মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটে যানবাহন নিয়ে ডুবে যাওয়া শাহ আমানত ফেরিটি ৪২ বছরের পুরনো। হালনাগাদ করা হয়নি সার্ভে সনদ। অবাক করা বিষয়, ১৭টি পণ্যবাহী ট্রাক ও ১৬টি মোটরসাইকেল নিয়ে ডুবে যাওয়া ৪০০ টনের ফেরিটি উদ্ধারে কাজ করবে ৩১০ টন সক্ষমতার দুটি ফেরি।
বুধবার (২৭ অক্টোবর) বিকালে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা ফেরিঘাটের এজিএম (মেরিন) আব্দুস সাত্তার এসব তথ্য জানিয়েছেন।
এরই মধ্যে ফেরিডুবির ঘটনায় সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। বিকালে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) সুলতান আব্দুল হামিদকে প্রধান করে এ কমিটি করা হয়। বিআইডব্লিউটিসি’র পরিচালক (বাণিজ্য) আতিকুজ্জামান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এ ছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক আব্দুল লতিফ বিষয়টি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ছানোয়ারুল হককে প্রধান করে কমিটি করা হয়েছে। কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, বিআইডব্লিউটিসি’র চেয়ারম্যান সৈয়দ তাজুল ইসলাম, বিআইডব্লিউটিএ’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নুরুল আলম, বিআইডব্লিউটিসির’র পরিচালক (বাণিজ্য) আশিকুজ্জামান, মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক আব্দুল লতিফ, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ গোলাম আজাদ খান, নৌ-পুলিশের ফরিদপুর জোনের পুলিশ সুপার জসিম উদ্দীন, বিআইডব্লিউটিসির’র ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি ও জাতীয় শ্রমিক লীগের সহ-সভাপতি মহসিন ভূঁইয়া, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ঢাকা অঞ্চলের উপ-পরিচালক দিনমনি শর্মা।
বিআইডব্লিউটিএ’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নুরুল আলম বলেন, ফেরি উদ্ধার করতে বেগ পেতে হবে। কারণ যে দুটি উদ্ধারকারী জাহাজ দিয়ে ডুবে যাওয়া ফেরি উদ্ধার করা হবে; সে দুটির সক্ষমতা ৩১০ টন (হামজার ৬০ এবং প্রত্যয়ের ২৫০ টন)। অথচ ডুবে যাওয়া ফেরি আমানত শাহর ভেতরের পানিসহ ওজন হবে এক হাজার টন। কীভাবে উদ্ধার হবে, সে কৌশল নিয়ে ফেরি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকের কথাও জানান তিনি।
ফেরিতে ছিল না সার্ভে রেজিস্ট্রেশন ও সনদ
বিআইডব্লিউটিসির’র এজিএম (মেরিন) আব্দুস সাত্তার জানিয়েছেন, ৪২ বছর আগের ফেরি শাহ আমানত দীর্ঘদিন ধরে চলছিল ফিটনেসবিহীন। এ বিষয়ে আবেদন করা হয়েছিল। আমানত শাহ ফেরি ১৯৭৯ সালে আরিচা ফেরিঘাটে যোগ হয়েছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী গাড়িচালকদের বর্ণনা
ফেরিতে থাকা বেনাপোল থেকে আসা কেমিক্যাল বহনকারী আফজাল পার্সেলের কাভার্ডভ্যাননের চালক মো. সেলিম হোসেন (২৪) বলেন, আমার গাড়ি ছিল ফেরির পেছনে। গাড়ির দুই চাকা ছিল পন্টুনে দুই চাকা ফেরিতে। চেয়ে চেয়ে দেখছি; ডুবে যাচ্ছে ফেরি, ডুবছে আমার গাড়ি।
ফেরিতে থাকা ট্রাকচালক সুশান্ত বলেন, নিউজপ্রিন্ট কাগজ নিয়ে ঢাকায় যাওয়ার কথা ছিল। পথিমধ্যে দুর্ঘটনায় পদ্মা নদীতে ডুবে গেলো ট্রাক।
ট্রাকচালক আমির হোসেন (৫০) জানালেন, তিনি সারা রাত গাড়ি চালিয়ে ক্লান্ত। ফেরিতে উঠার পর গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েন। ফেরি কখন ডুবেছে টের পাননি। গাড়িতে যখন পানি ঢুকেছে তখন ঘুম ভাঙে। ততক্ষণে গাড়িসহ তিনি পদ্মা নদীতে। পরে পাশের ট্রলারের সহায়তায় তীরে উঠতে সক্ষম হন।
একই কথা জানালেন কাভার্ডভ্যানচালক মো. কামাল হোসেন (৪৫)। তিনিও ক্লান্ত হয়ে ফেরিতে ওঠার পর ঘুমিয়ে পড়েন। ডুবে যাওয়ার সময় তার ঘুম ভেঙে যায়। তখন নদীতে ঝাঁপ দেন। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় তীরে উঠতে সক্ষম হন। কামাল বলেন, আমার গাড়ি পদ্মায় ডুবে আছে।
ফেরিতে থাকা মোটরসাইকেলচালক অমল কান্তি ভট্টাচার্যকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তার সঙ্গে থাকা মোটরসাইকেল ও মুঠোফোন পানিতে ডুবে যায়। পরে স্থানীয় এক ব্যক্তির ফোন থেকে বাসায় দুর্ঘটনার বিষয়টি জানান। খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে আসেন স্ত্রী দেবযানী ভট্টাচার্য।
অমল কান্তি বলেন, সকাল সাড়ে ৮টার দিকে মোটরসাইকেল চালিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই। দৌলতদিয়ার ৫ নম্বর ঘাটে ফেরি ভিড়তেই উঠে পড়ি। ফেরি মাঝনদীতে আসার পরই পানি উঠতে দেখে সবাই চিৎকার করতে থাকি। পরে ঘাটে ফেরি ভিড়তেই দেখি কাত হয়ে যাচ্ছে। কাত হয়ে গেলে ঘাটেই নদীতে পড়ে যাই। অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেলাম। তবে মোটরসাইকেল ও মুঠোফোন নদীতে পড়ে গেছে।
বিআইডব্লিউটিএ’র উদ্ধারকারী জাহাজ ‘হামজার’ কমান্ডার এসএম ছানোয়ার হোসেন বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি পাটাতন ফেটে পানি ওঠায় ডুবে যায় ফেরিটি। ফেরি উদ্ধারে মুন্সীগঞ্জ থেকে রওনা হয়েছে বিআইডব্লিউটিএ’র উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয়। জাহাজটি এখনও পাটুরিয়া ঘাটে এসে পৌঁছায়নি। এ পর্যন্ত ফেরিতে থাকা ও ডুবে যাওয়া ১৭টি পণ্যবাহী ট্রাকের মধ্যে ১০টি উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া দুটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করেছে ফেরি হামজা।