স্বাদ ও পুষ্টিগুণের কারণে পেয়ারাকে বলা হয় বাংলার আপেল। আর এর মধ্যে পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি জাতটিই বেশি জনপ্রিয়।
বাংলাদেশে পেয়ারা এসেছে ৩শ বছর হলো। স্বরূপকাঠি জাতের বয়স এক শ’ বছরের কাছাকাছি। স্বরূপকাঠির কুড়িআনা এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠরা জানান, আটঘর-কুড়িয়ানা গ্রামের পূর্ণচন্দ্র মন্ডল নামের এক ব্যক্তি ১২৫০ বঙ্গাব্দে তীর্থে যান। ভারতের গয়াধাম দর্শনের পর বাড়ি ফেরেন তিনি। সঙ্গে নিয়ে আসেন পরিপুষ্ট পেয়ারা। পরে ওটার বীজ থেকে কিছু গাছ জন্মায়। এ ফলের স্বাদ, গন্ধ ও আকার স্থানীয়দের মুগ্ধ করে। পরে বাগান আকারে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কুড়িআনাসহ আশপাশের সব এলাকায় এটি ছড়িয়ে পড়ে।
আগে এটাকে পূর্ণচন্দ্রের নামে পূর্ণমন্ডলীয় জাত বলেই ডাকা হতো। বলা হয়, ভারতের পূণ্যভূমি খ্যাত গয়া থেকে ফলটি নিয়ে আসায় এ পেয়ারার আরেক নাম হয় ‘গয়া বা গইয়া’।
স্বরূপকাঠি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা চপল কৃষ্ণ নাথ বলেন, উপজেলার ২২টি গ্রামের প্রায় ৬৫৭ হেক্টর জমিতে পেয়ারার বাগান রয়েছে। প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় ১০টন পেয়ারা হয়। এ বছর প্রায় সাত হাজার টন ফলনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পাইকারি বাজারে প্রতি মণ ২০০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চপল কৃষ্ণ বলেন, এক ফসলি নিচু জমি কেটে উচু কান্দি তৈরি করে বেড আকারের জমিতে দুই সারিতে এ পেয়ারার বীজ চারা বা কলম রোপণ করা হয়। এ এলাকার মাটির নিম্নস্তরের মাটি জৈব উপাদানে ভরপুর হওয়ায় পেয়ারা গাছে বাড়তি সার প্রয়োগ করতে হয় না। পেয়ারাও রসালো হয়।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বলেন, এ পেয়ারা গাছের শিকড় খুব একটা ভেতরে যায় না। একটি ছোট গাছ ২-৩ মিটার হয়। গাছের শাখাগুলো মাটির কাছাকাছি থাকে এবং প্রায়ই শিকড় থেকে গজ তৈরি করে। পাতাগুলো অনেকটা আয়তক্ষেত্রের মতো। এর ফুলগুলো উভয়লিঙ্গ। শাখা-প্রশাখায় গুচ্ছ আকারে ফল ধরে।
এ জাতটি অন্যান্য গ্রীষ্ণমণ্ডলীয় গাছের চেয়ে বেশি খরা এবং লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে।
এলাকার পেয়ারা চাষী কালীপদ হালদার জানান, বর্ষার পর স্বরূপকাঠি জাতের পেয়ারার ফলন কমে যায়। এরপর শাখা-প্রশাখা ছাঁটাই করার পর আমাদের উদ্ভাবিত বিশেষ পদ্ধতিতে বাগানের কান্দিতেই সবুজ সার তৈরি করি। বাগানের বেডে কান্দির নিচের বেড় (নালা) থেকে জোয়ারের পলি মাটি তুলে সেটার প্রলেপ দেই।
শুধু স্বাদই নয়, স্বরূপকাঠীর পেয়ারার বাজারটিও দেখার মতো। রীতিমতো পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে এখানকার ভাসমান পেয়ারা বাজার। গাছপালা ঘেরা শাখানদী ও খালের ওপর সবুজ পেয়ারাভর্তি নৌকাগুলো দেখলেই প্রকৃতিপ্রেমীর মন মিশে যাবে ঘনসবুজের ছায়ায়।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে এখানকার পেয়ারা বাগানে এনথ্রাকনোজ বা ছিটপড়া রোগের আক্রমণে ফলন ও মূল্য দুটোই কমে যায়। পরে কৃষি গবেষকদের পরামর্শে বাগানে সাথী ফসল হিসাবে শিমসহ কিছু সবজি চাষ বন্ধ করে এ রোগের প্রকোপ কমানো হয়।
এ বছর স্বরূপকাঠীর পেয়ারার ফলন ভালো। কৃষি কর্মকর্তা ও চাষীরা বললেন, আদাবাড়ী এলাকার পেয়ারা চাষী সুজন হালদার বলেন, ফলন ভালো হওয়ায় মণপ্রতি চার শ’ থেকে সাড়ে চার শ’টাকা পেয়েছি।
উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা রিপন হালদার বলেন, স্বরূপকাঠীর প্রায় ১৮ শ’ পরিবার পেয়ারা চাষে জড়িত। এ ছাড়া বরিশালের বানারীপাড়া ও ঝালকাঠীর বেশ কিছু এলাকার লোকও এ পেয়ারা চাষ করছে।
ঢাকার ব্যবসায়ী নূরে আলম বলেন, স্বরূপকাঠী থেকে ২০ বছর ধরে ফল নিচ্ছেন। প্রতি মণ কিনছেন সাড়ে চার শ টাকায়। ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে ৪৮০ টাকায়। দাম পড়ে যাওয়ায় এবার খানিকটা লোকসানে আছেন তিনি। লকডাউনের কারনে ঢাকার ফেরিওয়ালারা পেয়ারা বিক্রি করতে পারছে না বলেই ক্ষতি হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
এদিকে স্বরূপকাঠীর কুরিয়ানা ইউপি চেয়ারম্যান মিঠুন হালদার বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকার মানুষ তাজা পেয়ারা খেতে পারবেন। সকালে বাগান থেকে পেয়ারা তুলে সড়কপথে ঢাকায় পাঠালে তা সকাল ১১টাতেই পৌঁছাবে।