X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

ডা. জাফরুউল্লাহ চৌধুরী, আপনি কার?

প্রভাষ আমিন
০৩ মার্চ ২০২২, ১৮:০৩আপডেট : ০৩ মার্চ ২০২২, ১৮:০৩

প্রভাষ আমিন অনেক অনেক ভিন্নমত সত্ত্বেও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে আমার ভালো লাগে। প্রথম কথা হলো তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সবসময় আমার সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা আছে। তাছাড়া তাকে আমার অকপট মনে হয়। কঠিন কঠিন ন্যায্য কথাও বলে ফেলেন অবলীলায়, নির্ভয়ে। তবে একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও বিভিন্ন সময়ে তাঁর নানা তৎপরতা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এমনকি তিনি সরাসরি দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়েছেন। যা আমাকে বিস্মিত ও বেদনার্ত করেছে বারবার। এত কিছুর পরও তার দেশপ্রেম নিয়ে আমার কোনও সংশয় নেই। তিনি গভীরভাবে বাংলাদেশকে ভালোবাসেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে বিলাতে মানে লন্ডনে গিয়েছিলেন এফআরসিএস পড়তে। পড়াও প্রায় শেষ। সামনে যখন চূড়ান্ত পরীক্ষা, তখনই শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে ট্রাভেল ডকুমেন্ট জীবনের ঝুঁকি মাথায় করে যেভাবে লন্ডন থেকে দিল্লি পৌঁছেছেন, তা সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। বিলাতি ডিগ্রি, নিশ্চিত ক্যারিয়ার সব পেছনে ফেলে আগরতলার মেলাঘরে প্রতিষ্ঠা করেন ফিল্ড হাসপাতাল, যে হাসপাতাল বাঁচিয়েছে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার জীবন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে সেই ফিল্ড হাসপাতালটিই ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামে প্রথমে কুমিল্লা ও পরে সাভারে স্থাপন করেন।

বর্তমান সরকার ছাড়া আর সব সরকারের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা ছিল জাফরুল্লাহ চৌধুরীর। ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামটি বঙ্গবন্ধুর দেওয়া, আর সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জমিও দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। দেশের দুই সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং এইচ এম এরশাদের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠতা ছিল।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী আসলে একের ভেতরে অনেক। তিনি একজন ডাক্তার। শুধু ডাক্তারি করলে তিনি হতে পারতেন দেশের সেরা ডাক্তারদের একজন। তিনি একজন উদ্যমী সংগঠক, যিনি দাঁড় করিয়েছেন গণস্বাস্থ্যের মতো একটি প্রতিষ্ঠান। তার হাসপাতালে অল্প পয়সায় চিকিৎসা হয়। মাত্র দুই হাজার টাকায় ডায়ালাইসিস হয়। তিনি একজন অ্যাকাডেমিশিয়ান, তার লেখা বই বিশ্বের অনেক দেশে এমবিবিএস শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। তিনি একজন গবেষক, তার গবেষণাকর্ম ছাপা হয়েছে বিশ্বের অনেক নামি জার্নালে। নোবেল ছাড়া বিশ্বের প্রায় সব সম্মানজনক পুরস্কার রয়েছে তার ঝুলিতে। কিন্তু জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে কাছ থেকে দেখলে আপনি বিশ্বাসই করবেন না, এই সাদাসিধা, ভোলাভালা, আনস্মার্ট লোকটিরই এত গুণ।

অনেক  ভিন্নমত সত্ত্বেও জাফরুউল্লাহ চৌধুরীকে আমি পছন্দ করি তার রাজনীতি সচেতনতার কারণে। এ বয়সে তার মতো গুণের অধিকারী অধিকাংশই রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন। কোনও বিতর্কে জড়াতে চান না। দেশটাকে রাজনীতিবিদদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজেরা নিরাপদ দূরত্বে থাকেন। আমাদের গুণী মানুষেরা দেশের প্রয়োজনে, দেশের বিপদে কখনও সামনে আসেন না, কথা বলেন না। অথচ শেষ পর্যন্ত রাজনীতিবিদরাই দেশ চালান। তাই দেশকে ভালোবাসলে, দেশের উন্নতি চাইলে রাজনীতিকে ঠিক পথে রাখতে হলে সবাইকে কথা বলতে হবে। গুণী মানুষদের রাজনৈতিক নির্লিপ্ততার এই জোয়ারে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। রাজনীতি সচেতন অন্য সুশীল বুদ্ধিজীবীদের মতো তিনি দূরে থেকে বিবৃতি দিয়ে, কলাম লিখে, টকশো করেই দায়িত্ব শেষ করেন না। বরং রাজনীতির মাঠে দারুণ সক্রিয় তিনি। সরকারের কঠোর সমালোচক। আর এই সমালোচনার বেশিরভাগই যৌক্তিক।

রাজনীতি সচেতন এবং সরকারের কট্টর সমালোচক হলেও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সরাসরি কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। তবে বর্তমান সরকারের কট্টর সমালোচক বলে অনেকেই তাকে বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষী বলে অভিহিত করেন। ‘শত্রুর শত্রু বন্ধু’ এই তত্ত্বে বিএনপিও তাকে কাছে টেনে নেয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে। সেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মূল কারিগরদের একজন ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সেই নির্বাচনে ভরাডুবির মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অঘোষিত বিলুপ্তি ঘটলেও জাফরুল্লাহ চৌধুরী তার অবস্থান পাল্টাননি। নিয়মিত সরকারবিরোধী নানা অনুষ্ঠানে সরব তিনি।

নির্বাচন কমিশন গঠনকে সামনে রেখে কয়েক মাস ধরেই দেশে নানা তৎপরতা হয়েছে। প্রথমে রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেছেন। পরে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সংসদে আইন হয়েছে। সেই আইনের আলোকে অনুসন্ধান কমিটি গঠিত হয়েছে। অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশ করা ১০ জন থেকেই রাষ্ট্রপতি বেছে নিয়েছেন একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং চার জন নির্বাচন কমিশনার। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য অনুসন্ধান কমিটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের কাছ থেকে নাম চেয়েছে। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। বিএনপি এই পুরো প্রক্রিয়াই বর্জন করেছে। অনুসন্ধান কমিটির সঙ্গে সংলাপে আরও অনেকের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও। তিনি সেখানে তার নানা পরামর্শ দিয়েছেন, পছন্দের ৮ জনের নামের তালিকাও দিয়েছেন। বৈঠক শেষে গণমাধ্যমে তিনি তার পছন্দের ৮ জনের নামও প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠনের পর দেখা গেলো প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া কাজী হাবিবুল আউয়ালের নাম ছিল ডা. জাফরুল্লাহর তালিকায়। তার তালিকা থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করায় জাফরুল্লাহ চৌধুরী সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি বিএনপিকে অনুরোধ করেছেন যেন তারা নির্বাচন কমিশনকে মেনে নেয়।

অনুসন্ধান কমিটির ডাকে সাড়া দিয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বৈঠকে যোগ দেওয়া এবং নামের তালিকা দেওয়ার পর থেকেই সরকারি দল এটাকে নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করে আসছিল। সরকারি দলের নেতারা বলছিলেন, বিএনপি সরাসরি নাম না দিলেও জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মাধ্যমে তাদের পছন্দ জানিয়ে দিয়েছে। আর জাফরুল্লাহ চৌধুরীর তালিকা থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়ার পর সরকারি দলের নেতাদের গলা আরও চড়া হয়। তারা বলতে থাকেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর তালিকা থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়া মানে এই কমিশন নিরপেক্ষ।

তবে জাফরুল্লাহ চৌধুরী শুধু সরকারি দলের সমালোচনা করেন, তাই নয়। তিনি বিএনপিরও যৌক্তিক ও গঠনমূলক সমালোচনা করেন। আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সমালোচনা মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি শূন্যের কোঠায়। এখানে সমালোচনার কোনও জায়গা নেই। আপনাকে অন্ধ সমর্থক হতে হবে। এ কারণে জাফরুল্লাহ চৌধুরী অনেক দিন ধরেই সরকারি দলের চক্ষুশূল। আর তখন বিএনপি তার বক্তব্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বগল বাজিয়েছে। কিন্তু জাফরুল্লাহ যখন তারেক রহমানের সমালোচনা শুরু করলেন, তখন তিনি বিএনপিরও চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছেন। ডা. জাফরুল্লাহ আসলে নিজে যা ভালো বোঝেন, কাউকে পাত্তা না দিয়ে তাই করেন, বলেন। তাই একই সঙ্গে তিনি আওয়ামী লীগেরও অপছন্দের, বিএনপিরও অপছন্দের। তবে বিএনপি তাদের অপছন্দটা খুব বেশি প্রকাশ করেনি। কিন্তু নির্বাচন কমিশন গঠন ইস্যুতে জাফরুল্লাহ ভূমিকায় একটি বিপাকে পড়েছে বিএনপি। তাই তো বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ঘোষণা দিয়ে বলতে হচ্ছে, ‘ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে বিএনপির কোনও সম্পর্ক নেই। তিনি নির্বাচন কমিশনের প্রশংসা করলেও বিএনপিকে কোনও মতামত দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন না। এটা তার নিজস্ব মন্তব্য।’

অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে, আওয়ামী লীগ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে বিএনপি বানাতে মরিয়া। আবার বিএনপিও তাকে ঝেড়ে ফেলতে ব্যাকুল। অবস্থা দেখে আমার খালি জানতে মন চায়, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আপনি কার?

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায় চীন ও ইন্দোনেশিয়া
আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায় চীন ও ইন্দোনেশিয়া
প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
রিয়ালের মধুর প্রতিশোধে গর্বিত আনচেলত্তি 
রিয়ালের মধুর প্রতিশোধে গর্বিত আনচেলত্তি 
টাঙ্গাইল শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ককটেল বিস্ফোরণ, শহরজুড়ে আতঙ্ক
টাঙ্গাইল শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ককটেল বিস্ফোরণ, শহরজুড়ে আতঙ্ক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ