গানের শিল্পী, গ্রামোফোন, ক্যাসেট ও অন্যান্য: পর্ব ছয়

অমলা দাশের কারণেই অনেক প্রতিভাবান শিল্পী এসেছিলেন

সেই ১২৮০ বঙ্গাব্দ থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে বিস্তৃত হয়েছে পত্র-পত্রিকার পুজো সংখ্যা। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দে ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র মাধ্যমে  ঈদ সংখ্যার যাত্রা শুরু হয়। লক্ষণীয় হচ্ছে ধর্মীয় উৎসবকে উপলক্ষ করে অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনায় সমৃদ্ধ বিশেষ এই সংখ্যাগুলো সেই প্রথম থেকেই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল পাঠকের কাছেই সমাদৃত হচ্ছে। পুজো সংখ্যার শুরু নিয়ে যতটুকু জানা যায়-

কেশবচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত ‘ভারত সংস্কার সভা’ তাদের সুপরিচিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সুলভ সমাচার’র একটি সংস্করণ ‘ছুটির সুলভ’ নামে প্রকাশ করেছিলো ১২৮০ বঙ্গাব্দের ১০ আশ্বিন। যদিও এই সংখ্যায় পুজোর কোনও উল্লেখ ছিলো না, তবে পুজোর ছুটিতেই এই সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিলো। এই উপলক্ষে এক বিজ্ঞাপনে বলা হয়—

‘আগামী ছুটি উপলক্ষে সুলভের বিশেষ এক খণ্ড         বাহির হইবে। উত্তম কাগজ,উত্তম ছাপা।                 দাম কিন্তু ১ পয়সা।’

পুজোর ছুটির সময়ে ছোট ছোট মজাদার বইও বের হতো। একসময় ‘পুজো সংখ্যা’ শব্দটি প্রকাশনার সাথে যুক্ত হয়ে যায়। 

এইসব প্রকাশনা থেকে প্রভাবিত হয়ে হোক অথবা মার্কেটিং কনসেপ্ট থেকে হোক রেকর্ড কোম্পানির পুজোর রেকর্ড বের করা ছিল একটি ব্যবসায়িক স্মার্ট সিদ্ধান্ত। এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনায় নিঃসন্দেহে পুজোর ছুটিতে প্রকাশিত পত্রিকা সমূহের পরিকল্পনাগুলোও ছিল। 

উৎসবের সাথে গান সংযুক্ত করা গেলে, রেকর্ডের ব্যবসা বৃদ্ধি পাবে। এই ভাবনা থেকেই এক সময় ‘পুজোর গান’র রেকর্ডের আগমন ঘটে। তবে পুজোর গান ঠিক কোনও সময় থেকে প্রচলিত হয়েছে তার নির্ভুল তারিখ পাওয়া যায় না। কিছু কাগজপত্র এবং ১৯১৪ সালের ১৭টি গানের প্রকাশিত ক্যাটালগ থেকে গবেষকরা এক ধরনের উপসংহার টেনেছেন যে, ১৯১৪ সালে প্রথম পুজোর রেকর্ড প্রকাশিত হয়। 

রেকর্ডের বিজ্ঞাপনে লেখা হয় ‘ শারদীয়া পূজা উপলক্ষে’। বিজ্ঞাপনের একপাশে গ্রামোফোনের সামনে কুকুর, তার নিচে লেখা, NEW 10 INCH DOUBLE SIDED VIOLET LEBEL, বাঙ্গালা গ্রামোফোন রেকর্ড। তার পাশে একটি শাড়ি পরিহিতা হাতে ফুল নিয়ে পুষ্পাঞ্জলির ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, পেছনে কাশফুল, সামনে পুকুর, তার ওপারে পাহাড়, পাহাড়ের  ফাকে সূর্য উঠছে। উপরে বাংলায় শারদীয়া নিচে ‘হিজ মাস্টার ভয়েস’, তার নিচে শিল্পীদের নাম ও গানের প্রথম লাইন দেওয়া ছিল।
পুজোর গানে প্রথমবারের মতো যারা গেয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন 
কে. মল্লিক —
‘গিরি একি তব বিবেচনা’ (আগমনী; মিশ্র কাফি), ‘কী হবে উমা চলে যাবে’-(বিজয়া;ভৈরবী)।

মানদা সুন্দরী দাসী—
‘এস এস বলে রসিক নেয়ে’ ( কীর্তন), ‘আমার সুন্দর মা’ (কীর্তন)

নারায়ণচন্দ্র মুখার্জি —
‘দেখ লো  সজনী আসে ধীরিধীরি’ (আগমনী,বেহাগ-খাম্বাজ), 
‘ও মা ত্রিনয়না যেও না যেও না’ ( বিজয়া- ভৈরবী) 

কৃষ্ণভামিনী—
‘মাকে কে জানে’ ( মালকোষ), ও ‘অলস অবশে বল কালী’ (পূরবী), 

মিস দাশ —
‘হে মোর দেবতা’ (ইমন কল্যাণ)’, ‘প্রতিদিন আমি হে জীবনস্বামী’ ( সিন্ধু কাফি)। 

কাছাকাছি সময়ে গ্রামোফোন কোম্পানি গানের কথাসহ ‘শারদীয়া’ নামে ছোট বই প্রকাশ করতে থাকে। রেকর্ড কেনার সময় ক্রেতাকে এই ছোট বই বিনা পয়সায় দেওয়া হতো। এইচ এম ভি প্রথমে শুরু করলেও পরে অন্যান্য রেকর্ড কোম্পানিগুলোও একই পথ অনুসরণ করে।

পুজোর রেকর্ডে প্রকাশিত মিস দাশের গান দুটি ছিল রবীন্দ্রনাথের গান। তখন রবীন্দ্রনাথের গান রবীন্দ্রসংগীত নয়, রবি বাবুর গান হিসাবেই পরিচিত ছিল। মিস দাশ স্বনামে গান করেননি। কারণ তখন পর্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েরা গ্রামোফোন রেকর্ডে গান গাইতেন না। মিস দাশ  ছিলেন দেশবন্ধু চিত্ত রঞ্জন দাশের বোন, অমলা দাশ। তবে, পরে তিনি নিজ নামে অনেক গান রেকর্ড করেছেন। বলা যেতে পারে - সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের গান রেকর্ড করার ক্ষেত্রে সংকোচের যে দেয়াল ছিল, অমলা দাশই তা প্রথম ভেঙে দিয়েছিলেন।সাহানা দেবী

খুবই ভালো গান গাইতেন অমলা। প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ সাহানা দেবী ছিলেন অমলা দাশের বোনের মেয়ে। তিনি অমলা দাশ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘তার কণ্ঠে তান যে কি অপূর্ব ছিল, দানাগুলি সব যেন আলাদা হয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠত। আর কী কণ্ঠই ছিল মাসিমার! কোথায় গলা চলে যেত তারা সপ্তকের ধৈবত পর্যন্ত!’

তিনি আরও লেখেন, ‘রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার দ্বৈতসংগীত, তখনকার দিনে যারা শুনেছেন তাদের মুখেই শুনেছি যে, সে ভুলবার নয়।’

কলকাতায় কংগ্রেসের সম্মেলন হচ্ছে। তখনকার দিনে মাইক ছিল না। অমলা একা গাইলেন ‘বন্দেমাতরম’। সম্মেলনের বিশাল প্যান্ডেলের শেষ পর্যন্ত অমলার  কণ্ঠ শোনা গিয়েছিল। অমলার অনেক গুন ছিল। প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী ও বুদ্ধিমতী ছিলেন। অমলা দাশ

দেশবন্ধু সি আর দাশ বলতেন ‘ অমলা যদি ব্যারিস্টার হত তবে ওর সঙ্গে আমরা পেরে উঠতাম কিনা সন্দেহ।’

১৮৭৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন অমলা। ১৯১৯ সালে,অন্তিম শয্যায় নাটোরের মহারাজা যোগীন্দ্রনাথের গাওয়া নিজের প্রিয় গান শুনলেন। এবং অমলা দাশ ইহলোক ত্যাগ করলেন। বয়স তখন মাত্র ৪২। 

গ্রামোফোন রেকর্ডে অমলা গান গাওয়ার কারণেই আমরা পরবর্তী সময়ে অনেক প্রতিভাবান শিল্পী পেয়েছিলাম। সংগীতে অমলার এই অবদান তাই চির অম্লান  হয়ে থাকবে। 

চলবে…

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গীতিকবি

তথ্যসূত্র:
‘স্মৃতির খেয়া’ -সাহানা দেবী।
পুজোর গানের গৌরবময় অতীত’ -গোপাল দাস
‘পুজোর গান- গানের পুজো’ সোমেন দে। -Guruchandali.com
‘পুজো সংখ্যার সেকাল-একাল’ সন্দীপ কুমার দাঁ -sirshtisandhan.com
‘ঈদ সংখ্যা ৪৩ বছর আগে’ চিন্ময় মুৎসুদ্দী -risingbd.com

 

প্রথম পর্ব: অ্যাঞ্জেলিনা ইয়ার্ড থেকে সুপার স্টার গওহর জান হয়ে ওঠার ইতিহাস

দ্বিতীয় পর্ব: শিল্পীদের আয়ের বিজ্ঞানসম্মত পথ খুলে দেয় গ্রামোফোন

তৃতীয় পর্ব: গান-বাণিজ্যে গওহর জান নায়িকা হলে, লালচাঁদ বড়াল নায়ক

চতুর্থ পর্ব: ‘সেকালের কলকাতার লোকেরা ছিলেন সংগীত-ছুট’

পঞ্চম পর্ব: রেকর্ডিং কোম্পানিগুলোর কাছে যোগ্য সম্মানি পাননি কে. মল্লিক