X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বায়নের দুর্দিন দ্রুত এগিয়ে আসছে

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
২৬ এপ্রিল ২০১৮, ১৩:৫৬আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০১৮, ১৩:৫৯

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী গত শতাব্দীতে পুঁজিবাদ প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান থেকে একচেটিয়া পুঁজিবাদে পরিণত হয়। একচেটিয়া পুঁজির মুনাফার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে তৃতীয় বিশ্বসহ বিশ্বের বাজারগুলোকে একচেটিয়া পুঁজির বিচরণের জন্য উন্মুক্ত করে ফেলা, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া বাণিজ্যের পথে সব বাধা অপসারিত করা। এর নাম দেওয়া হলো বিশ্বায়ন। অনেকে বলে খোলাবাজার অর্থনীতি।
এ অর্থনীতিই বর্তমান বিশ্বে চালু রয়েছে। এ ব্যবস্থা বিশ্বকে ধীরে ধীরে একটা কঠিন বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ, সম্পদ একচেটিয়া পুঞ্জিভূত হচ্ছে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের হাতে। বাংলাদেশও খোলাবাজার অর্থনীতির পথ অনুসরণ করে চলছে। বাংলাদেশেও একচেটিয়া কিছু মানুষের হাতে পুঁজি পুঞ্জিভূত হচ্ছে। এ ব্যবস্থাটা মানুষকে, সমাজকে, রাষ্ট্রকে অস্থির করে তুলেছে। সর্বত্র অর্থের প্রতি লোপুপ দৃষ্টি।
আমরা একসময় ইউরোপকে সমীহ করেছি তাদের সাধুতা, সত্যবাদিতা আর মানবীয় গুণাবলির জন্য। অথচ সেই ইউরোপেই নাকি দুর্নীতি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দুর্নীতির কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ১২ হাজার কোটি ইউরোরও বেশি মূল্যের ক্ষতি হয়েছে। দুর্নীতি ব্যাপক মাত্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। যে গণতান্ত্রিক পথ ও পন্থার জন্য ইউরোপকে মানুষ শ্রদ্ধা করতো, অচিরেই সে গণতন্ত্রকে এই দুর্নীতি কলুষিত করে ফেলবে।

অস্থিরতা ও দুর্নীতিই কেবল আজকের সমস্যা নয়। অন্যান্য ক্ষেত্রেও সমস্যা মাথাচাড়া দিয়েছে এবং এ ব্যবস্থার জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে। এ বাস্তবতাটা ফুটে উঠেছে বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার মোড়লদের নিজের তৈরি ব্যবস্থাপত্রে।

সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে প্রতিবছর পুঁজিবাদী জগতের কর্মকর্তাদের সম্মেলন হয় এবং এ সম্মেলনেই পুঁজিবাদের প্রতি ঝুঁকি আর তার সমাধান নিয়ে আলোচনা হয়। ঝুঁকি সম্পর্কে তারা সবসময় সজাগ থাকে, না হয় বিপদে পড়ার আশঙ্কা থাকে। আর এ বিশ্ব ব্যবস্থাটা কোনও কঠিন বিপদে পড়লে ব্যবস্থাটা বিপন্ন হতে পারে। তাদের এ প্রতিবেদন থেকে এ বিশ্ব ব্যবস্থার ঝুঁকি সম্পর্কে যে আলোচনা থাকে তা থেকে আমরা প্রতিবছরই এ ব্যবস্থার দুর্বলতা সবলতা সম্পর্কে অবহিত হই।

এ সম্মেলনে কয়েক হাজার নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানেরা যোগদান করে থাকেন। ডাভোসে অনুষ্ঠিত বার্ষিক ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম সংক্ষেপে ডব্লিউইএফ মিলিত হয়ে বিশ্বায়নের আগামী দিনের সংকট কী হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হয় এবং সে সম্পর্কে একটা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়, যাকে তারা গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্ট (জিআরআর) বলে নামকরণ করেছেন। এ সম্মেলনে যারা উপস্থিত থাকে তাদের নাম উল্লেখ করলে বুঝা যাবে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিকস ফোরাম কার স্বার্থরক্ষায় তৎপর বা বিশ্বায়নের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় কী?

পেপসিকো, আরসেলো মিতাল, গুগল, ব্যাংক অব আমেরিকা, মাইক্রোসফট, বিপি, সিটি ব্যাংক, ডয়েশ ব্যাংক, এইচএসবিসি, বক্সওয়াগন, ইউবিএস, ইউনিলিভার, টোটাল, ইয়াহু, নভারটিস, নাইজেরিয়ার ডানগোটেসহ বিশ্বের কয়েকশ শীর্ষস্থানীয় কোম্পানির প্রধানগণ, বিশ্বব্যাংক। ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, রকফেলার  ফাউন্ডেশন, সুইস কনফেডারেশনসহ বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা, বাণিজ্য লগ্নি প্রতিষ্ঠান, বণিক ও শিল্পপতিদের সংগঠন, সমিতি ইত্যাদির প্রধান, আর বহু দেশের সরকার প্রধানেরা।

এবার ভাডোস সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা হয়েছে নবীন মোদি ও মেহুল চোকসির সঙ্গে আর এই দুই হিরক ব্যবসায়ী ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের ১১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে ভারত থেকে পালিয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন দেশের মাফিয়াবাজেরাও এ সম্মেলনে যোগদান করেন। এ নিয়ে ভারতে মোদির বহু সমালোচনা হয়েছে।

হেমিলটন আমেরিকার স্থপতিদের একজন, রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তিনি অর্থ দফতরের দায়িত্বে ছিলেন। হেমিল্টন পুঁজিপতিদের জন্য সরকার এ বিশ্বাসটাকে সাধারণ মানুষের স্তরে পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন। এ জন্য দেখা যায় পুঁজিবাদ আমেরিকায় দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। আমেরিকার একচেটিয়া পুঁজিবাদই আসলে এ বিশ্বায়ন বা খোলাবাজার অর্থ ব্যবস্থার প্রবর্তক। এ বিশ্বায়ন ব্যবস্থাটা এখন ধনবৈষম্য সৃষ্টি করেছে প্রকটভাবে। গত ডাভোস সম্মেলনে বিশ্বে এ ধনবৈষম্যের কারণে বিরাট এক ঝুঁকি সৃষ্টির সম্ভাবনার কথা বলেছে।

ডাভোস সম্মেলনে সাহায্য সংস্থা অক্সফাম তার প্রতিবদনে বলেছে, বিশ্বের ৮৫ জন ব্যক্তির হাতে যে সম্পদ পুঞ্জিভূত হয়েছে তা পৃথিবীর জনসংখ্যার অর্ধেকের হাতে থাকা মোট সম্পদের সমান। বিশ্বের জনসংখ্যার ধনী ১ শতাংশের হাতে রয়েছে ১১০ লাখ কোটি ডলারের সম্পদ। এই সম্পদ হচ্ছে পৃথিবীর নিম্নস্তরে থাকা অর্ধেক মানুষগুলোর সম্পদের চেয়ে ৬৫ গুণ বেশি। অক্সফাম ধনবৈষম্যকে মানব জাতির সুসম অগ্রগতির পথে প্রধান অন্তরায় হিসাবে দেখিয়েছে।

ডাভোসের সম্মেলনে আরও একটা বিষয় উঠে এসেছে, তা হচ্ছে মানুষ নগরমুখী হয়ে যাচ্ছে আর এখন বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেকের চেয়েও বেশি লোক বাস করে নগরে আর এর এক-তৃতীয়াংশ লোক বাস করে বস্তিতে। মানুষ নগরমুখী হওয়ায় গ্রামের কৃষির আবাদ কমে যাচ্ছে। ইউরোপের বহু দেশে অনাবাদি জমির পরিমাণ বেড়ে গেছে। এতে খাদ্য সংকটের হুমকিও বাড়ছে।

ইতিহাস দেখলে দেখা যায়, পুঁজিবাদী বিশ্বে ১৮২৬, ১৮৩৭, ১৮৪৭, ১৯১৯, ১৯৩০ সালে সংকট এসেছে। কিন্তু কখনও সংকট বর্তমান বিশ্ব সংকটের মতো এতো ব্যাপক ছিল না। পুঁজিবাদী বিশ্বের কোনও প্রতিপক্ষ নেই বর্তমান বিশ্বে। সব সংকট তৈরি হচ্ছে এ ব্যবস্থার মধ্যে এ ব্যবস্থার দ্বারা। বিশ্বায়ন বিশ্বকে যেমন এক করে ফেলেছে, সংকটও সৃষ্টি হয়েছে সারা বিশ্বকে একসঙ্গে সংকটাপন্ন করে। মহা উল্লাসে যারা অগ্র পশ্চাৎ বিবেচনা না করে বিশ্বায়ন বিশ্বায়ন বলে চিৎকার তুলেছিল আর বাজার বাজার বলে বুক তাপড়িয়েছিল, তাদের অসহায়ত্ব দেখতে মনে হয় আর বেশি সময়ক্ষেপণ করতে হবে না। দরিদ্র মানুষ বিশ্বের চতুর্দিকে সজাগ হয়ে উঠছে। তারাই এ ব্যবস্থাটাকে ধ্বংস করে দেবে। কারণ, এ ব্যবস্থাটা তাদেরকে বুভুক্ষ বানিয়েছে।

একবার ডাভোস সম্মেলনে পোপ ফ্রান্সিস এক বাণী দিয়েছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে কল্যাণমূলক কিছু একটা করার মানসিকতার চেয়ে অনেক বেশি কিছু করতে হবে। সত্যই তাই। একচেটিয়া পুঁজিবাদ যেভাবে বিশ্বকে জর্জরিত করে ফেলেছে, এখন পুঁজিবাদীদেরকেই আত্মসচেতন হয়ে আমূল সংস্কারের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। ভিক্ষা দেওয়ার মানসিকতা দিয়ে কিছু করতে চাইলে তা পরিহাসে পরিণত হবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মুসলিমদের একাত্মতা ফিলিস্তিন সংকটের সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
মুসলিমদের একাত্মতা ফিলিস্তিন সংকটের সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বৃষ্টির অপেক্ষায় নার্সারি ও গাছপ্রেমীরা
বৃষ্টির অপেক্ষায় নার্সারি ও গাছপ্রেমীরা
নিজ্জর হত্যার অভিযোগে কানাডায় তিন ভারতীয় গ্রেফতার
নিজ্জর হত্যার অভিযোগে কানাডায় তিন ভারতীয় গ্রেফতার
পিকআপের পেছনে ট্রাকের ধাক্কা, উল্টে গিয়ে ২ শ্রমিক নিহত
পিকআপের পেছনে ট্রাকের ধাক্কা, উল্টে গিয়ে ২ শ্রমিক নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ