সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের আমলে প্রভাবশালী কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপকে দেওয়া বিশেষ সুবিধার ঋণগুলোকে নজরদারিতে আনা হচ্ছে। ফজলে কবির গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর গত মাসে বিশেষ সুবিধায় পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা সব ঋণের তথ্য জোগাড় করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। তার এই নির্দেশনার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে আগামী ৯ মে’র মধ্যে ব্যাংকগুলোকে বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা সব ঋণের তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাতে বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
গত ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এই চিঠি পাঠানো হয়। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের যে সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, বিশেষ সেই সুবিধা পাওয়া ঋণের বর্তমান অবস্থা জানতে গত ১৭ এপ্রিল ব্যাংকগুলোর কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: আসামিপক্ষের শুনানি শেষ, রাষ্ট্রপক্ষের চলছে
এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবদুল হামিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যারা ভালো গ্রাহক তারা এমনিতেই ভালো। তাদের বিশেষ সুবিধা নেওয়ার দরকার ছিল না। তবে যেহেতু সুবিধা নেওয়ার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল এ কারণে অনেকেই ওই সময় বিশেষ সুবিধা নিয়েছেন। তিনি বলেন,যারা আসলে খারাপ গ্রাহক তারা সুযোগের অপব্যবহার করেছেন। তিনি জানান, বিশেষ সুবিধা নেওয়া একটা বড় অংশ আবারও খেলাপি হয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা বলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের পাশাপাশি কিছু জালিয়াতি প্রতিষ্ঠানেও খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের (নিয়মিত) সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সেই সময় পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন সুবিধার আওতায় প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত করা হয়। ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এ সুযোগ নেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় বড় শিল্প গ্রুপ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের সুবিধা পাওয়া ঋণের বর্তমান অবস্থা জানতে ব্যাংকগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যে সব শর্ত মেনে বিশেষ সুবিধা নেওয়া হয়েছিল সেগুলো মানা হচ্ছে কিনা, গ্রহীতারা ঠিকমতো ঋণ ফেরত দিচ্ছে কিনা, অথবা ওই ঋণ আবার খেলাপি হয়েছে কিনা, এসব বিষয়ে জানার জন্য ব্যাংকগুলোর কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: বিচারহীনতায় কমেনি সাংবাদিক নির্যাতন
প্রসঙ্গত, খেলাপি হওয়ার পরও কয়েকটি প্রভাবশালী ব্যবসায়ীকে বিশেষ সুবিধায় পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে ২০১৪ সালে ডিসেম্বরে বৃহৎ ঋণ পুনর্গঠনের একটি নীতিমালা তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নীতিমালার আওতায় বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। ওই নীতিমালায় নামমাত্র ডাউন পেমেন্টে খেলাপি ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশের ১১টি বড় শিল্প গ্রুপ ও প্রতিষ্ঠান ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকা পুনর্গঠন সুবিধা নেয়।
জানা গেছে, ২০১৩ সালের শেষ সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় ব্যবসা-বাণিজ্যসহ দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ঋণ পুনঃতফসিলে বিশেষ সুবিধা দিতে একই বছরের ২৩ ডিসেম্বর সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে ডাউন পেমেন্ট গ্রহণের শর্ত শিথিল ও ঋণের যৌক্তিক মেয়াদ ঠিক করা এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনাপত্তি নেওয়ার শর্ত দেওয়া হয়। এরপর ব্যাংকগুলো ঋণ পুনঃতফসিলের প্রতিযোগিতায় নামে। ওই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। এ সময় সাত শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে খেলাপির তকমা থেকে রেহাই দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: চার সাংবাদিককে কুপিয়ে জখমের ঘটনায় ৩ সাংবাদিকের নামে মামলা
নীতিমালা অনুযায়ী, মেয়াদি ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছে সর্বোচ্চ ১২ বছরের জন্য। আর তলবি ও চলমান ঋণ পুনর্গঠন হয়েছে ৬ বছরের জন্য। ১ হাজার কোটি টাকার কম ঋণের ক্ষেত্রে এককালীন বা ডাউন পেমেন্ট দিতে হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ হারে। আর এক হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণের ক্ষেত্রে এককালীন জমা দিতে হবে ১ শতাংশ হারে। একজন গ্রাহক একবারই এ সুবিধা পাবেন। তবে প্রতারণা ও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতরা এ সুবিধা পাবেন না। যেসব ব্যাংক এ ধরনের ঋণ পুনর্গঠন করবে, সেসব ব্যাংককে তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে পুনর্গঠিত ঋণের বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করতে হবে।
এদিকে বকেয়া ঋণের প্রকৃত অবস্থা যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে গত ৪ এপ্রিল সোনালী ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে ২৪টি প্রতিষ্ঠানের কাছে সোনালী ব্যাংকের বকেয়া ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকাই খেলাপি হয়ে পড়েছে।
জিএম/এমএসএম /আপ- এপিএইচ/