X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

দ্বিজেন শর্মা ও উন্নয়ন বিবেচনা...

শুভ কিবরিয়া
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:০২আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:০৪

শুভ কিবরিয়া দ্বিজেন শর্মা (১৯২৯-২০১৭) যেদিন চলে যাচ্ছেন এই মাটি-আকাশ-আর পৃথিবী ছেড়ে না ফেরার দেশে, সেদিন এই শহরে অন্তত একটি পুরনো গাছকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়েছে একদল ভূমিপুত্র। গাছটি বেড়ে উঠেছে অত্যন্ত অবহেলা ও অনাদরে। কিন্তু একদল মানুষ ভালোবেসে ফেলেছে এই গাছটিকেই। এটি একটি অশ্বথ বা বট জাতীয় গাছ। চারপাশ জুড়ে ঝুরি মেলেছে। একটা বড় এলাকা জুড়ে তৈরি করেছে ছায়াময় পরিবেশ। ঘনসবুজ পাতা মেলে ধরেছে বিস্তর । তৈরি হয়েছে সুনীল ছায়ার সঙ্গে এক প্রাকৃতিক মায়াও। এখানে শ্রমিক, রিক্সাওয়ালা, অফিস ফেরত একদল শ্রমজীবী মানুষ জিরিয়ে নেন দুদণ্ড। প্রখর রোদ-তাপে একদল সারমেয় নিত্য আশ্রয় নেয় এই সুনিবিড় ছায়াতলেই। তেজগাঁও এলাকার নাবিস্ক মোড়সংলগ্ন পুরনো একটি বিল্ডিংয়ের দেয়াল ঘেষেই বেড়ে ওঠা এই সবুজ বৃক্ষটির। গণসাহায্য সংস্থা নামের একসময়ের প্রভাবশালী এক এনজিও যার অবস্থা এখন জুবুথুবু, সেই এনজিওর হেড অফিস এই বিল্ডিংটি। তারই দেয়ালে কিছুটা লজ্জা, কিছুটা দ্বিধা নিয়ে একধরনের অবাঞ্চিতের মতো অশ্বথ জাতীয় বৃক্ষটির বেঁচে থাকা। এই বৃক্ষের ছায়াতলে রয়েছে একটি টি স্টল। টি স্টল আর বৃক্ষটি সমার্থক হয়ে আছে অনেক বছর ধরে। বহু মানুষের সমাগম ঘটে চা পান আর ধুমপানের নেশায় অদ্ভুত সবুজ পাতা নিয়ে, ছায়া দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই মায়াময় বৃক্ষতলে।

হালে সেখানে ড্রেন পুননির্মাণ চলছে জোরেসোরে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে। ড্রেন তৈরি হচ্ছে বড় পরিসরে। বাড়ছে ফুটপাত। এই উন্নয়নকাজের বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে বৃক্ষটি। মহাখালি বাসস্ট্যান্ড থেকে সাতরাস্তা যেতে সড়কের ডান পাশে থাকা ড্রেন পুননির্মাণ করতে গিয়ে বহু গাছ উপড়ে ফেলতে হয়েছে। ড্রেন বড় করতে হচ্ছে বলে এইসব সবুজ গাছ কেটে ফেলছে এই নির্মাণকাজে থাকা কনট্রাক্টর। এই সবুজ গাছগুলোকে কোনোভাবে বাঁচিয়ে রেখে ড্রেনটির বর্ধনকাজ করা যেতো কিনা সেই চেষ্টা চোখে পড়েনি।

আমাদের এখানে গাছ বাঁচিয়ে রেখে কখনোই এসব ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করা হয় না। সবসময় চেষ্টা থাকে বৃক্ষ নিধনের। প্রয়োজনে আবার নতুন করে বৃক্ষ লাগানো যাবে এই চিন্তাও কাজ করে অনেক সময় এইসব কাজের পরিকল্পকদের। কিন্তু পুরনো গাছ বাঁচিয়ে উন্নয়নকাজ চালিয়ে নেওয়ার যে চিন্তা আধুনিক নগরবিদ বা নগর পরিকল্পক, স্থপতি, প্রকৌশলীরা করেন সারা দুনিয়া জুড়ে, এক অজানা কারণে বাংলাদেশে সেই চেষ্টা আজও পরিত্যাজ্য। প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখে, প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে উন্নয়নকাজের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা ঠিক কী কারণে আমাদের পরিকল্পকদের,  তা আজও বুঝতে পারি না। তবে ইদানিং লক্ষ্য করেছি, এইসব বৃক্ষ নিধনে পরিকল্পকরা অনেকেই ‘নিরাপত্তা ঝুঁকির’ কথা তোলেন। আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হচ্ছে, মিরপুর শেরে-বাংলা স্টেডিয়ামে যখন আন্তর্জাতিক কোনও ক্রিকেট আসর বসে, কোনও বিদেশি দলের খেলার কথা থাকে কিংবা দেশি-বিদেশি কোনও ভিআইপির ওই মাঠে উপস্থিত থাকার প্রসঙ্গ ওঠে তখন ‘নিরাপত্তা ইস্যুর’ কথা বলে স্টেডিয়াম সংলগ্ন সড়কের কোনও গাছকেই আর বাঁচিয়ে রাখা হয় না। গাছ বাঁচাতে স্থানীয় পরিবেশপ্রেমী-প্রকৃতিপ্রেমীদের হাজার আবেদন-নিবেদনও জলে যায় নিরাপত্তার ইস্যুর তোড়ে। মহাখালি- সাতরাস্তা সড়কের দুপাশের গাছগুলো এই বিবেচনায় কাটা পড়লো কিনা তা অবশ্য জানা যায় নাই।

দুই.

উন্নয়নের নামেই হোক বা নিরাপত্তার ঝুঁকি রোধ করার জন্যই হোক- বৃক্ষ কর্তনের একটা উপলক্ষ্য পেলে আমাদের কর্তারা দু’হাত উজাড় করে তাদের কর্তব্য পালন করেন। সেই কর্তব্য পালনের জেরেই হয়তো মহাখালির নাবিস্ক মোড়ের গণসাহায্য সংস্থার প্রধান অফিসের গা ঘেঁষে থাকা অশ্বথ কিংবা বট জাতীয় গাছটির প্রতি চড়াও হয়েছেন কর্তাব্যক্তিরা! নীতি নির্ধারক নকশাবিদরা এমনভাবেই বর্ধিত ড্রেনের ডিজাইন করেছেন যে গাছটির অস্তিত্ব বিপন্ন করা ছাড়া এই উন্নয়ন কাজের সমাপন প্রায় অসম্ভব। কিন্তু দেখলাম সেখানে ঘটছে বিপরীত ঘটনা। যে ভূমিপুত্ররা এই ড্রেন নির্মাণ কাজের শ্রমিক,  ওই বটচ্ছায়া যাদের নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটায় সেই স্থানীয় রিক্সাওয়ালা-সিএনজি চালক, টি স্টলের নিয়মিত খদ্দের-বিক্রেতা সবাই মিলে কোনোরকমে গাছটিকে বাঁচানো যায় কিনা তার চেষ্টা করছের প্রাণপণে। ইতোমধ্যে গাছটির শেকড়ের অনেকটাই কাটা গেছে। শেকড় সংলগ্ন মাটি উপড়ে ফেলা হয়েছে নিচের দিকে। ওপরের দিকে গাছের বেশ কিছু ডাল, ঝুরি কাটা গেছে। ছাটা গেছে মাথা ও পায়ের বহু অংশ। তবুও সবাই মিলে চেষ্টা চালাচ্ছে গাছটির অস্তিত্ব রক্ষার।

জানি না খণ্ডিত অংশ নিয়ে, দেহে-মাথায় অজস্র আঘাত সয়ে এই পুরনো গাছটি শেষাবধি বাঁচবে কিনা?

যে দেশে দীর্ঘবয়সী ছায়াময় বৃক্ষের চাইতে অপরিকল্পিত নবীন ড্রেনের মূল্য বেশি সেই দেশে এইরকম গাছের বেঁচে থাকা আদৌ উচিত কিনা– সেই প্রশ্নও জেগেছে ।

তিন.

এই ঘটনা কতগুলো ভাবনা বা প্রশ্নের উদ্রেক করে।

১. আমরা যাকে উন্নয়ন বলছি সেই চিন্তায় আদৌ প্রকৃত জনকল্যাণ নিহিত আছে কিনা? আবার উন্নয়ন কার হাতে হচ্ছে সেটাও একটা প্রশ্ন। জনগণের কাছে জবাবদিহি করে এরকম শাসক আর স্বৈরশাসক বা কর্তৃত্বমূলক শাসকের হাতের উন্নয়ন এক কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন। জবাবদিহিতাহীন উন্নয়ন কি আদৌ টেকসই উন্নয়ন?

২. উন্নয়ন বিশেষত ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন করতে গেলেই আপামর বৃক্ষ নিধন হবে, বস্তিবাসী উচ্ছেদ হবে, কখনও কখনও বসতবাটি জমি-জিরাতও উচ্ছেদ হবে। এখন এই কাজে আমরা যাবো কিনা? নাকি উন্নয়ন ও উচ্ছেদের মধ্যে একটা সমন্বয় সাধন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে? যার জন্য উন্নয়ন, যাদের জন্য উন্নয়ন তাদের কথা শাসকশ্রেণি বা তাদের প্রতিনিধি নীতিনির্ধারকরা শুনবে কিনা?

৩. উন্নয়ন নিয়ে বড় যে প্রশ্ন ওঠার কথা তা অর্থনীতির প্রশ্ন। এই যে উন্নয়ন উন্নয়ন বলে হাঁক-ডাক ফেলে আমরা বৃক্ষ নিধন করছি, প্রাকৃতিক পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছি, সেই উন্নয়নের ফসল কার ঘরে যাচ্ছে?

অনেক মানুষ কি এর সুফল পাচ্ছে?

 নাকি গুটিকতককে সুবিধে দেওয়ার জন্য আমরা অনেক মানুষকে দুঃখ-কষ্টের মধ্যে ফেলছি।

আমাদের এইসব কথিত উন্নয়ন আসলে বৈষম্য বাড়াচ্ছে না কমাচ্ছে?

চার.

এইসব ভাবনার উত্তর সবসময় মেলে না। তবে কখনও কখনও কিছু পরিসংখ্যান আমাদের কর্মকাণ্ডের ফলাফল সম্পর্কে ইঙ্গিত দেয় বটে। অর্থনীতির এরকম একটা বড় পরিসংখ্যানভিত্তিক ইন্ডিকেটর হচ্ছে গিনিসহগ। গিনিসহগ সমাজের বৈষম্য নির্ধারণ করে। এর মান শূন্য (০) থেকে এক (০১) এর মধ্যে। এই সূচকের মধ্যে দিয়ে দেশের আয় বা বন্টনের অসমতা বোঝানো হয়। কোনও সমাজে গিনিসহগ যদি শূন্য (০) হয় তাহলে বুঝতে হবে সমাজে কোনও সম্পদবৈষম্য নেই। আর গিনিসহগ এক (০১) হলে বুঝতে হবে একজনই সব সম্পদের মালিক। উন্নয়নের ফসল একজনের ঘরেই গেছে সবাইকে নিঃস্ব করে।

অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন যিনি একসময় বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ছিলেন, ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, হালে তিনি এক বক্তৃতায় এই গিনিসহগ নিয়ে কথা বলেছেন। তার বরাতেই জানা গেলো বঙ্গবন্ধুর আমলে বাংলাদেশে গিনিসহগ ছিল ০.৩৪ শতাংশ। এখন এটা ০.৪৫ শতাংশ। তার অভিমত হচ্ছে এটা ০.৪ শতাংশে নামিয়ে আনা উচিত। মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন– ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক জনকল্যাণে রূপান্তর-কোন পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামের দশম মিসবাহউদ্দিন স্মারক বক্তৃতায় আরও একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য আমাদের সামনে হাজির করেছেন। তিনি বলেছেন, পাকিস্তানের আমলে দেশে কোটিপতি ছিল ২২ পরিবার। আমরা সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। আর এখন স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫ হাজার লোক কোটিপতির খাতায় নাম লেখায়। কাজেই একটা বৈষম্যের ব্যাপার আছে।

পাঁচ.

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের এই তথ্যকে বিবেচনায় নিলে আমাদের সতর্ক হবার প্রয়োজন আছে। বৃক্ষ -প্রকৃতি সব কিছুকে  নিধন করে যেনোতেন উন্নয়ন বিষয়ে পুনর্বার ভাবনার প্রয়োজন আছে। আছে প্রয়াত দ্বিজেন শর্মা’র প্রকৃতি ও নিসর্গকে বাঁচিয়ে রাখার নিরন্তর এবং প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার কাজটাকেও বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখা।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাজধানীকে সুন্দর করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি: আইইবি
রাজধানীকে সুন্দর করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি: আইইবি
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ