অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে স্বাস্থ্য খাত

‘সন্তানের এ মৃত্যু আমি কীভাবে মেনে নিই! কোনও বাবাই মেনে নিতে পারে না। ওরা আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। আমি ওদের বিচার চাই।’— এভাবেই বলছিলেন শিশু আহনাফ তাহমিদ আলম আয়হামের (১০) বাবা মোহাম্মদ ফখরুল আলম। রাজধানীর মালিবাগের জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিক্যাল চেকআপ সেন্টারে গত মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সুন্নতে খতনা করানোর সময় শিশুটি মারা যায়। তার বাবার দাবি, ডাবল অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে তার সন্তানকে হত্যা করা হয়েছে।

বেশ কিছুদিন ধরেই অ্যানেস্থেসিয়ার ভুল প্রয়োগে রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এর আগে রাজধানীর সাঁতারকুলে ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে খতনার জন্য অজ্ঞান করা শিশু আয়ান আহমেদ (৬) মারা গেছে। গত ৩১ ডিসেম্বর ওই হাসপাতালে খতনা করানোর জন্য আনা হয় আয়ানকে। সেদিন সকাল ৯টায় খতনা করার জন্য তাকে পুরোপুরি অজ্ঞান করা হয়। খতনা শেষে পর বেলা ১১টায়ও জ্ঞান না ফিরলে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে এনে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয় আয়ানকে।

এর সাত দিন পর লাইফ সাপোর্ট খুলে নিয়ে আয়ানকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।

আয়ানের চাচার অভিযোগ, ‘আংশিক অচেতন করে খতনা করানোর কথা থাকলেও চিকিৎসকরা আয়ানকে পুরোপুরি অজ্ঞান করেছিল। রাতেই ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আয়ানের মৃত্যু সনদ দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে— আয়ানের মৃত্যুর কারণ কার্ডিও-রেসপিরেটরি ফেইলিওর, মাল্টিঅর্গান ফেইলিওর এবং কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট।’

অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগের ফলে পর পর দুটি শিশুর মৃত্যুতে আতঙ্কে ভুগছেন অভিভাবকরা। কোনও ধরনের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা ছাড়া এনেস্থেসিয়া প্রয়োগের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে অনেক বড় ঝুঁকির মধ্যে আছেন চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগীরা।

দেশে দুই হাজারের বেশি অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট রয়েছেন। তবে এ সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। সরকারি হাসপাতালগুলোতে গড়ে সার্জন রয়েছেন একজন। প্রতি দুটি হাসপাতালের বিপরীতে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট আছে একজনেরও কম। এসব হাসপাতালে গড়ে প্রতি তিন জন সার্জনের বিপরীতে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট রয়েছেন মাত্র একজন। একটি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের কাজ করেন সার্জন, আর রোগীকে অচেতন করা এবং জ্ঞান ফিরিয়ে নিয়ে আসার কাজটি করেন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট।

‘বাংলাদেশ হেলথ ওয়ার্কফোর্স স্ট্র্যাটেজি ২০২৩’ এর তথ্যমতে, অনেক হাসপাতালে সার্জন রয়েছে, কিন্তু অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট বা ল্যাব টেকনিশিয়ান নেই। যে কারণে সেখানে কোনও অস্ত্রোপচার করা হয় না।

পর পর কয়েকটি দুর্ঘটনার কারণে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে ১০টি বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সেখানে বলা হয়েছে, ‘কোনও অবস্থাতেই লাইসেন্সপ্রাপ্ত বা নিবন্ধিত হাসপাতাল ও ক্লিনিক ব্যতীত চেম্বারে, অথবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া যাবে না। বিএমডিসি স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ ছাড়া যেকোনও ধরনের অপারেশন বা সার্জারি বা ইন্টারভেনশনাল প্রসিডিউর করা যাবে না।’

মালিবাগের ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেওয়ার পর স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান জানান, হাসপাতালটির সব তথ্য আমাদের হাতে এসেছে। আমরা সেগুলো পর্যবেক্ষণ-পর্যালোচনা করছি। যতটুকু পেয়েছি, প্রতিষ্ঠানটির হাসপাতাল কার্যক্রম চালানোর কোনও অনুমোদন ছিল না। তবে তাদের ডায়াগনস্টিক কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন রয়েছে। সুতরাং, তারা যদি কোনও রোগীকে এনেস্থেসিয়া দিয়ে থাকে, সেটি অন্যায় করেছে। আর যিনি অপারেশন করেছেন, তার বিরুদ্ধে আমরা আইন অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি। ব্যবস্থা নিতে অধিদফতর বিএমডিসিকে চিঠি দিয়েছে।’

চিকিৎসকদের মতে, অস্ত্রোপচারের আগে রোগীর শারীরিক অবস্থা কেমন, তা বোঝার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন। রিপোর্ট দেখে একজন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট সিদ্ধান্ত দেবেন— অস্ত্রোপচার চলবে কিনা। যদি সব কিছু ঠিক থাকে, তবে সার্জন অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেবেন।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট- এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে উচ্চতর পোস্ট-গ্র্যাজুয়েটধারী অ্যানেস্থেসিলজিস্টসের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে রয়েছেন ৮০০ থেকে ৯০০ জন। অনেকে দেশের বাইরে আছেন। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, দেশে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট প্রয়োজন কমপক্ষে ১২ থেকে ১৩ হাজার। ঘাটতি পূরণ না হওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ না থাকা একটি অন্যতম কারণ। সোসাইটির মতে,  মেডিক্যালের অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে অ্যানেস্থেসিয়া বিষয়টি জটিল। যারা এই বিষয়ে ক্যারিয়ার গড়তে চাইছেন, তাদের বেতন ও সামাজিক মর্যাদা অনান্য চিকিৎসকের তুলনায় অনেক কম।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেস্থেসিওলজিস্টসের সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অ্যানেস্থেসিয়া, অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বনিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অ্যানেস্থেসিয়া এমন একটি বিষয়, যেখানে সব পোস্টগ্র্যাজুয়েশন করা চিকিৎসকরাই প্র্যাক্টিস করেন। কিন্তু আমাদের জনবলের সংকট আছে। সংকটের কারণেই অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়— অন্য অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে দেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে যারা সার্জারি করেন, তারা কোনও না কোনোভাবে অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে থাকেন। এর ফলে কিছু কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সরকারি-বেসরকারি দুই পর্যায়ে অনেক জনবল দরকার। যে জনবল বর্তমানে আছে, তা খুবই অপ্রতুল। হিসাব করে দেখেছি, আমাদের সাড়ে আট হাজার লোক দরকার। কিন্তু সেটা তো আর একদিনে সম্ভব না। পাশাপাশি শুধু জনবল তৈরি করলে তো চলবে না— পোস্ট গ্র্যাজুয়েট লাগবে, পদায়ন লাগবে।  পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ছাড়া যদি অ্যানেস্থেসিয়ার কাজ করতে চান, সেক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কারণ, এমবিবিএসে তো অ্যানেস্থেসিয়ার বিষয়ে তেমন কিছু নেই। একজন মানুষকে ‘মৃত’ করা এবং ‘জীবিত’ করা অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের কাজ। এছাড়া খুব ক্রিটিক্যাল রোগীকে বাঁচাতেও অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের প্রয়োজন আছে।’

বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. কাওসার সরদার বলেন, ‘‘আমাদের দেশে অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের সংকট রয়েছে। দেখা যায়, প্রশিক্ষণ নেই বা অন্য বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করেছেন, তিনিও অ্যানেস্থেসিয়া দিচ্ছেন। এটি দেওয়ার জন্য যে ‘স্ট্যান্ডার্ড সেটআপ’ দরকার, সেটি অনেক অপারেশন থিয়েটারে নেই। অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া থেকে শুরু করে, সেখানে যদি রোগীর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়, সেটি পুনরায় সচল করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সেটি অনেক জায়গায় থাকে না। অথচ সার্জারি চলছে।’

আরও পড়ুন:

খতনা করাতে গিয়ে শিশুর মৃত্যু: রিমান্ড-জামিন নামঞ্জুর, দুই চিকিৎসককে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ

খতনা করতে গিয়ে আয়হামের মৃত্যু: মেডিক্যাল সেন্টার সিলগালা

খতনা করাতে গিয়ে আরেক শিশুর মৃত্যু: দুই চিকিৎসক আটক

খতনা করাতে গিয়ে শিশুমৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ চাইল্ডস রাইটসের

শিশু আয়ানের মৃত্যু: তদন্তে নতুন কমিটি করে দিলেন হাইকোর্ট

শিশু আয়ানের মৃত্যু: তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় বেঁধে দিলেন হাইকোর্ট

আয়ানের মৃত্যু: ইউনাইটেড হাসপাতালের পরিচালকসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা

শিশু আয়ানের মৃত্যুতে কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিট