করোনাভাইরাসের ভয়াবহ সংক্রমণ রোধে সারাদেশে যখন চলছে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, তখন হঠাৎ পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকরা শনিবার (৪ এপ্রিল) ঢাকা ও এর আশপাশের জেলাগুলোতে চলে আসেন। এতে ব্যাপকভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা দেখা দেয়। শ্রমিকরা জানান, শনিবার তাদের ছুটি শেষ। চাকরি হারানোর ভয় এবং বকেয়া বেতনের জন্যই করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে দীর্ঘ পথ বহু কষ্টে পাড়ি দিয়ে তারা চলে এসেছেন। এদিকে, তারা আসার পর পুনরায় ছুটি ঘোষণা করা হলেও বেশ কিছু কারখানা এখনও খোলা রয়েছে।গণপরিবহন বন্ধ থাকায় তারা এখন ফিরে যেতেও পারছেন না। অন্যদিকে, ভাড়া বাসার মালিকরা সংক্রমণের আশঙ্কায় শ্রমিকদের থাকতে দিচ্ছেন না। বর্তমান পরিস্থিতিতে পোশাক শ্রমিকরা পড়েছেন নানামুখী সংকটে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিনিধিরা: সাভার
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রবিবার সকাল থেকে সাভারের উলাইল এলাকা, আশুলিয়া, জামগড়া, জিরাবো ও কাঠগড়া এলাকায় অনেক গার্মেন্টস কারখানা চালু রেখে উৎপাদন কাজ চলছে। কাজে যোগ দেওয়া পোশাক শ্রমিক আছমা, সুলতানা ও রফিকসহ অনেকে বলেন, ‘করোনা আতঙ্কে পরিবহন বন্ধ রয়েছে। কারখানা চালু থাকার কারণে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে রিকশা, ভ্যানে, পায়ে হেঁটে সবাই কাজে যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। করোনা ঝুঁকি মাথায় নিয়েই চাকরি বাঁচানোর জন্য কারখানায় যেতে হচ্ছে।’
আশুলিয়ার জামগড়া এলাকার গ্লোবাল সোয়েটার লিমিটেডের পরিচালক রেজাউল কবির রাসেল জানান, কারখানা বন্ধের জন্য কলকারখানা অধিদফতর বা সরকারিভাবে তাদের কোনও নিদের্শনা দেওয়া হয়নি। এ কারণে তারা কারখানা চালু রেখেছেন। তিনি দাবি করেন, শ্রমিকদের সুরক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েই তারা কারখানা খোলা রেখেছেন। প্রতিদিন কারখানায় প্রবেশের সময় শ্রমিকদের হাত ধোয়া ও মাস্কসহ প্রতিনিয়ত জীবাণুনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। এছাড়াও তাদের কারখানা চালু থাকার কারণে এসব শ্রমিক অন্য কোথাও যেতে পারেনি। তাই করোনা বিস্তার রোধ হচ্ছে।
ধামরাইয়ের স্নুটেক্স কারখানার সহকারী ব্যবস্থাপক ও পাবলিক রিলেশন অফিসার রাহাত জানান, বিজিএমএইএ’র নির্দেশনা অনুযায়ী রবিবার কারখানা চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শনিবার রাতে হঠাৎ করেই বিজিএমইএ থেকে ১১ তারিখ পর্যন্ত বন্ধ রাখার কথা জানানোর পর তারা আবারও বন্ধ ঘোষণা করেছেন।
বাংলাদেশ বস্ত্র ও পোশাক শিল্প শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘বর্তমান সময়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সরকারও সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এমনকি পোশাক কারখানার জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। এরপর শ্রমিকদের অনেক মালিক বলে দিয়েছেন কারখানায় না আসলে চাকরি থাকবে না। শুধু অবহেলার জন্য রানা প্লাজা ও তাজরীনে বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। আবারও কারখানায় করোনা ঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকরা কাজ করার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। এতে হুমকির মধ্যে পড়ে যেতে পারে পুরো বাংলাদেশ। মালিকরা কখনোই শ্রমিকদের কথা ভাবেন না। তারা নিজেরা ঘরে বসে থেকে শ্রমিকদের রাস্তায় নামিয়ে দিচ্ছেন স্বার্থের জন্য। শ্রমিকরাও যে মানুষ তারা সেটি কখনও চিন্তা করেন না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বিজিএমইএ’র সমন্বয়হীনতার কারণে আজ এই অবস্থা। এছাড়াও করোনা শুরুর পর থেকেই অনেক ছোট কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে। ওইসব কারখানার শ্রমিকরা বেতন পাননি। তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।’ তিনি সরকারিভাবে কারখানা বন্ধের নির্দেশ দেওয়ার অনুরোধ জানান।
নারায়ণগঞ্জ
নারায়ণগঞ্জের বিসিক শিল্পনগরীসহ জেলার বিভিন্ন জায়গায় গার্মেন্টস কারাখানায় কাজে যোগ দিতে দলবেঁধে হাজার হাজার শ্রমিক জড়ো হয়েছেন। এদিকে গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিকেএমএই ও বিজিএমইএ শনিবার (৪ এপ্রিল) রাতে নোটিশ দিয়ে আগামী ১১ এপ্রিল পর্যন্ত গার্মেন্টস বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। কিন্তু সেই নোটিশের তোয়াক্কা না করে অনেক কারখানা খোলা রেখেছেন মালিকরা। শ্রমিকরাও কাজেও যোগ দিয়েছেন।
ছুটি বাড়ানোর ঘোষণা না দেওয়ায় কর্মস্থলে যোগ দিতে করোনার ঝুঁকি মাথায় নিয়েই পায়ে হেঁটে, রিকশা-ভ্যান ও পণ্যবাহী ট্রাকে চড়ে শ্রমিকরা নারায়ণগঞ্জ চলে আসেন। সরেজমিন ফতুল্লার বিসিক শিল্পনগরী ঘুরে দেখা যায়, রবিবার কাজে যোগ দিতে কয়েক হাজার শ্রমিক বিসিকে গিয়ে দেখেন ২৫ থেকে ৩০টি গার্মেন্টস খোলা রয়েছে। বাকিগুলো বন্ধ। এমন সমন্বয়হীনতায় তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
শ্রমিকরা জানিয়েছেন, কারখানা বন্ধ করার আগে মালিকরা তাদের বেতন দেননি। পূর্বঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রবিবার গার্মেন্টস খোলা থাকায় তারা কাজে যোগ দিতে এসেছেন। শ্রমিক পারভেজ অভিযোগ করেন, ‘আমাদের মার্চ মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। কবে বেতন দেওয়া হবে তা জানানো হয়নি। এখন যে আবার বাড়ি ফিরে যাবো সেই ভাড়া নেই। তাই আমাদের বেতন খুব প্রয়োজন। ভাড়ি ভাড়া, দোকান বাকি পরিশোধ করতে হবে।’ শ্রমিকরা জানান, পেটের দায়ে করোনার ঝুঁকি নিয়েই তারা কাজে এসেছেন।
এ ব্যাপারে বিকেএমই্এ'র সাবেক সহ-সভাপতি ও মডেল ডি ক্যাপিটাল গার্মেন্টস কারখানার মালিক মাসুদুজ্জামান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সরকার ও মালিকদের সংগঠনের সমন্বয়হীনতার কারণে এই হ-য-ব-র-ল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। গার্মেন্টস বন্ধ বা খোলার বিষয়টি এক জায়গা থেকে নির্ধারণ হওয়া উচিত ছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা স্ব-স্ব অ্যাসোসিয়েশন আলোচনা করে যদি বিষয়টি নির্ধারণ করতো তবে আজ এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না। গার্মেন্টস ছুটি দিয়ে আমরা হোম কোয়ারেন্টিনে গিয়েছিলাম। কিন্তু শ্রমিকরা চলে আসায় মালিক হিসেবে আমি বাধ্য হয়েছি ফ্যাক্টরিতে আসতে।’
এ ব্যাপারে বিকেএমইএ সভাপতি একেএম সেলিম ওসমান জানান, ‘মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে বিকেএমইএ সদস্যভুক্ত সব নিট পোশাক কারখানা আগামী ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ রাখার বিশেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। বিষয়টি রাতেই নোটিশ দিয়ে গার্মেন্টস মালিকদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
গাজীপুর
গণপরিবহন বন্ধ থাকায় অনেক কষ্টে ও ঝুঁকি নিয়ে শনিবার (৪ এপ্রিল) গাজীপুরে পোশাক শ্রমিকরা কর্মস্থলে ফেরেন। নির্ঘুম রাত শেষে রবিবার (৫ এপ্রিল) সকালে কাজেও যোগ দেন। কিন্তু কারখানা খুলে দেওয়ার প্রায় ৪ ঘণ্টার মধ্যেই নোটিশ দিয়ে অধিকাংশ কারখানা আবার বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে রফতানি অর্ডার রয়েছে এবং পিপিই তৈরি করার অজুহাতে কয়েকটি কারখানা এখনও চালু রয়েছে। এদিকে শ্রমিকরা পড়েছেন আরেক সমস্যায়। তারা বলছেন, করোনার ভয়ে তাদের ভাড়া বাসার মালিকরা এ মুহূর্তে থাকতে দিচ্ছেন না। অপরদিকে, মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় তারা বাড়িতেও যেতে পারছেন না।
২৬ মার্চ থেকে ১০ দিন বন্ধ থাকার পর যেসব শ্রমিক বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন তার প্রায় ৮০ ভাগ শ্রমিক শুক্রবার ও শনিবার চলে এসেছেন গাজীপুর এবং আশপাশের এলাকায়।
শ্রীপুরের বহেরার চালা এলাকার বাড়ির মালিক এবং স্থানীয় ওয়ার্ড কমিউনিটি পুলিশের সাধারণ সম্পাদক আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বাড়িতে ১০ জন শ্রমিক পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন। কারখানা খোলা থাকায় তারা গতকাল রাতে বাসায় এসেছে। এখন কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেওয়ায় তাদের বাড়ি চলে যেতে হবে। করোনা আক্রান্তের ভয়ে তাদের আমরা বাড়িতে রাখতে চাচ্ছি না।’
গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার বেড়াইদেরচালা গ্রামের পলমল গ্রুপের আসওয়াদ কম্পোজিট মিলের কোয়ালিটি অপারেটর আব্দুল মজিদ। তার বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার টেগরী গ্রামে। রবিবার দুপুরে বাড়ি যাওয়ার পথে ওই কারখানার সামনেই সাংবাদিকের কাছে তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলছিলেন, ‘সরকার করোনাভাইরাস রোধ করার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নিলেও পোশাক কারখানার মালিকরা করোনাকে ডেকে নিয়ে আসছেন। মালিক ঘরে বসে বাঁচতে পারবে, আমরা শ্রমিকেরা ঘরে বসে থাকলে মালিকরা বেতন দেবে না। মালিকদের কথামতো অফিসে না এলে চাকরি চলে যেতে পারে। বেতনও হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তাই জীবন হাতে নিয়ে ছুটে আসার একটাই কারণ। ’
গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার বহেরারচালা (গিলাবেড়াইদ) গ্রামের নান্তাবুর গ্রুপের তাকওয়া গার্মেন্টস খোলা রয়েছে। দুপুরে লাঞ্চ বিরতির সময় ওই কারখানার সামনে গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বললে তারা কারখানা মালিকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শ্রমিকরা বলেন, ‘আমরা অনেক কষ্ট করে গতকাল এসেছি। আমাদের মালিক জোর করে কারখানায় কাজ করাচ্ছে। করোনা মোকাবিলায় কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে কাজ করানোয় আমরাও ভয়ে আছি। চাকরি যাওয়ার ভয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। ’
এ বিষয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে দায়িত্বপ্রাপ্ত সিকিউরিটি সুপারভাইজার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বাইরের কোনও লোকের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে কথা বলা নিষেধ রয়েছে।’ এ সময় কর্তৃপক্ষের কারও ফোন নম্বর দেওয়াও নিষেধ আছে বলে তিনি জানান।
মাস্টারবাড়ী নতুন বাজার এলাকার এস এস নিট ওয়্যার লিমিটেডের সুপারভাইজার শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার লংগারপাড়া গ্রামের শাহ আলম বলেন, ‘সরকার বা গার্মেন্টস মালিক সমিতি যদি একদিন আগেও আমাদের বন্ধের কথা জানাতো তাহলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকগুণ ভাড়া দিয়ে আমাদের গ্রাম থেকে আসতে হতো না। যে কয় টাকা বেতন পাবো তা শুধু আসা-যাওয়া, বাড়ি ভাড়া ও দোকান বাকির টাকা দিলেই শেষ হয়ে যাবে।’
কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার বানিরকান্দা গ্রামের মেহেদী হাসান বলেন, ‘করোনাভাইরাসের এ মুহূর্তে বিপজ্জনক খেলায় আমরা গরিব শ্রমিকেরা মাঠের খেলোয়াড়। আমাদের মাঠে ছেড়ে দিয়ে সরকার ও মালিকেরা বড় বড় ভবনে বসে খেলা দেখে। আমরা বাঁচলে কী, মরলে কী? তাতে কার কী আসে-যায়?’
বাগেরহাট সদর উপজেলার বাদখালি গ্রামের আল-আমির হোসেন। সহকারী অপারেটর (হেলপার) হিসেবে চাকরি করেন শ্রীপুরের তাকওয়া পোশাক কারখানায়। তিনি বলেন, ‘করোনার ভয়ে ভাড়া বাসায় মালিক থাকতে দিচ্ছে না। অনেক অনুরোধ করে রাতটা পার করছি। এদিকে, সড়কে কোনও যানবাহনও চলাচল করে না। যে কয়টা যানবাহন চলাচল করছে সেগুলো পুলিশ আটকিয়ে মাঝপথে যাত্রীদের নামিয়ে দিচ্ছে। এ মুহূর্তে কোথায় যে যাই ভেবে পাচ্ছি না।’