অর্থনীতির অন্যতম সূচক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক বছরের বেশি সময় ধরেই কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আর গত ১৮ অক্টোবরে সেই রিজার্ভ কমে হয়েছে ২৬ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী রিজার্ভ আরও কম—অর্থাৎ ২০ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। আর নেট রিজার্ভ ধরলে তা এখন ১৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছর ধরে প্রায় প্রতি মাসেই রিজার্ভ গড়ে ১ বিলিয়ন ডলার করে কমেছে। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকটি নিম্নমুখী হওয়ার জন্য বৈশ্বিক সংকটের পাশাপাশি কিছু ভুল নীতিও ভূমিকা রেখেছে।
ডলারের দাম বেঁধে রাখা
বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম নিয়ামক প্রবাসীদের পাঠানো কষ্টার্জিত ডলার। অথচ বৈধ পথে সেই ডলার প্রবাহে পড়েছে ভাটা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ডলারের দাম বেঁধে রাখার কারণেই মূলত প্রবাসী আয় কমে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, আবার ডলারের সরবরাহও বাড়েনি। এতে ব্যাংকগুলো আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ডলার সংগ্রহ করতে পারেনি। কিছু ব্যাংক বাধ্য হয়ে বেশি দামে ডলার কেনে। ব্যাংক ও ব্যবসার বাস্তবতা অনুধাবন না করে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু ব্যাংকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করে।’
তথ্য বলছে, ব্যাংকগুলোতে বিশেষ পরিদর্শন চালায় বাংলাদেশ ব্যাংক। বেশি দামে ডলার বেচাকেনায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে দেশি-বিদেশি ছয়টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে অপসারণও করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব তৎপরতার মুখেই গত বছরের সেপ্টেম্বরে এক ধাক্কায় রেমিট্যান্স ৫০০ মিলিয়ন ডলার কমে যায়।
চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ কমেছে। সর্বশেষ সেপ্টেম্বরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ১.৩৪ বিলিয়ন ডলার, যা গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
ডলারের বিনিময় হার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোরতার কারণেই রেমিট্যান্সের এই বড় পতন হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
প্রবাসী আয়ের নিম্নমুখী ধারায় যখন রিজার্ভ পতনশীল, তখন টাকা ও ডলার বিনিময় হারে নিয়মিত ও যথাযথ সমন্বয় না করে উল্টো নিজেদের বেঁধে দেওয়া ডলারের বিনিময় হার নিয়ে কঠোর হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকট আরও ঘনীভূত করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডলারের দাম বেঁধে রেখে প্রবাসী আয় বাড়ানো সম্ভব নয়। কারণ, বেশি দাম পাওয়ার কারণে প্রবাসীদের অনেকেই আয় হুন্ডিতে পাঠাচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার ভয়ে ডলারের দাম বেঁধে রাখার কারণে হুন্ডির ব্যবহার যেমন লাগাম ছাড়া হচ্ছে, তেমনই ডলারের প্রবাহও কমে যাচ্ছে, রিজার্ভও বাড়ছে না।’
নীতি সুদের হার বাড়াতে গড়িমসি করা
চলমান বৈশ্বিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ অর্থনীতির সংকট কাটাতে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ আগ্রাসীভাবে সুদহার বাড়িয়ে সফল হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রথম থেকেই আমদানি খরচ কমানোর অংশ হিসেবে নীতি সুদের হার বাড়াতে গড়িমসি করেছে। এতে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বাইরে পাচার হয়ে চলে গেছে বলে ধারণা করেন বিশেষজ্ঞরা।
অবশ্য চলতি মাসের ৪ অক্টোবর নীতি সুদহার বা রেপো রেট একবারে দশমিক ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নীতি সুদহার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে রেপো রেট ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
মূল্যস্ফীতির ওপর নীতি সুদহার বৃদ্ধি কেমন প্রভাব ফেলে, তা নিয়ে মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশের ওপর একটি গবেষণা করেছে আইএমএফ। এতে বলা হয়, নীতি সুদহার প্রতি এক শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ালে বিপরীতে প্রথম এক বছরে মূল্যস্ফীতি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশীয় হারে কমে, এবং মুদ্রার বিনিময় হার ১ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়লে মূল্যস্ফীতি কমে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশীয় পয়েন্ট হারে। কিন্তু, বেসরকারি বিনিয়োগ ও আমদানির খরচ বাড়ার কথা চিন্তা করে– বাংলাদেশ ব্যাংক এতদিন নীতি সুদহার বাড়ানোর বিষয়ে ধীরে চলার নীতিতেই অটল ছিল। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ আরও বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা অবশ্য দাবি করেছেন, বেসরকারি বিনিয়োগ ও আমদানির খরচ বাড়ার কথা চিন্তা করে বাংলাদেশ ব্যাংক এতদিন নীতি সুদহার বাড়ানোর বিষয়ে ধীরে চলার নীতিতেই অটল ছিল। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ আরও বেড়েছে। যদিও এই সংকট কাটাতে এখন ব্যাংকগুলোকে বেশি দরে ডলার কেনার সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিদেশি ঋণের সুদের ওপর কর আরোপ
প্রয়োজনীয় নীতি বদলানো বা নেতিবাচক নীতি আরোপের ক্ষেত্রে অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক একা নয়। বাংলাদেশ থেকে ডলার কমে যাওয়ার পেছনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক সিদ্ধান্তকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের ওপর ২০ শতাংশ উৎসে কর আরোপ করায় ডলারে নেওয়া বিদেশি ঋণ এখন স্থানীয় ঋণের চেয়ে ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে।
এদিকে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ এবিবির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বাজেটে বিদেশি ঋণের সুদ পেমেন্টের ওপর ২০ শতাংশ 'উইথহোল্ডিং ট্যাক্স' আরোপ করার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এনবিআরকে বলেছে, এই কর বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার খরচ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়ে দেবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এর ফলে বিদেশি ঋণ নেওয়ার খরচ কার্যত এক-চতুর্থাংশ বেড়ে যাবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘বিদেশি ঋণ নেওয়ায় সময় ব্যাংকগুলো যেসব অসুবিধার মুখোমুখি হচ্ছে, তা জানিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এনবিআরকে চিঠি দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এনবিআরকে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে কর প্রত্যাহারের অনুরোধ করা হয়েছে।’
ব্যাংকাররা আশঙ্কা করছেন, এই করের ফলে ডলারে ঋণ নেওয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও কমে যেতে পারে। এরই মধ্যে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপে পড়েছে বেসরকারি খাত। চলতি বছরের প্রথম ৭ মাসে বেসরকারি খাত যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ নিয়েছে, পরিশোধ করতে হয়েছে তার চেয়ে ৩ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার বেশি। এ সময়ে আগের ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে ১০.৯৩ বিলিয়ন ডলার। যদিও নতুন ঋণ এসেছে ১০.৫৯ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, গত মার্চে বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। এর ৩ মাস আগে অর্থাৎ জানুয়ারিতে এটি ছিল ২৪ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার।
সাধারণত, আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার এখন আগের লাইবর বেঞ্চমার্কের বদলে সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (সোফর)-এর মাধ্যমে হিসাব করা হয়। বিদেশি ঋণে ৩.৫ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত সুদের মার্জিন থাকে। সম্প্রতি ইউএস ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার বেড়েছে। তার সঙ্গে সোফর হার বেড়ে হয়েছে ৫.৩১ শতাংশ। মহামারিকালে এ হার ছিল মাত্র ০.২৫ শতাংশ। এর ফলে আন্তর্জাতিক ঋণের সুদহার গেছে বেড়ে। যেমন, বায়ার্স ক্রেডিট বা অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে এক বছরের জন্য ২ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিলে তার সুদ আসে কমবেশি ১ লাখ ৮০ হাজার ডলার।
নতুন উইথহোল্ডিং ট্যাক্স আরোপ করায় ঋণগ্রহীতাদের এখন প্রায় ৩৯ লাখ টাকা সুদ-সংক্রান্ত কর গুনতে হবে।। এই কর বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আরোপ করা হলেও শেষ পর্যন্ত এর চাপ ঋণগ্রহীতার ওপরই পড়ছে। এই কর আরোপের ফলে বিদেশি ঋণের সুদহার প্রায় ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ বিদেশি ঋণ এখন স্থানীয় ঋণের চেয়ে ব্যয়বহুল।
এনবিআর এর আগে ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর জারি করা একটি সার্কুলারের মাধ্যমে বিদেশি ঋণের সুদের ওপর কর মওকুফ করেছিল। এত বছর পরে ঠিক ডলার সংকটকালে চলতি বছরের ২৩ মে একটি সার্কুলার জারির মাধ্যমে এই সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়।
এনবিআরের এই সিদ্ধান্তে ডলারের অন্তর্মুখী প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি উল্লেখ করেন, এনবিআরের এই সিদ্ধান্তের কারণে অনেকেই বিদেশ থেকে আর ঋণ নিতে আগ্রহী হচ্ছে না। এতে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট তৈরি হচ্ছে।
ওয়েজ আর্নার বন্ডকে অনুৎসাহিত করা
রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে প্রবাসীদের জন্য চালু করা হয় সঞ্চয় প্রকল্প ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড।
আকর্ষণীয় মুনাফার কারণে প্রচুর প্রবাসী এতে বিনিয়োগও করেন। এই বন্ডে বিনিয়োগের সূত্র ধরে অনেকেই ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কিন্তু এই বন্ডে কালোটাকা বিনিয়োগ হচ্ছে—এমন অভিযোগের কারণে বিনিয়োগ সীমায় লাগাম টানার পাশাপাশি নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করায় বিনিয়োগ কমে যায়। সরকার ২০২০ সাল থেকে এ খাতে বিনিয়োগে লাগাম টানতে শুরু করে। এর প্রভাবে রেমিট্যান্সেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বর্তমানে এই বন্ড বিক্রি কমে যাওয়ায় অন্য খাত থেকে তহবিল এনে আগের বিনিয়োগের অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে।
ওয়েজ আর্নার বন্ডে নেতিবাচক নীতি নেওয়ার পরও প্রবাসীরা ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু এক বছর পর (২০২১-২২ অর্থবছরে) এই বিনিয়োগ কমে দাঁড়ায় ৮৬৬ কোটি টাকায়। এই অর্থবছরে মূল অর্থ পরিশোধ করতে হয় ১ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। এর ফলে ওই বছরে ৪১৫ কোটি টাকা ঘাটতি দেখা দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ওয়েজ আর্নার বন্ডে নেতিবাচক নীতির কারণে প্রবাসীদের পাঠানো ডলার রিজার্ভে যে পরিমাণ জমা হয়েছে, রিজার্ভ থেকে বের হয়েছে তার চেয়ে বেশি। আগে প্রবাসীরা এই খাতে যেকোনও পরিমাণ বিনিয়োগ করতে পারতেন। কিন্তু ২০২০ সালের ২১ ডিসেম্বর তা কমিয়ে ১ কোটি টাকায় নামিয়ে আনার পাশাপাশি পুনঃবিনিয়োগ বন্ধ করা হয়।
এরপর দেশে যখন ডলার সংকট শুরু হয়, তখন অর্থাৎ ২০২২ সালের এপ্রিলে সুদের হার অর্ধেক কমিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে প্রবাসীরা এই বন্ড থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া শুরু করেন।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রিজার্ভ যখন ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল তখন নীতিমালা কঠোর করা হয়, এখন রিজার্ভ বিপদসীমার কাছাকাছি চলে এসেছে। এই অবস্থায় রিজার্ভ বাড়াতে হলে নীতিমালা শিথিল করা জরুরি।’ তিনি বলেন, ‘১ কোটি টাকার বিনিয়োগ সীমা এখনই তুলে দেওয়া উচিত। সুদের হার আগের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া উচিত।’
এ প্রসঙ্গে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘রিজার্ভ কমে যাওয়ার পেছনে প্রধান কারণ ডলারের দাম বেঁধে রাখা। আর ছোট ছোট যেসব কারণে রিজার্ভ কমেছে— তার মধ্যে অন্যতম ওয়েজ আর্নার বন্ডে নেতিবাচক নীতি নেওয়া।’ তিনি উল্লেখ করেন, সুদের হার যদি না কমানো হতো, তাহলে কিছুটা হলেও রিজার্ভ বাড়তো।
প্রবাসীদের অনেকেই বলছেন, ২০২২ সালে সুদ হার অর্ধেক কমানোর কারণে ওয়েজ আর্নার বন্ড থেকে তারা শুধু মুখ ফিরিয়েই নেননি, ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। কারণ, তখন ব্যাংকের আমানতের সুদ হারও ছিল সর্বনিম্ন। ঠিক একই সময়ে হুন্ডি চক্রও সক্রিয় হয়ে ওঠে। ব্যাংকের চেয়ে হুন্ডিই বেশি টাকা দেওয়ায় অধিকাংশ প্রবাসী হুন্ডির পথ বেছে নেন। অনেকেই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বিভিন্ন দেশের পাচারকারীদের হাতে তুলে দেন। এতে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট দেখা দেয়, পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও চাপে পড়ে যায়।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৮ সালে ওয়েজ আর্নার বন্ড বিক্রি করে রিজার্ভে ২০০ মিলিয়ন ডলার জমা হয়। ২০২০ সালে এটি কমে ১৩৫ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। আর ২০২১ সালে আরও কমে ১০৭ মিলিয়ন ডলারে নামে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ওয়েজ-আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডের নিট বিক্রি কমেছে ৩৫ মিলিয়ন ডলার।
এদিকে নেতিবাচক নীতি গ্রহণের ফলে রিজার্ভ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন প্রবাসীরা। ২০১৯ সালে এই বন্ড বিক্রি করে রিজার্ভে জমা হয় ২৫ মিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে এটি কমে দাঁড়ায় ২২ মিলিয়ন ডলারে। ২০২১ সালে আরও কমে যায়। ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ডের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ২.১৬ মিলিয়ন ডলার।
উল্লেখ্য, ওয়েজ-আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডে এখন ৯ শতাংশ সুদ পাওয়া যায়, আগে সুদ পাওয়া যেত ১২ শতাংশ। ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ডে এখন ৩.৫ শতাংশ সুদ দেওয়া হয়, আগে সুদ দেওয়া হতো ৭.৫ শতাংশ। আর ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডে এখন ৩ শতাংশ সুদ পাওয়া যায়, আগে পাওয়া যেত ৬.৫ শতাংশ
বেড়েছে হুন্ডির আধিপত্য
জানা গেছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে গেছেন ৬ লাখ ১৮ হাজার শ্রমিক। আর গত বছর শ্রমিক গেছেন রেকর্ড পরিমাণ ১১ লাখ ৩৬ হাজার। শ্রমিক যাওয়া এভাবে বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই রেমিট্যান্স বাড়ার কথা। কিন্তু হুন্ডির কারণে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমে যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, হুন্ডিতে রেমিট্যান্স বেশি আসায় ওইসব ডলার চলে গেছে কার্ব মার্কেট বা খোলা বাজারে। এতে কার্ব মার্কেটে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। একইসঙ্গে চাহিদা ও দাম বেড়েছে। কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলারের দাম এখন ১২০ টাকা। যদিও ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের প্রতি ডলারের বিপরীতে প্রবাসীরা প্রণোদনাসহ সর্বোচ্চ ১১২ টাকা ১১৫ টাকা পাচ্ছেন।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে গত অর্থবছরে বাংলাদেশে ডলারের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক দামের ব্যবধান ছিল ১২ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত।
সময়োপযোগী ও যৌক্তিক উদ্যোগ ছিল না
দুই অঙ্কের মূল্যস্ফীতির সময়েও বাংলাদেশ ব্যাংক পারেনি এক অঙ্কের বেঁধে দেওয়া সুদের হার থেকে সরে আসতে। রিজার্ভ থেকে দেওয়া উন্নয়ন সহায়তা ঋণ ফেরাতে ব্যর্থ হয়েছে। দেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়নি রফতানি আয়ের একটা অংশ। দুই বছর ধরে বিদেশে আটকে আছে প্রায় শতকোটি ডলার। ডলারের রেট হুন্ডির সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক রাখা, ডিজিটাল ব্যাংকিং মাধ্যমে হুন্ডির প্রসারে, অনলাইন জুয়া ও ক্রিপ্টো ব্যবসার আড়ালে ডলার পাচার থামানোর কোনও সময়োপযোগী ও যৌক্তিক উদ্যোগ ছিল না নিয়ন্ত্রক সংস্থার।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘পুঁজি পাচার রোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাফল্য যথেষ্ট না হওয়াই রিজার্ভ কমে যাওয়ার প্রধান কারণ।’ তিনি বলেন, ‘রেমিট্যান্স এলাকায় মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন মনিটর করে আগে হুন্ডি নিয়ন্ত্রণে সাফল্য এসেছিল। কিন্তু এখন সেই তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বেশি দামে ডলার কেনাবেচা থেকে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়েছে, যার ফলে বাফেদা নির্ধারিত দাম কার্যকর হয়নি।’
রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি
বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের পক্ষে সরকারি ঋণের কিস্তি, সেবা মাশুল, ফি পরিশোধ করার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা ছাড়াও সরকারি বিভিন্ন আমদানির জন্য ব্যাংকগুলোকে ডলার দিচ্ছে। ব্যাংকগুলোতে ডলার সংকটের কারণে দুই বছরের বেশি সময় ধরে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের সাড়ে তিন মাসেই রিজার্ভ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করতে হয়েছে। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে রেকর্ড ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার বিক্রির পরিমাণ ছিল ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
আরও পড়ুন: