X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট সংকটে চালু হয় না আইসিইউ

জাকিয়া আহমেদ
১৬ অক্টোবর ২০২১, ০৯:০০আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০২১, ১১:০৩

ঝালকাঠির রোগীরা করোনাকালে ছুটে গেছেন জেলা সদর হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত সুবিধার অভাবে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হতো বিভাগীয় শহর বরিশালে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে ছিল না আইসিইউ সুবিধা, সেইসঙ্গে অক্সিজেন সংকটও ছিল প্রবল। চিকিৎসক ছিলেন ১০ জন, এর মধ্যে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট ছিলেন মাত্র একজন।

করোনাকালেই ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালে সংকটাপন্ন রোগীদের চিকিৎসার জন্য গত বছরের অক্টোবরে আইসিইউ বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। আর এ বছরের এপ্রিলে স্থাপন করা হয় ১৫টি হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ)। কিন্তু এখন পর্যন্ত আইসিইউ ও এইচডিইউ’র কোনোটিই চালু করা যায়নি। আর এই আইসিইউ ও এইচডিইউ চালু না হওয়ার জন্য দায়ী জনবল সংকট।

আইসিইউ ও এইচডিইউ চালু করতে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিতে গত মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত মোট পাঁচ বার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরকে চিঠি দেওয়া হলেও কাজ হয়নি। আর তাই মানুষ যখন একটা আইসিইউ বেডের জন্য হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরছে, সে সময় ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘করোনাকালে মানুষকে চোখের সামনে আইসিইউ বেডের জন্য হাহাকার করতে দেখেছি। অথচ আমার হাসপাতালেই আইসিইউ বেড পড়ে আছে। কেবল প্রশিক্ষিত জনবল, অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের অভাবে এই আইসিইউ ইউনিট চালু করা যায়নি। এর চেয়ে অক্ষমতা আর কিছু নেই। করোনাকালের এই অভিজ্ঞতা জীবনে কোনোদিন ভুলবো না।’

যেকোনও অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন অ্যানেস্থেসিওলজিস্টরা। এমনিতেই দেশে অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের সংখ্যা কম। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতাগুলোতে সার্জন আর অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের অনুপাত খুবই কম। সদর হাসপাতালগুলোতে সার্জারি, অর্থোপেডিক্স, নাক-কান-গলাসহ সব বিভাগেই একজন সিনিয়র ও একজন জুনিয়র কনসালট্যান্ট থাকেন। কিন্তু  বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট থাকেন একজন। কোথাও কোথাও সর্বোচ্চ দুজনের দেখা মেলে। যদিও সার্জন ও অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের সংখ্যা সমান বা কাছাকাছি হওয়া জরুরি। অ্যানেস্থেসিওলজি বিভাগের এ অবস্থার জন্য হাসপাতালগুলোতে যথাযথ পদ না থাকা, প্রাইভেট প্র্যাকটিসে উপযুক্ত সম্মানী না থাকার মতো কারণগুলো উল্লেখ করছেন সংশ্লিষ্টরা।

শুরু থেকেই বাংলাদেশে অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের সংখ্যা একেবারেই কম। কিন্তু সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে চলমান করোনা মহামারি। দেশজুড়ে জনবলের অভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে আইসিইউ চালু করা যায়নি, এর অন্যতম কারণ ছিল অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট সংকট। খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদফতর এ সংকটের কথা একাধিকবার স্বীকার করেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রতিটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপনের নির্দেশ দেন। কিন্তু সেখানে কেন এখনও আইসিইউ স্থাপন করা যাচ্ছে না এমন প্রশ্নে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা বলেন, ‘কেবল যন্ত্রপাতি স্থাপন করলেই একটা আইসিইউ হয়ে যায় না। এর জন্য পর্যাপ্ত জনবল দরকার হয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট অথবা অবেদনবিদ। কিন্তু অবেদনবিদের সংখ্যা আমাদের দেশে একেবারেই অপ্রতুল।’

অবেদনবিদের এ সংকট মেটাতে গত মাসে এ বিভাগে জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গত ১২ সেপ্টেম্বর অ্যানেস্থেসিওলজি বিভাগে জুনিয়র কনসালট্যান্ট পদে নিয়োগ পাওয়া ৪০৯ জনের ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক দেশে অ্যানেস্থেসিওলজি বিশেষজ্ঞ সংকট রয়েছে জানিয়ে বলেন, ‘অ্যানেস্থেসিওলজির নতুন নিয়োগটি দ্রুত সময়ের মধ্যে দেওয়া হয়েছে এবং আরও নিয়োগ দেওয়া হবে। সংকট সমাধানে পর্যায়ক্রমে নিয়োগ দেওয়া হবে।’

৪০৯ জন নতুন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট নিয়োগ দেওয়াকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা মন্তব্য করে সেদিন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বলেন, ‘এমন নিয়োগ বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে হয়নি।’

বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট, ক্রিটিক্যাল কেয়ার অ্যান্ড পেইন ফিজিশিয়ানসের (বিএসএসিসিপিপি) তথ্য মতে যেকোনও উন্নত দেশে ১ লাখ মানুষের জন্য নিদেনপক্ষে পাঁচ থেকে ১০ জন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট বা অবেদনবিদ থাকেন। উন্নয়নশীল দেশে সেটা অন্তত পাঁচ জন হতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য মাত্র একজন অবেদনবিদ রয়েছেন।

বিএসএসিসিপিপি’র মহাসচিব এবং বারডেম হাসপাতালের অ্যানেস্থেসিওলজি ও আইসিইউ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. কাওছার সরদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য মাত্র একজন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট রয়েছে, অথচ কমপক্ষে দরকার পাঁচ জন। অর্থাৎ আমাদের দেশে আমরা ফাইভ টাইম ডাউনে রয়েছি।’

কেন বাংলাদেশে অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের সংখ্যা কম জানতে চাইলে ডা. কাওছার সরদার বলেন, ‘যত পদ হাসপাতালগুলোতে দরকার, তত পদ নেই। এই কিছুদিন আগ পর্যন্ত সার্জারির এত ডিসিপ্লিন ছিল না, যেটা এখন হয়েছে। যেমন: প্লাস্টিক সার্জারি, অর্থোপেডিক্স, কার্ডিও ভাসকুলার সার্জারিসহ সার্জারির বিভিন্ন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। কিন্তু এখন সার্জারির বিভিন্ন এক্সপানসন হলেও একেবারেই অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত থাকার পরও অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের ক্ষেত্রটা সেভাবে তৈরি হয়নি। এর কারণ পদ নেই, পদ লিমিটেড।’

পদের সংকটকে বড় কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে প্রাইভেট প্র্যাক্টিসে অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের যে পরিশ্রম, সে অনুযায়ী সম্মানী নেই। এ কারণে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীরা যখন দেখেন মেডিসিন বা সার্জারি বা অন্য যেকোনও সেক্টরে প্রাইভেট প্র্যাক্টিসে এই সেক্টরের চেয়ে সম্মানীটা বেশি, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা এ সেক্টরের প্রতি আগ্রহ হারায়।’

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের অ্যানেস্থেসিওলজি বিভাগের প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহজাদ হোসেন বলেন, ‘বিদেশে অ্যানেস্থেসিয়া যতটা মূল্যায়িত হয়, বাংলাদেশে সে রকম হয় না। একজন সার্জনকে যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়, একজন অ্যানেস্থেসিওলজিস্টকে সেভাবে করা হয় না। দেশের বাইরে একজন অ্যানেস্থিওলজিস্ট অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট ফিজিসিয়ান, আর আমাদের দেশে কেবলই অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের পেশায় অ্যানেস্থেসিওলজিস্টরা কোনও ওয়ার্ড সুপারভাইজ করেন না। রোগী থাকে সার্জনদের হাতে। অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট রোগীদের “ডিল” করেন কেবল অপারেশন থিয়েটারে। এ কারণে সার্জনদের একটি কমন প্রবণতা হচ্ছে—তারা মনে করেন রোগী তাদের। তারা ভাবেন রোগীদের প্রতি অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের দায়বদ্ধতা তাদের তুলনায় কম। দেখা যায়, সার্জনদের এই মনোভাবের কারণে অ্যানেস্থেসিওলজিস্টরা ভেতরে ভেতরে অসন্তুষ্ট থাকেন। একই কোয়ালিফিকেশন নিয়ে যখন একজন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট কম মূল্যায়িত হন, তখন ডিসিপ্লিনের প্রতি টেলেন্টেড চিকিৎসকদের আগ্রহ কমতে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।’

‘সংকটের মূল কারণ এই সাবজেক্টের পপুলারিটি বাংলাদেশে কম, যেটা উন্নত বিশ্বের একেবারেই বিপরীত’, বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানেস্থেসিয়া বিভাগের রেসিডেন্ট সাদিয়া আহমেদ। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘মেডিক্যাল শিক্ষার্থীরা কার্ডিওলজিস্ট, সার্জন অথবা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, কিন্তু একজন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট হবেন—এটা কারও ড্রিম থাকে না। হয়তো চাপে পড়ে অথবা অন্যান্য বিষয়গুলোতে সুযোগ না পেয়ে, প্ল্যান “বি” ভেবে এই বিভাগে আসি। অথচ এর পরিধি কত বড়, সেটা এই করোনাকালে মানুষ জানতে পেরেছে।’

তিনি বলেন, ‘অথচ অন্যান্য দেশে অ্যানেস্থেসিয়া হচ্ছে টপ ওয়ান সাবজেক্ট, প্রায়োরিটি অনেক বেশি।’ কিন্তু আমাদের দেশে ঠিক উল্টো মন্তব্য করে সাদিয়া আহমেদ বলেন, ‘এখানে একজন রোগী কখনও জানতে পারে না, তার অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট কে? তার অস্ত্রোপচারের আগে কে তাকে অজ্ঞান করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছেন। অথচ আমরা ব্যাকস্টেজে কাজ করছি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করছি।’

এই চিকিৎসক আরও বলেন, ‘অস্ত্রোপচারের বেলায় অবেদনবিদের বিষয়টি নির্ভর করে সার্জনের ওপর, সার্জন নির্ধারণ করেন বিষয়টি। কিন্তু এই চয়েসটি যদি রোগীর করার সুযোগ থাকতো, তাহলে এই সংকট হতো না। অনেক বেশি দৃশ্যমান থাকতো এই বিভাগ।’

/আইএ/ইউএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী