বাড়িতেও এই ঘর নির্মাণ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নির্মাণে অনিয়মসহ সার্বিক বিষয় তদন্তে পৃথক তিনটি কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটিকে এতে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে দ্রুত রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের জন্য বাসগৃহ নির্মাণ প্রকল্পে বরিশাল জেলার ১০ উপজেলায় প্রায় দেড় হাজার হতদরিদ্র পরিবারের জন্য এক হাজার ৪৫৬টি আধাপাকা ঘরের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৪ কোটি ৮৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকা।

মে মাসের শেষের দিকে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের শ্রীপুর ইউনিয়নের বাহেরচর এলাকায় নবনির্মিত ১৬টি ঘরে পানি ওঠে। পানি নেমে যাওয়ার পরপরই বেশিরভাগ ঘরের দেয়াল থেকে শুরু করে পিলার ধসে পড়ে। বেরিয়ে আসে দুর্নীতির মহাচিত্র। মাত্র এক ফুট মাটির নিচ থেকেই গড়ে তোলা হয় দেয়াল। আর দেয়ালে ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের ইট ও গাঁথুনিতে সিমেন্ট ছিল না বললেই চলে। টিনের ছাউনিতে ব্যবহার করা হয়েছে নামমাত্র কাঠ। প্রায় একই চিত্র বরিশাল জেলায় মুজিববর্ষের উপহারের অন্য ঘরগুলোরও।

উপহারের ঘর তৈরিতে নামমাত্র নির্মাণসামগ্রী

দেয়াল ধসে টিনের ছাউনি ঝুলে থাকা ঘরের মো. তৌহিদ বলেন, ‘আমরা নদীভাঙন কবলিত এলাকার লোক। আজ এখানে তো কাল আরেক জায়গায়– এভাবে চলছিল আমাদের জীবন। অনেক কষ্ট করে মুজিববর্ষের এ ঘর পেয়েছিলাম। কিন্তু তাও বেশি দিন কপালে জুটলো না। পানির তোড়ে ঘরের দেয়াল ধসে পড়ায় পরিবার নিয়ে আরেক জায়গায় এক হাজার টাকায় ঘর ভাড়া নিয়েছি। এ ঘর আবার কবে ঠিক হবে, কবে ঘরে উঠবো তা কেবল আল্লাহই ভালো বলতে
পারবেন।’

একই স্থানে থাকা মরজিনা বেগম বলেন, ‘পানির তোড়ে উপহার পাওয়া ঘরের সামনের বারান্দা সম্পূর্ণ ধসে পড়েছে। ঘরের ফ্লোর ফেটে গেছে। এখন এ ঘরে থাকতে ভয় লাগে। কোনও সময় যদি বাতাসে ঘর পড়ে যায় তাহলে মরণ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।’

বাহেরচরের স্থানীয় বাসিন্দা নিজাম মাঝি অভিযোগ করেন, ‘ঘর বানিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এতে বালি দেয়নি, সিমেন্ট দেয়নি। এমনকি ইট দিলেও তা সবচেয়ে খারাপ মানের দেওয়া হয়েছে। এ কারণে পানির চাপে ঘরগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৬টি ঘরের মধ্যে ৫টি ঘরের কক্ষই ধসে পড়েছে। বাকিগুলোর পিলার থেকে শুরু করে দেয়াল ধসে পড়ে। সিমেন্ট দেওয়া হলে একটি ইট আরেকটি ইটকে ধরে রাখতে পারতো।’

তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়াও বেশি খারাপ কাজ করেছে ঘর বিতরণে। এ ঘর দিতে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ। আমার কাছে থেকেও ৩০ হাজার টাকা নিয়েছেন, কিন্তু ঘর দেননি।’

নিম্নমানের ঘর নির্মাণের চেয়েও এ এলাকায় বড় দুর্নীতি হয়েছে বাড়ির মধ্যে মুজিববর্ষের ঘর নির্মাণ করে। তিনটি বাড়িতে তিনটি মুজিববর্ষের ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানকার হোটেল ব্যবসায়ী মো. অহিদ তার বাড়িতে মুজিববর্ষের ঘর পেয়েছেন। সে ঘরে তিনি হোটেলের জন্য জ্বালানি কাঠ রেখেছেন। বর্তমানে ঘরটি জ্বালানি কাঠের ঘর হিসেবেই ব্যবহার হচ্ছে। এর কিছু দূরে মো. রফিকের বাড়িতেও একইভাবে মুজিববর্ষের ঘর নির্মিত হয়েছে। আর ওই ঘরের নির্মাণকাজ ধসে পড়া ঘরের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। একইভাবে আলহাজ মেম্বারের বাড়িতেও দেওয়া হয়েছে মুজিববর্ষের ঘর।

উপহারের ঘর তৈরিতে নামমাত্র নির্মাণসামগ্রী

তবে ঘর বিতরণে টাকা লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করে চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ বলেন, ‘নিজাম তার প্রতিপক্ষ চেয়ারম্যান প্রার্থীর লোক। এ ছাড়া যেখানে মুজিববর্ষের ঘর করা হয়েছে তা পূর্বে নিজামসহ তার লোকজনের ভোগদখলে ছিল। সেই জায়গায় ঘর করায় সে ক্ষুব্ধ হয়ে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।’ ঘর পড়ে যাওয়ার আগে নিজাম মাঝি ধাক্কা দিয়ে কিছু দেয়াল ফেলে দেয় বলেও অভিযোগ করেন চেয়ারম্যান। ঘর দিতে কারও কাছ থেকে কোনও টাকা নেওয়া হয়নি বলেও জানান তিনি।

বিভিন্ন বাড়িতে মুজিববর্ষের ঘর করার বিষয়ে চেয়ারম্যান বলেন, ‘ওইসব বাড়ি এলাকায় খাস জমি রয়েছে। সেখানেই ঘর করা হয়েছে।’ তার দাবি, কোনও ব্যক্তির বাড়িতে ঘর দেওয়া হয়নি।

এদিকে বরিশাল সদর উপজেলা চরকাউয়ার হিরন কলোনিতে নির্মিত হয়েছে মুজিববর্ষের ঘর। কীর্তনখোলা নদী সংলগ্ন এলাকায় ঘরগুলো নির্মিত হওয়ায় তা ভাঙনের মুখে পড়েছে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসন থেকে বালুর বস্তা ফেলে ভাঙন প্রতিরোধের চেষ্টা চালানো হয়েছে। সেখানকার বাসিন্দারা জানান, সামান্য বাতাসে ওই ঘরের চালা উড়ে যায়। এরপর সংশ্লিষ্টরা এসে ওই চালা লাগিয়ে এরপর কাঠে লোহার পেরেক দিয়ে চালা টানা দেন। যাতে পরবর্তী সময়ে টিনের চালা আর উড়ে যেতে না পারে। সেখানে ফ্লোরের ঢালাই ওঠে গেছে। হাত দিয়েই তুলে আনা যায় গাঁথুনির ইট। টিনের চালায় ব্যবহৃত কাঠ যেকোনও সময় ঘুণে ধরবে। আর দরজা জানালা এখনই খুলে পড়তে শুরু করেছে।

এ কলোনিতে ঘর রয়েছে ১১টি। এখানকার বাসিন্দারা বলেন, ‘নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেই ঘরের ফ্লোর তলিয়ে যায়। এখনও এখানে পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়নি। ১১টি ঘরের মধ্যে বেশিরভাগই ঘর তালা মারা। ওই সব ঘর ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। যারা ঘর নিয়েছে তাদের ঘর থাকায় সেখানে আসেনি। পরে এই ঘর ভাড়া দেবে।’

বানারীপাড়া উপজেলার চাখার ইউনিয়নের সাকরাল গ্রামে দেড় একর খাস জমিতে হতদরিদ্র পরিবারের জন্য ৭০টি ঘর বাবদ দেওয়া হয়েছে এক কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। যে টাকার বড় একটি অংশ লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। দেখা গেছে, ঘরের মূলভিত্তি পিলারই সোজা থাকতে পারছে না, সামান্য ধাক্কায় তা পড়ে যাচ্ছে। ঘর নির্মাণ শুরুর পর থেকে এভাবে বহু পিলার পড়ে গেছে। ওই পিলার আবার দাঁড় করিয়ে জোড়াতালি দেওয়া হয়। আর দেয়ালে সিমেন্টের অস্তিত্ব খুঁজে পাননি গ্রামবাসী।

এদিকে এক সংবাদ সম্মেলনে বিভাগীয় কমিশনার সাইফুল হাসান বাদল বলেন, ‘প্রথম পর্যায়ে বরিশাল বিভাগে ৬ হাজার ৮৮টি এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ৪ হাজার ৪৫৭টি ঘর এবং জমি দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে। এ ছাড়া আরও ২ হাজার ৬৯০টি নির্মাণাধীন রয়েছে। এরমধ্যে বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জে ১৪টি এবং ভোলার দৌলতখানে ১২টি ঘর সাম্প্রতিক ইয়াসের পানির প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’

উপহারের ঘর তৈরিতে নামমাত্র নির্মাণসামগ্রী

ঘরগুলো নির্মাণে কোনও ত্রুটি হয়েছে কিনা এবং হয়ে থাকলে কে বা কারা দায়িত্বে অবহেলা করেছেন সেগুলো অনুসন্ধান করার জন্য বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় এবং জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে পৃথক দুটি কমিটি গঠিত হয়েছে। মেহেন্দিগঞ্জে ঘর ভেঙে যাওয়ার ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে গত ৭ জুলাই তদন্ত কমিটি করা হয়।

অপরদিকে বরিশাল জেলার ঘর নির্মাণসহ সার্বিক বিষয় তদন্তে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকদের প্রধান করে শনিবার ১০ উপজেলার প্রতিটিতে একটি করে কমিটি করা হয়েছে। নির্মাণ ত্রুটি কিংবা অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে একই দিন জেলায় তিন সদস্যের একটি টেকনিক্যাল কমিটি করা হয়েছে। গঠিত এসব কমিটিকে সাত কার্য দিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন বিভাগীয় কমিশনার।

 

/এমএএ/আপ-এনএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘আ.লীগকে বর্জন করলেই অন্য পণ্য বর্জনের প্রয়োজন হয় না’
‘আ.লীগকে বর্জন করলেই অন্য পণ্য বর্জনের প্রয়োজন হয় না’
বিজিএপিএমইএ’র নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা, শাহরিয়ার নতুন প্যানেল নেতা
বিজিএপিএমইএ’র নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা, শাহরিয়ার নতুন প্যানেল নেতা
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!