X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১
জনতা ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি পর্ব-৪

সামর্থ্য ছাড়াই পায় ঋণ, কিস্তি ছাড়াই হয় পুনর্বিন্যাস

শাহেদ শফিক
০৬ আগস্ট ২০২১, ১৫:০০আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২১, ১৬:১৩

ব্যাংকিং খ্যাতের নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ ও অনৈতিক সুবিধা দিয়েছে জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটির আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন-এর ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে চতুর্থ পর্ব।

আর্থিক ও রফতানির সামর্থ্য বিবেচনায় না এনে মেসার্স ফিনকোলি অ্যাপারেলস লিমিটেডকে ঋণ মঞ্জুর করেছে জনতা ব্যাংক। এতে ব্যাংকের ৪৭ কোটি ৩১ লাখ টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া ডমিসিল ডিজাইন অ্যান্ড বিল্ডার্স লি. নামের একটি ডেভেলপার কোম্পানির কাছ থেকে ঋণের ১৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে ব্যাংকটি। বিশেষ সুবিধা দিয়েও জুট স্পিনার্স লিমিটেডের কাছ থেকে ৪১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা আদায় করা যায়নি। জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের যোজসাজশেই ঘটেছে এসব অনিয়ম। বাংলা ট্রিবিউনের হাতে আসা নথিপত্রে জানা গেছে এ তথ্য।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফিনকোলি অ্যাপারেলস লিমিটেডকে ৩২ কোটি ৯৬ লাখ টাকার দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প ঋণ মঞ্জুর করে জনতা ব্যাংক। পরে ২০১২ সালে এপ্রিলে ঋণসীমা ২৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকায় বাড়ানো হয়। গ্রাহক প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি করায় শুরুতেই হিসাবটি খেলাপি হয়।

২০১৫ সালের জুলাইতে ওভারডিউ দায় ৫ কোটি ৯২ লাখ টাকার ডাউনপেমেন্ট ৮৯ লাখ টাকার বিপরীতে ৩০ লাখ টাকা আদায় করে প্রথম পুনঃতফসিল অনুমোদন করা হয়। পুনঃতফসিলের শর্তানুযায়ীও কিস্তি আদায় হয়নি। পরে ঋণ হিসাবটি ২০১৬ সালের মার্চ থেকে বিএল শ্রেণিকৃত হয়।

প্রয়োজনীয় জামানত না থাকায় গ্রাহকের অনুকূলে চলতি মূলধনও মঞ্জুর করা হয়নি। এখন প্রকল্পটি বন্ধ। ৪৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা ঋণের বিপরীতে জামানত আছে মাত্র ২১ কোটি ৭২ লাখ টাকা।

জনতা ব্যাংকের দাবি, ওই উদ্যোক্তার আর্থিক ও অন্যান্য যোগ্যতা বিবেচনা করেই ঋণটি মঞ্জুর করা হয়েছিল। পরে ২০১২ সালে পরিচলনা পর্ষদের ২২৮তম সভায় প্রকল্পটি সুষমকরণের লক্ষ্যে নতুনভাবে ৮ কোটি ১৬ লাখ টাকা দীর্ঘমেয়াদী ঋণ মঞ্জুর করা হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়েছে ও এখন চালু আছে বলেও দাবি ব্যাংকের।

তবে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি চালু আছে বলা হলেও ঋণ হিসাবটি ২০১৬ সালের মার্চ থেকে বিএল শ্রেণিকৃত। জনতা ব্যাংকের শিল্পঋণ বিভাগের পরিদর্শন প্রতিবেদনে প্রকল্পটি বন্ধ রয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়।

একটি কিস্তিও দেয়নি ডমিসিল ডিজাইন
ডমিসিল ডিজাইন অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেড নামের একটি ডেভেলপার কোম্পানিকে ঋণ নিয়ে প্রায় ২০ কোটি টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে জনতা ব্যাংক। ঋণ দেওয়ার সময় প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধের যোগ্যতা বিচার করা হয়নি। উল্টো বারবার পুনর্বিন্যাসের সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাজধানীর বনানীর ১২ ছটাক জমিতে ১৩তলা ভবন নির্মাণে ২০১২ সালে ১২ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করা হয় ডমিসিল ডিজাইনের নামে। জামানত হিসেবে নির্মাণাধীন ভবনসহ ৯ দশমিক ৭৫ কাঠা জমির মধ্যে উদ্যোক্তার অংশ ৬ দশমিক ৭৮ কাঠা মর্টগেজ করা হয়। জমির দাম ধরা হয়েছিল ২৭ কোটি ১২ লাখ টাকা।

শর্তানুযায়ী ঋণের প্রথম কিস্তি বিতরণের তারিখ থেকে ২৪ মাসের মধ্যে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার কথা এবং তখন থেকে প্রথম কিস্তি আদায়যোগ্য হবে। কিন্তু গ্রাহক ঋণ হিসাবে কোনও টাকা জমা দেয়নি। তারপরও ২০১৪ সালে মার্চে কিস্তি পুনর্বিন্যাসের অনুমোদন দেয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।

২০১৫ সালে ডমিসিলের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আবারও ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধির অনুমোদন দেয় ওই পর্ষদ। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও টাকা আদায় হয়নি।

জনতা ব্যাংক বলেছে, দীর্ঘদিন রিয়েল এস্টেটের বাজার মন্দা থাকায় গ্রাহকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ পুনর্বিন্যাসের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কিস্তির টাকার জন্য গ্রাহককে ফোন ও চিঠির মাধ্যমে বারবার তাগাদা দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ঋণ পরিশোধের জন্য চূড়ান্ত তাগিদপত্রও দেওয়া হয়েছে।

জুট স্পিনার্স-এর কাছে পাওনা ৪১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা
ব্যাংকিং আইন ও নীতিমালা সরাসরি অমান্য করে মেসার্স জুট স্পিনার্স লিমিটেডকে দেওয়া ঋণের কিস্তি আদায়ে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ঋণের তুলনায় জামানত নগণ্য হওয়ায় ব্যাংকের ক্ষতি ৪১ কোটি ৬৮ লাখ টাকারও বেশি।

বাংলা ট্রিবিউনের হাতে পৌঁছা একাধিক কাগজপত্রে দেখা গেছে, জনতা ব্যাংক লিমিটেডের লোকাল অফিস থেকে ওই গ্রাহক ১৯৮২-৮৩ মৌসুম হতে দুই কোটি টাকার ঋণ সুবিধা ভোগ করে আসছে। ২০১৪ সালে ঋণ হিসাবটির অনাদায়ী সুদ প্রায় ১৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ব্লকড হিসাবে স্থানান্তর হয়। এ সময়ে ঋণগ্রহীতা মাত্র দুটি কিস্তি পরিশোধ করেছে। বিআরপিডি সার্কুলার অনুয়ায়ী ঋণ হিসাবটি বিএল মানে শ্রেণিকরণ যোগ্য হলেও তা না করে নবায়ন করা ছিল গুরুতর অনিয়ম।

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক পাট খাতে সহায়তা প্রদানে গঠিত পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের আওতায় ঋণগ্রহীতাকে কাঁচাপাট ক্রয়ে ২০১৪ সালে পাঁচ বছর মেয়াদে এক কোটি টাকা মঞ্জুর করা হয়। লেনদেনের বিবরণীতে দেখা যায়, ওই টাকায় পাট না কিনে গ্রাহক সেটা সিসি (হাঃ) হিসাবে জমা করেছে। যা গুরুতর অনিয়ম।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদনও এখন বন্ধ। শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে প্রাথমিক জামানতও নেই।

জনতা ব্যাংক বলেছে, জুট স্পিনার্সের ঋণ হিসাবটি ২০১৭ সালের জুনে নিয়মিত থাকা সাপেক্ষে (বিএল যোগ্য ছিল না) নবায়ন করা হয়েছে। পরে হিসাবটি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল ক্ষতিজনক শ্রেণিকরণ করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১৪ সালের ২৪ জুলাই নীতিমালার আলোকে গ্রাহকের অনুকূলে ১৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকার সিসি (ব্লকড) ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়। যার মাত্র দুটি কিস্তি গ্রাহক পরিশোধ করে।

উল্লিখিত অনিয়মের বিষয়ে ২০১৮ সালে মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর অগ্রিম অনুচ্ছেদ জারি করা হয় এবং একই বছরের আগস্টে তাগিদপত্র দেওয়া হয়। জবাব না পাওয়ায় ২০১৯ সালের মার্চে সচিব বরাবর আধাসরকারি পত্র দেওয়া হলেও জবাব পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুছ ছালাম আজাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএস-এরও জবাব দেননি।

জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. এসএম মাহফুজুর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনিও কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

/এফএ/
টাইমলাইন: জনতা ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি
০৬ আগস্ট ২০২১, ১৫:০০
সামর্থ্য ছাড়াই পায় ঋণ, কিস্তি ছাড়াই হয় পুনর্বিন্যাস
সম্পর্কিত
বেনজীরের সম্পদ নিয়ে দুদকের অনুসন্ধানের অগ্রগতি প্রতিবেদন চাইলেন হাইকোর্ট
কারিগরির সনদ জালিয়াতি: সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ডিবি কার্যালয়ে
পি কে হালদারের সহযোগী সুকুমার-অনিন্দিতার জামিন চেয়ে আবেদন
সর্বশেষ খবর
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা প্যাকেজ পাস
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা প্যাকেজ পাস
এক্সপ্রেসওয়েতে বাস উল্টে প্রাণ গেলো একজনের, আহত ১০
এক্সপ্রেসওয়েতে বাস উল্টে প্রাণ গেলো একজনের, আহত ১০
বেসিস নির্বাচনের ৩৩ প্রার্থী
বেসিস নির্বাচনের ৩৩ প্রার্থী
সিঙ্গাপুরে রডচাপায় বাংলাদেশি তরুণের মৃত্যু
সিঙ্গাপুরে রডচাপায় বাংলাদেশি তরুণের মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক