X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঘুমাস নে মা...

হারুন উর রশীদ
০৯ এপ্রিল ২০১৯, ১৭:৪৮আপডেট : ০৯ এপ্রিল ২০১৯, ২০:০২

হারুন উর রশীদ জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রীর বাবা রবিবার সকালে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে তার মেয়েকে দেখতে যান। আশি ভাগেরও বেশি পুড়ে যাওয়া মেয়েকে দেখে অজানা এক আশঙ্কায় বাবা বলেন, ‘ঘুমাস নে মা, চোখ খোলা রাখ।’
ওই ছাত্রীর জন্য এখন সবার একটিই প্রার্থনা, সে যেন ঘুমিয়ে না পড়ে। জেগে থাকে। জেগে থাকে জীবনে। জেগে থাকে প্রতিবাদে। জেগে থাকে অপরাধী আর দুর্বৃত্তের মুখোশ উন্মোচনে। তার বাবার প্রার্থনা, তার বাবার প্রাণপণ চাওয়া যেন সত্যি হয়। সে যেন আবার জীবনের জয়গান গাইতে পারে। বলতে পারে, ‘বাবা আমি জেগে আছি, ঘুমাইনি’।
এরই মধ্যে আমরা জানি সিঙ্গাপুরে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা হলেও তার শারীরিক অবস্থা এখনও সেখানে নেওয়ার মতো নয়। আমরা প্রার্থনা করি তার শারীরিক অবস্থার যেন উন্নতি হয়।

তবে শুধু প্রার্থনা নয় আমাদের আত্মবিশ্লেষণও করতে হবে। বুঝতে হবে ওই ছাত্রী কেন আজ জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। আমরা কি শুধু মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এবং তার সহযোগীদের শাস্তি দিতে পারলেই দায় এড়াতে পারবো? এটা কি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা? এর জন্য আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার কি কোনও দায় নেই?

নেপথ্যে কী?

মাদ্রাসাছাত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টার আগের পরের কিছু ঘটনা তুলে ধরছি–

১. ছাত্রীটি আগে ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে। আর অভিযোগ ওই মাদ্রাসারই অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দোলার বিরুদ্ধে।

২. ঘটনা ঘটেছিল ২৭ মার্চ অধ্যক্ষের কক্ষেই।

৩. ধর্ষণচেষ্টার মামলায় ওই অধ্যক্ষ গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে আছেন।

৪. অধ্যক্ষ গ্রেফতার হওয়ার পর পক্ষে-বিপক্ষে দু’টি গ্রুপ হয়। এক গ্রুপ অধ্যক্ষের পক্ষে। আরেক গ্রুপ তার বিপক্ষে। মানববন্ধন ও পাল্টা মানববন্ধন হয়।

৫. ছাত্রীটি তার নিরাপত্তাহীনতার কথা বারবার পুলিশকে জানিয়েছে।

৬. মামলা তুলে নেওয়ার জন্য তার পরিবারের সদস্যদেরও হুমকি দেওয়া হয়েছে।

অধ্যক্ষ জামায়াত করতেন। সোনাগাজী উপজেলা জামায়াতের আমির ছিলেন। তার বিরুদ্ধে আগেও অনৈতিক কাজের অভিযোগ এবং একাধিক মামলা আছে। এর আগেও তিনি কারাগারে গেছেন। আর এসব কারণে তিন বছর আগে তাকে জামায়াত থেকে বহিষ্কার করা হয়। তারপরও তিনি ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে আছেন। প্রশ্ন হলো কীভাবে?

আমরা সবাই আওয়ামী লীগ?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে চমকপ্রদ তথ্য। অধ্যক্ষ পদে টিকে থাকার জন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগের শরণাপন্ন হন। আওয়ামী লীগের সহায়তা চাইলেই তো আর পাওয়া যায় না। তাহলে তিনি কীভাবে সহায়তা পেলেন? এখানে আছে টাকার খেলা। মাদ্রাসার একটি তিনতলা মার্কেট আছে সোনাগাজীতে, যা মাদ্রাসা মার্কেট নামে পরিচিত। এই মার্কেট থেকেই মাসে ভাড়া আসে তিন লাখ টাকা। আর মাদ্রাসা থেকে আরও অনেক আয় তো আছেই। তাই আওয়ামী লীগের সহায়তা পেতে কষ্ট হয়নি এই অধ্যক্ষের। তিনি টিকে গিয়ে ক্ষমতায়নেও হাত দেন। তাই প্রথমে ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা মামুনের সহায়তা নিলেও তাকে ছুড়ে ফেলে দেন দ্রুত। এরপর তিনি আরেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাকসুদুর রহমানের কোলে ওঠেন। মাকসুদ আবার মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সদস্য। সব মিলিয়ে টিকে যান অধ্যক্ষ। আর মাদ্রাসার আয় উপার্জনের বড় একটি অংশ নেতাদের দেন নিজে টিকে থাকার জন্য। শুধু তাই নয়, মাদ্রাসায় তিনি ছাত্রলীগের কমিটিও গঠন করেন তার অনুগত ছাত্রদের দিয়ে। 

আর এই মাদ্রাসাটি শুরু থেকেই ছিল জামায়াত নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু সবাই এখন আওয়ামী লীগ হয়ে গেছেন। তাতেও যদি সব ঠিকমতো চলতো তাহলে কথা ছিল না। অধ্যক্ষের ছুড়ে ফেলে দেওয়া স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মামুন ছাড়বে কেন? সেও তো টাকা চায়। তাই এখন মাদ্রাসাটির আয় বাণিজ্য নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা দু’ভাগ। এই সুযোগে অধ্যক্ষ তার অবস্থান আরও পাকাপোক্ত করেন। চালিয়ে যান অনৈতিক কাজ।

ধর্ষণচেষ্টার আগে আরও একবার এই মাদ্রাসা অধ্যক্ষ তাকে যৌন হয়রানির চেষ্টা করে। কিন্তু তখন বিচার চেয়েও সে প্রতিকার পায়নি। ২৭ মার্চ ধর্ষণচেষ্টার পর দায়ের করা মামলায় তা বলাও হয়েছে।

পুলিশ আর প্রশাসন যা করেছে

শুধু কি স্থানীয় আওয়ামী লীগ? মোটেই না। পুলিশ এবং প্রশাসনও সাবেক জামায়াত নেতা এই অধ্যক্ষকে টিকিয়ে রাখার কাজে আগুয়ান ছিল। কারণ ধর্ষণচেষ্টা মামলার পর যে চারজন ছাত্রলীগ নেতা মামলা তুলে নেওয়ার হুমকি দিয়েছে তাদের কথা তারা পুলিশকে জানিয়েছে। পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি ছাত্রীটির নিরাপত্তা সঙ্কট তৈরি হলেও তাকে নিরাপত্তা দেওয়া হয়নি। ছাত্রীটির ভাই তাই তাকে মাদ্রাসায় দিয়ে আসলেও শনিবার সকালে তাকে মাদ্রাসায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আর মাদ্রাসার গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পিকে এনামুল করিম কী করেছেন? তিনিও ছাত্রীটির নিরাপত্তায় কোনও উদ্যোগ নেননি। এমনকি ধর্ষণ চেষ্টা মামলায় অধ্যক্ষ গ্রেফতার হওয়ার পরও তাকে সাময়িক বরখাস্ত করার কোনও উদ্যোগ নেননি। ছাত্রীটিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার পর নিজেকে বাঁচাতে গত রবিবার তিনি অধ্যক্ষকে সাসপেন্ড করেন।

এখনও তৎপর তারা

এবারে আসি পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনায়। এখন পর্যন্ত যে তথ্য জানা গেছে তা হলো–

১. মামলায় সন্দেহভাজন চারজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

২.  কারা শরীরে আগুন দিয়েছে তাদের নাম বলেছে ছাত্রীটি।

৩. পুলিশ ১০ জনকে আটক করেছে।

৪. এজাহারে যাদের সন্দেহ করা হয়েছে এবং ছাত্রীটি যাদের নাম বলেছে তাদের কেউ আটক হয়নি।

৫. পুলিশ কোনও প্রত্যক্ষদর্শী পায়নি এখনও।

৬. ওই ছাত্রী ছাড়া আর কেউ নাকি ঘটনা দেখেনি।

৭. আলামত নষ্ট করে ফেলার অভিযোগ।

মাদ্রাসাটি সুরক্ষিত দেয়াল দিয়ে। শনিবার ঘটনার দিন গেটে পুলিশও ছিল। ছিল নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষী। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সে পরীক্ষা দিতে গেলে তার এক বন্ধবীকে তিন তলার ছাদে মারধর করা হচ্ছে বলে কেউ একজন তাকে ডেকে নিয়ে যায়। আর তারপরই ঘটনাটি ঘটে। আর আগেই বলেছি ওই দিন কয়েকজন ছাত্র তার ভাইকে মাদ্রাসার ভেতরে যেতে দেয়নি। এর আগে নিরাপত্তার কারণে তার ভাই তাকে ক্লাসরুম পর্যন্ত দিয়ে আসতেন। 

মাদ্রাসার গার্ড, শিক্ষক, কোনও শিক্ষার্থী নাকি কিছুই দেখেনি। আর ছাত্রীটি গায়ে আগুন নিয়েই নিচে নেমে আসে। তারা কাউকে দৌড়ে যেতে বা পালাতেও দেখেনি। আর আলামত পেয়েছে কিছু মোড়ানো প্লাস্টিক এবং ছাত্রীর বোরকার কিছু পোড়া অংশ। ছাত্রীটি নিজেও বলেছে দুর্বৃত্তরা ৪-৫ জন ছিল এবং তারা বোরকা পরা এবং মুখ ঢাকা ছিল। অ্যাম্বুলেন্সে এবং ঢাকা মেডিক্যালে সে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। তা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশও হয়েছে। অডিও আছে। আর তাতে স্পষ্ট, তাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার কারণ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ধর্ষণচেষ্টার মামলা। দুর্বৃত্তরা ছাদে তাকে মামলা তুলে নেওয়ার চাপ দেয়। আর তাতে সে কোনোভাবেই রাজি হয়নি। যার পরিণতিতে সে এখন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। এত স্পষ্ট এবং ক্লু সম্পন্ন ঘটনায় তাহলে অপরাধী নিয়ে এত রাখঢাক কেন?

পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা পরিকল্পিত

এই ঘটনার পর আমি স্থানীয় পর্যায়ে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। জানার চেষ্টা করেছি প্রকৃত ঘটনা। আর তাতে যা জানা গেছে তা হলো–

১. মাদ্রাসাটির ৯০ ভাগ শিক্ষক জামায়াতের এবং অধ্যক্ষের অনুগত।

২. শিক্ষার্থীদের বড় অংশ শিবিরের সঙ্গে জড়িত, তারা আবার প্রকাশ্যে ছাত্রলীগ করে।

৩. স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং পুলিশ প্রশাসন অধ্যক্ষের কেনা।

৪. দুর্বৃত্তরা আগে থেকেই মাদ্রাসায় ছিল।

৫. দুর্বৃত্তরা কীভাবে গা ঢাকা দেবে তাও পরিকল্পনায় ছিল।

৬. আলামতও সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

আর এসব কারণেই যারা ঘটনা জানেন তারা প্রকাশ করছেন না। যারা দেখেছেন তারা মুখ খুলছেন না। আর যারা ঘটনা ঘটিয়েছে তারা নিরাপদে আছে। সবাই এখন চোখ বুজে আছে। ছাত্রীটির গায়ে আগুন দেওয়া হয় পরিকল্পিতভাবে। আর সে কারণেই সেদিন তার ভাইকে মাদ্রাসায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

বাবা ছাত্রীটিকে ঘুমাতে বারণ করেছেন অজানা আশঙ্কায়। কিন্তু এই ছাত্রীটির বিনাশে এবং অধ্যক্ষকে বাঁচাতে এত লোক সেখানে স্বার্থের কারণে জেগে আছে সেখানে ছাত্রীটির জেগে থাকা কতটুকু কাজে আসবে? তাদের ঘৃণ্য লোলুপ চিন্তাকে কি পরাজিত করা সম্ভব? 

তবু আমরা জেগে থাকতে চাই। হয়তো একদিন ভোর হবে। পরাজিত হবে দুর্বৃত্তদের ঘৃণ্য সন্ধি।

লেখক: সাংবাদিক

ই-মেইল:[email protected]

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভোট দিতে এসে কেউ উৎফুল্ল, অনেকেই ক্ষুব্ধ!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনভোট দিতে এসে কেউ উৎফুল্ল, অনেকেই ক্ষুব্ধ!
বায়ার্নের নজরে থাকা নাগেলসমানের সঙ্গে জার্মানির নতুন চুক্তি
বায়ার্নের নজরে থাকা নাগেলসমানের সঙ্গে জার্মানির নতুন চুক্তি
নড়াইলে ‘সুলতান মেলা’ উপলক্ষে আর্ট ক্যাম্প
নড়াইলে ‘সুলতান মেলা’ উপলক্ষে আর্ট ক্যাম্প
লোকসভা নির্বাচন: রাস্তার দাবিতে ভোট বয়কট করলেন গ্রামবাসী
লোকসভা নির্বাচন: রাস্তার দাবিতে ভোট বয়কট করলেন গ্রামবাসী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ