জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালন হচ্ছে আজ। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য করা হয়েছে, ‘গতিসীমা মেনে চলি, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করি’। দিবসটি পালনে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, অনিরাপদ সড়ক ও অব্যবস্থাপনার কারণে এ সেক্টরে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না; বরং দিনদিন বেড়েই চলেছে। দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রাষ্ট্রপতি তাঁর বাণীতে বলেন, ‘বাংলাদেশে উন্নত সড়ক অবকাঠামো বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সড়কপথে মোটরযানের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত গতি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। তাই জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি রোধকল্পে গতিসীমা মেনে চলা আবশ্যক। এ প্রেক্ষাপটে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসের এ বছরের প্রতিপাদ্য “গতিসীমা মেনে চলি, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করি” যথার্থ ও সময়োপযোগী হয়েছে বলে আমি মনে করি।’
বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সড়ককে নিরাপদ করতে এবং সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের সরকার সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন ও আধুনিকায়নসহ নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এ সরকারের সময় মহাসড়ক ২২ হাজার ৪২৮ কিলোমিটারে উন্নীত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৩২ কিলোমিটার মহাসড়ক ৪-লেন ও তদূর্ধ্ব লেনে উন্নীতকরণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ৬৪৭ কিলোমিটার মহাসড়ক ৬ লেনে উন্নীতকরণের কাজ চলমান রয়েছে। সমীক্ষা প্রকল্পের মাধ্যমে এক হাজার ৭৫৩ কিলোমিটার মহাসড়ক ৬ লেনে উন্নীতকরণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এবং পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া ৫৯০ কিলোমিটারের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা কার্যক্রম চলমান রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেশে প্রথমবারের মতো নির্মিত হয়েছে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে। যানজটবিহীন যাতায়াতব্যবস্থা ও দ্রুত যোগাযোগের সুবিধার্থে মেট্রোরেল, বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লাইন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভার, ওভারপাস-আন্ডারপাস, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ এবং বিভিন্ন মহাসড়কের বাঁক সরলীকরণ, মজবুতকরণ ও প্রশস্তকরণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং বেশ কিছু কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া দেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় মহাসড়কের ৪টি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ট্রাক চালকদের জন্য বিশ্রামাগার নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।’
অপরদিকে, দিবসটি উপলক্ষে বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনি মিলনায়তনে ‘সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক সংলাপ’ শীর্ষক আলোচনার আয়োজন করা হয়। এতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান জানান, সড়ক দুর্ঘটনায় যুবকদের মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। ২০১৯ সালে তিন হাজার ৯৩৭টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে মারা যান ৪ হাজার ৩৫৮ জন, আহত হন ৭ হাজার ২৪০ জন। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩২ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। আর চলতি বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষতির পরিমাণ ২৯ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা।’
নিরাপদ সড়কের জন্য সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘ধারাবাহিকভাবে তিনবারের ক্ষমতাসীন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনি নানা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হলেও তৃতীয় মেয়াদের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতিতে নিরাপদ সড়কের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে গাফিলতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব মতে, সারাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৪ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে। ১৫০ জনের বেশি মানুষ আহত হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে ৬ হাজার ৫৮১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৬৪২ জন নিহত ও ২১ হাজার ৮৫৫ জন আহত হয়েছেন। ২০১৬ সালে ৪ হাজার ৩১২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫৫ জন নিহত ও ১৫ হাজার ৯১৪ জন আহত হয়েছেন। ২০১৭ সালে ৪ হাজার ৯৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৩৯৭ জন নিহত ও ১৬ হাজার ১৯৩ জন আহত হয়েছেন। ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ জন নিহত ও ১৫ হাজার ৪৬৬ জন আহত হয়েছেন। ২০১৯ সালে ৫ হাজার ৫১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮৫৫ জন নিহত, ও ১৩ হাজার ৩৩০ জন আহত হয়েছেন। ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণে বছরব্যাপী লকডাউনে পরিবহন বন্ধ থাকা অবস্থায় ৪ হাজার ৮৯১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৬৮৬ জন নিহত ও ৮ হাজার ৬০০ জন আহত হয়েছেন। গত ৬ বছরে ৩১ হাজার ৭৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ হাজার ৮৫৬ জন নিহত ও ৯১ হাজার ৩৫৮ জন আহত হয়েছেন। অথচ জাতিসংঘ ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সালকে সড়ক নিরাপত্তা দশক ঘোষণা করে সদস্য দেশগুলোর সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার অনুস্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এ অঙ্গীকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে।