দেশের কাঁচাবাজার মানেই কাদা-পানিতে একাকার হয়ে থাকা এক স্থান। বর্ষায়-বৃষ্টিতে বাজার করতে যাওয়া মানে কাপড়চোপড়, জুতা-স্যান্ডেলে কাদা ও ময়লা নিয়ে বাড়ি ফেরা। অন্যান্য সময়ও যে বাজারের পরিবেশ খুব পরিচ্ছন্ন থাকে তেমন না। এ কারণে শহরের অনেকেই এখন অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধার সুপারশপে বাজার করেন। কিন্তু সুপারশপের সুবিধা সব জায়গায় নেই। ফলে অধিকাংশ মানুষ এখনও বাজার করেন ‘অস্বস্তিকর’ কাঁচাবাজারে। তবে সরকার এসব বাজারের অবকাঠামো পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
শহরের সুপারশপের মতোই পরিচ্ছন্ন, আরও বেশি খোলামেলা, আরও প্রশস্ত কাঁচাবাজার নির্মাণের (উন্নয়ন) উদ্যোগ নিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এতে অর্থায়ন করছে বিশ্বব্যাংক। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া এই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ২০২৫ সালের অক্টোবরে। প্রথম ধাপে ১৪০টি কাঁচাবাজার তৈরির পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, পরে দেশের সবখানে গড়ে উঠবে এ ধরনের বাজার। সেখানে বিক্রীত পণ্য হবে স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ।
তবে জমি বরাদ্দ পাওয়া, বাজার তৈরির পর দোকান বরাদ্দ করা সংক্রান্ত কিছু জটিলতায় বেশ কিছু জায়গায় এই প্রকল্পের কাজ আটকে আছে বলে জানান প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) আওতায় সারা দেশে জলবায়ু সহিষ্ণু কাঁচাবাজার নির্মাণ করা হবে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলা সদর, উপজেলা সদর, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় ১৪০টি কাঁচাবাজারের নির্মাণকাজ চলছে। পাঁচটি বাজারকে একত্রিত করে একটি প্যাকেজ ধরে নির্মাণকাজ পরিচালনার জন্য ১০ কোটি টাকা করে দরপত্র আহ্বান করে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর। এ হিসাবে প্রতিটি কাঁচাবাজার নির্মাণে ২ কোটি টাকা করে বরাদ্দ করে বিশ্বব্যাংক।
প্রতিটি বাজারে জায়গা পাওয়া সাপেক্ষে একাধিক শেড থাকছে। আধুনিক মডেলের টিনশেডের অবকাঠামোটি পুরোটাই থাকছে টাইলস দিয়ে ঘেরা। পানির সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে বিদ্যুতের সংযোগও।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে এলডিডিপি প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক (ডিপিডি) প্রকৌশলী পার্থ প্রদীপ সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এলডিডিপি প্রকল্পের আওতায় স্থানীয় সরকার বিশেষ করে পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের তত্ত্বাবধানে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আপাতত ১৪০টি কাঁচাবাজার উন্নয়নের কাজ চলছে। নতুন কোনও স্থানে নয়, আগের ভাঙাচোরা, নোংরা, বাজারগুলোকেই অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হচ্ছে। বিদ্যমান ভাঙা অবকাঠামো সরিয়ে সেখানে নির্মিত হচ্ছে আধুনিক অবকাঠামো।’
তিনি বলেন, ‘টিনশেড হলেও সেখানে থাকছে তাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার উপযোগী চালা। নিচের অবকাঠামো ইটের, ফ্লোর টাইলসের। বাজার বলা হলেও মূলত এসব দোকানে প্রাণিজ পণ্য, বিশেষ করে গরু, খাসির মাংস, ডিম ও মুরগি বিক্রি হবে। গরু ও খাসির মাংস বিক্রির দোকানের চারপাশ খোলা হলেও ডিম-মুরগির দোকানে চারপাশের দেওয়ালসহ থাকছে শাটার। মুরগির দোকানগুলোর শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিটি মাংসের দোকানের কোনায় কোনায় থাকবে হাত ধোয়ার বেসিনসহ পানির লাইন যাতে মাংসের রক্ত-আবর্জনায় পরিবেশ নষ্ট না হয়। এর বাইরেও তাৎক্ষণিক ধোয়ামোছার জন্য টিনশেড অবকাঠামোর বিভিন্ন পয়েন্টে পানির কল রাখা হয়েছে।’
বাজারে আসা নারী-পুরুষ ক্রেতাদের জন্য পৃথক ওয়াশ রুম থাকছে জানিয়ে পার্থ প্রদীপ সরকার আরও বলেন, ‘দিনের বেলায় সূর্যের আলো ধরে রাখতে বাজারের চালের ওপর স্থাপন করা হচ্ছে সোলার প্যানেল। উৎপাদিত বিদ্যুৎ মূল লাইন দিয়ে পৃথক লাইনের মাধ্যমে বাজারে সংযোগ করা হবে। বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে সেভাবেই চুক্তি হয়েছে প্রাণিসম্পদ বিভাগের।’
এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘এ রকম বাজারে ব্যাটারি সংরক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ অনেকটা কঠিন বলে আমরা সেখানে আইপিএস না রেখে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা পারমিট করেছি। বাজারের এক শেড থেকে আরেক শেডে যাওয়ার জন্য নির্মাণ করা হবে অভ্যন্তরীণ পাকা সড়ক। থাকবে বৃষ্টির ও ব্যবহারের অতিরিক্ত পানি সরে যাওয়ার জন্য অভ্যন্তরীণ ড্রেন।’
এসব বাজারে দোকান বরাদ্দ পদ্ধতির ক্ষেত্রে যোগ্যতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বিদ্যমান বাজারে যারা বিক্রেতা রয়েছেন, তারাই বরাদ্দ পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন। বিদ্যমান বাজারে যতজন বিক্রেতা আছেন প্রত্যেককেই দোকান বরাদ্দ দেওয়া হবে। তাদের দেওয়ার পর অতিরিক্ত থাকলে আবেদনের ভিত্তিতে পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃপক্ষ বাকিগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ এলডিডিপি প্রকল্পের আওতায় অবকাঠামো উন্নয়নকাজ পুরোপুরি শেষে এ সব বাজার স্থানীয় পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তারাই দোকান বরাদ্দ দেবে। এ ক্ষেত্রে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ, বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ বা প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কোনও ভূমিকা রাখবে না।’
প্রকল্পের আওতায় পটুয়াখালী সদর ও পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার মাটিভাঙ্গা ইউনিয়ন এলাকায় জলবায়ু সহিষ্ণু কাঁচাবাজার নির্মিত হচ্ছে। এ বিষয়ে পটুয়াখালী পৌরসভার চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখনও আমরা ওই কাঁচাবাজারের দায়িত্ব বুঝে পাইনি। অবকাঠামোগত উন্নয়ন আরও কিছু বাকি আছে। পুরোপুরি সম্পন্ন হওয়ার পর বাজারটি বুঝে পেলে বিধিবিধান অনুযায়ী দোকান বরাদ্দ দেওয়া হবে। আশা করছি এটি হবে পটুয়াখালীবাসীর জন্য নিরাপদ খাদ্যের আসল ঠিকানা।’
মাটিভাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম বিলু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখনও আমি এই বাজারের বিস্তারিত কিছু জানি না। কারণ বাজারটির উন্নয়ন পুরোপুরি শেষ হয়নি। এর দায়িত্ব আমাদের দেওয়া হলে আইনে যা আছে সেভাবে বাজার পরিচালনা করবো।’
এক প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, ‘পক্ষপাতিত্বের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। সবাই আমার এলাকার বাসিন্দা, আমার ভোটার। আমি সবার কাছে যাই। সবাই আমার কাছে আসেন। কাকে বঞ্চিত করে কাকে সুবিধা দেবো?’
পটুয়াখালী সদর কাঁচাবাজারের গরুর মাংস বিক্রেতা খোরশেদ মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগে নোংরা পরিবেশে দোকান করতাম। এখানেই গরু জবাই করতাম, এখানেই আবর্জনা ফেলতাম; সেভাবে সুষ্ঠু কোনও পরিবেশ ছিল না। এখন পাকা সুন্দর দোকান পাচ্ছি, ভালো লাগছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দোকান, পানির সুব্যবস্থা থাকার কারণে আমাদের বিক্রীত মাংস স্বাস্থ্যসম্মত হবে, ক্রেতাও ভালো পাবো। বাজারের নোংরা পরিবেশের কারণে আগে যারা আসতেন না এখন তারা আসবেন। এর ফলে আমাদের ব্যবসাও ভালো জমবে।’
মাটিভাঙ্গার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ব্রয়লার মুরগি বিক্রেতা বাবুল মিয়া বলেন, ‘স্বাস্থ্যসম্মত আধুনিক সুবিধার বাজারে দোকান বরাদ্দ পাওয়ার ফলে আমাদের জীবনযাত্রার মান বাড়বে বলে আশা করছি।’
প্রকল্পের সবশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক পার্থ প্রদীপ সরকার জানান, কিছু জটিলতা রয়েছে। এর মধ্যে জমির মালিকানার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। প্রকল্পের আওতায় আমরা নতুন কোনও জমিতে কাঁচাবাজার নির্মাণ করছি না। যেখানে বাজার ছিল, কিন্তু ভাঙাচোরা ও অপরিচ্ছন্ন, সেখানে আমরা অবকাঠামোগত উন্নয়ন করছি মাত্র। তবে নতুন অকাঠামো উন্নয়নের জন্য যখনই পুরনো বাজারটি ভাঙা হচ্ছে, তখনই নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে নতুনভাবে জমির ব্যক্তিমালিকানা দাবি করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জেলা-উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরও বেশি সহযোগিতা প্রয়োজন। সেটি পাওয়া গেলে কাজটি আরও ত্বরান্বিত হতো। এ ধরনের জটিলতায় বেশ কয়েকটি স্থানে প্রকল্পের কাজ থমকে আছে।