X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ

মো. জাকির হোসেন
১৯ জানুয়ারি ২০২২, ১৭:৪২আপডেট : ১৯ জানুয়ারি ২০২২, ১৮:২২

মো. জাকির হোসেন বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আলোচিত বিষয়সমূহের অন্যতম সদ্য সমাপ্ত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী হ্যাটট্রিক বিজয় অর্জন করেছেন। নারায়ণগঞ্জের নগর মাতা ডা. আইভি হায়াতের জন্য ভালোবাসায় সিক্ত অভিনন্দন ও শুভকামনা। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়েও সাহসিকতার সঙ্গে লড়েছেন। তীব্র প্রতিযোগিতা না হলেও নিজ দলের বিরুদ্ধে গিয়েও সমীহ করার মতো ভোট পেয়েছেন। সেজন্য তৈমুর আলমকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

নাসিক নির্বাচন আমাদের জন্য বেশ কিছু বার্তা দিয়ে গিয়েছে, যার অন্যতম হলো,

এক. যারা বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে হতাশায় নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন, লেখনীতে-বিবৃতিতে নির্বাচন ব্যবস্থার কুলখানি হয়ে গিয়েছে বলে সরব ছিলেন তাদের হতাশা কাটিয়ে ওঠার উত্তম দাওয়াই নাসিক নির্বাচন।

দুই. মাঘের শীত উপেক্ষা করে সকাল থেকেই নারায়ণগঞ্জ সিটির ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের ভিড় ছিল। নির্বাচনের উত্তাপের কাছে হেরে গেছে মাঘের শীত। আনন্দ-উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল না ভোটারদের। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে এবার মোট ভোটার ছিল পাঁচ লাখ ১৭ হাজার ৩৬১ জন। এরমধ্যে ৫৭ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। এর আগে ২০১১ সালে এই সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে ভোট পড়েছিল প্রায় ৬৯ শতাংশ। ২০১৬ সালের দ্বিতীয় নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬২ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

তার মানে বিএনপির ভোট বর্জন ভোটারদের আগ্রহের ওপর বড় কোনও প্রভাব সৃষ্টি করেনি।

তিন. নাসিকে শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হয়েছে। নির্বাচনে ১৯২টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। কোনও কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত হয়নি। কোথাও কোনও দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়নি। নির্বাচন কমিশন, সরকার, বিরোধী দল ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে সেই ধন্বন্তরী মন্ত্র-কৌশল-পদ্ধতি আত্মস্থ করতে হবে যাতে নাসিক-এর গুড প্র্যাকটিসগুলো সামনের দিনগুলোতে অনুশীলন ও প্রয়োগ করা যায়।

চার. নির্বাচনে পরাজিত অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার বলতে হয় তাই বলার মতো করে মৃদু অভিযোগ করেছেন। বিজয়ী নগর মাতার মাথায় হাত রেখে দু’আ করেছেন। বিএনপির প্রার্থী হিসেবে অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হলে অভিযোগের মাত্রা ও সৌহার্দ্যের পরিস্থিতি কি এমন থাকতো?

পাঁচ. ২০১১ সালে সিটি করপোরেশন হিসেবে যাত্রা শুরুর পর নাসিকে এবারের নির্বাচন তৃতীয়বার। প্রথমবার ৯টি ওয়ার্ডে ইভিএমে, বাকিগুলোয় ব্যালট পেপারে ভোট হয়। ২০১৬ সালে সব কেন্দ্রে ব্যালট পেপারে এবং এবার সব কেন্দ্রে ভোট হয় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে। কিছু কেন্দ্রে ভোটারদের অভিযোগ ছিল, ভোট খুব ধীরে হয়েছে। ইভিএম নিয়ে কিছু সমস্যার পাশাপাশি কোনও কোনও মহলে আস্থার অভাব রয়েছে।

একটি সমস্যা হচ্ছে, এতে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক ভোটারের আঙুলের ছাপ মিলছে না। কিন্তু এ কারণে কি তাদের ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে? এর বিকল্প বের করতে হবে। চোখের মণি মিলিয়ে বা অন্য কোনোভাবে তাদের শনাক্ত করার পথ বের করতে হবে, যাতে তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। ইভিএম নিয়ে বড় একটি আস্থার অভাব হচ্ছে এর মাধ্যমে দেওয়া ভোট চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ নেই। একটি কাউন্টার চেকের ব্যবস্থা থাকা দরকার। ইভিএম থেকে প্রিন্ট-আউট বের করার ব্যবস্থা থাকলে আস্থার অভাব অনেকটা দূর হবে বলে আশা করা যায়। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে কেনাকাটা করলে যেমন প্রিন্টেড পেপার ট্রেইলের ব্যবস্থা আছে তেমন ব্যবস্থা করা যায় কিনা ভেবে দেখা যেতে পারে।

ছয়. নাসিক নির্বাচনে আইভীর হ্যাটট্রিক জয়ের পেছনে অন্যতম কারণ হলো, তৃণমূলে সাধারণের সঙ্গে মিলেমিশে থাকায় নারায়ণগঞ্জে আইভীর যে ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি তা সেখানকার অন‌্য রাজনীতিবিদদের থেকে তার ভালো অবস্থান তৈরি করেছে। আইভীর সততা, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবস্থান ও সাধারণ মানুষের মধ‌্যে গ্রহণযোগ‌্যতার কারণে একটা ‘ভোট ব‌্যাংক’ তৈরি হয়েছে।

প্রতিশ্রুতি ধরে রাখার সুনামও আইভীর ব‌্যক্তিগত ভোট ব‌্যাংক তৈরি করেছে। নাসিকে প্রমাণিত হয়েছে দলের ভোট ব‌্যাংকের পাশাপাশি মূল ব‌্যবধানটা তৈরি হয় প্রার্থীর ইমেজের ওপর। নাসিকের পাশাপাশি বেশ কয়েক দফায় দেশব্যাপী স্থানীয় সরকার নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। পত্রপত্রিকার প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের প্রায় ৫০ শতাংশ আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কিংবা অন্য দলের প্রার্থীদের কাছে পরাজিত হয়েছে। তার মানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে।

আট. নাসিক নির্বাচনে আইভীর অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। দলের স্থানীয় রাজনীতি পুরোপুরি আইভীর পক্ষে ছিল বলা যাবে না। তৈমুরের প্রচারণায় শামীম ওসমানের ভাই সেলিম ওসমান জাতীয় পার্টির চার জন চেয়ারম্যান সঙ্গে নিয়ে আইভীর বিরুদ্ধে প্রচারণায় নেমেছিলেন। কিন্তু আইভীর ব‌্যক্তিগত ভাবমূর্তি, ভোটারদের কাছে জনপ্রিয়তা, সার্বিক গ্রহণযোগ‌্যতা ও সাধারণের সঙ্গে সহজেই মিশে যাওয়ার অনন্য গুণাবলি তাকে হ্যাটট্রিক জয় এনে দিয়েছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন আসছে। এই নির্বাচন নানা কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে চীনবিরোধী কোয়াড নামে যে জোট তৈরি হয়েছে তাতে বাংলাদেশ যোগ না দেওয়ায় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশই অসন্তুষ্ট।

অনেকেই মনে করেন, র‌্যাব-এর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা কোয়াডে যোগ না দেওয়ার ট্রেইলর মাত্র। সামনে আরও কিছু অপেক্ষা করছে। অন্যদিকে কোয়াডে যোগ না দিতে চীনের অব্যাহত চাপ রয়েছে।  নির্বাচনের ওপর কোয়াড আছর করে কিনা তা দেখার বিষয়। জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ে সারা দেশে ‘আইভীদের’ খুঁজে বের করতে হবে। আওয়ামী লীগ এই উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন দল।

আদর্শভিত্তিক এই দলে অসংখ্য নিবেদিতপ্রাণ ‘আইভী’ রয়েছেন।

নয়. নাসিক নির্বাচন নিরূপদ্রব, হাঙ্গামাবিহীন হলেও অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভয়ংকর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী এযাবৎ ৬৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে আর অসংখ্য আহত হয়েছে। ৬৬ জনের মধ্যে প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের রক্তক্ষয়ী আত্মঘাতী সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন। এর মানে দলের তৃণমূলে ঐক্য ও সংহতির অভাব রয়েছে। এই মুহূর্তে দরকার আওয়ামী লীগের সংগঠিত হওয়া। সামনে দুই বছর আছে। এ সময় আওয়ামী লীগ সংগঠিত হতে না পারলে বিপদের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

দশ. নাসিক নির্বাচনে এটা সুস্পষ্ট যে অবাধ, শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান অসম্ভব নয়। এ ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠানে সব অংশীজনের দায়িত্বশীল আচরণ আবশ্যিক। শুধু এক পক্ষ তথা নির্বাচন কমিশন চাইলেই সমগ্র নির্বাচনটি অর্থবহ হয়ে ওঠে না। দলগুলো কোনও বিতর্কিত, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিকে মনোনয়ন না দিয়ে বরং ডা. আইভীদের মতো জনবান্ধব নেতাদের যদি প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয় এবং তৈমুরের মতো বিচক্ষণ মানুষরা যদি প্রতিদ্বন্দ্বী হয়, তখন একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বপ্নপূরণ এগিয়ে যায় বৈকি।

নারায়ণগঞ্জ বাংলাদেশের বাইরে নয়। নারায়ণগঞ্জের জনগণও বাংলাদেশের সাধারণ জনগোষ্ঠী থেকে ভিন্ন নয়। অনেকগুলো ‘যদি’, ‘কিন্তু’র শর্ত যুক্ত থাকলেও নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি অসম্ভব নয়। গণতন্ত্র চর্চায় রক্তপাতহীন, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনের ধারা অব্যাহত থাকুক এই কামনা করি।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

ইমেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নারী উন্নয়ন ফোরামের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নারী উন্নয়ন ফোরামের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
কাপ্তাই হ্রদে পানি স্বল্পতায় কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন
কাপ্তাই হ্রদে পানি স্বল্পতায় কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
মৌলভীবাজারে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক: মানবাধিকার কমিশন
মৌলভীবাজারে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক: মানবাধিকার কমিশন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ