X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন নির্বাচন কমিশন জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে?

রুমিন ফারহানা
১০ মার্চ ২০২২, ২০:৩৮আপডেট : ১০ মার্চ ২০২২, ২০:৩৮
রুমিন ফারহানা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আইনের মাধ্যমে গঠিত হলো নির্বাচন কমিশন। কাগজে কলমে আইনের মাধ্যমে এই কমিশন গঠিত হলেও আগের দুই কমিশন গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে এবারের কমিশনের গঠন প্রক্রিয়ায় কোনও ভিন্নতা দেখা যায়নি। ২০১২ সালে রকিব কমিশন আর ২০১৭ সালে হুদা কমিশন সার্চ কমিটির মাধ্যমে যেভাবে গঠিত হয়েছিল, এবারের আউয়াল কমিশনও গঠিত হয়েছে ঠিক সেভাবেই।

বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যখন নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ একটি সরকারের দাবি জানিয়ে আসছে তখন সরকার সংবিধানের দোহাই দিয়ে বলছে নির্বাচন করবে নির্বাচন কমিশন, সেখানে সরকারের কোনও ভূমিকা নেই। ক্ষমতাসীনদের বক্তব্য শুনলে অবাক লাগে। কারণ, তারাই একদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য সংসদ বর্জন থেকে শুরু করে পদত্যাগ, হরতাল দিয়ে দেশ অচল করা থেকে শুরু করে রাজপথে আন্দোলন সবই করেছিল।  

নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ার পর সাবেক নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার মানুষসহ দেশের নাগরিক সমাজের অনেকেই নির্বাচন কমিশনকে স্বাগত জানিয়েছেন। এরপর প্রায় সবাই বলতে চেষ্টা করেছেন যেহেতু পরপর দুটি নির্বাচন কমিশন মানুষের ভীষণ আস্থাহীনতায় পড়েছে তাই প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। এখন নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজ হবে মানুষের আস্থা অর্জন করা। প্রশ্ন হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া আস্থা অর্জনের জন্য নতুন নির্বাচন কমিশন কী করতে পারে?

মে মাসে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আছে। এরপর আরও বেশ কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন হবে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে। অনুমান করি, যারা তাদের আস্থা অর্জন করতে বলছেন এই নির্বাচনগুলোর দিকেই তারা নির্দেশ করছেন। এই নির্বাচনগুলো যদি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হয় তাহলে নতুন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা তৈরি হবে। বিষয়টি কি আসলে এতটাই সরল?

বাংলাদেশের ইতিহাসে সমালোচিত নির্বাচন কমিশন নুরুল হুদা কমিশনের দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রথম নির্বাচন কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের খুব ভালো করেছিলেন। এরপরের সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো অবশ্য খুব খারাপ হয়েছিল। কিন্তু সেগুলোও যদি ভালো হতো, তবু সেটা কোনোভাবে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন ভালো হবে তার গ্যারান্টি দেয় না।

২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে রকিব কমিশন বেশ কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন অত্যন্ত সুন্দরভাবে সম্পন্ন করেছিলেন। সেই নির্বাচনগুলোর প্রত্যেকটিতে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থীরা পরাজিত হয় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের কাছে। এরপর জাতীয় নির্বাচনে তিনি কেমন করতেন সেটা আমাদের দেখা হয়ে ওঠেনি। কারণ, বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। দেশের প্রধান একটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচন বর্জনের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন চাইলে ২০১৪ সালের নির্বাচন বাতিল করতে পারতেন, কিন্তু তারা সেই পথে হাঁটেননি। তাছাড়া আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রকিব কমিশনের অধীনেই উপজেলা পরিষদ তো বটেই এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও মারামারি-খুনোখুনি, জালিয়াতি ইত্যাদি নানান অভিযোগে জর্জরিত ছিল।

যে রকিব কমিশনের অধীনে সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন জালিয়াতিপূর্ণ হয় সেই কমিশনকে কি সফল বলা চলে? তার চেয়েও জরুরি প্রশ্ন হলো, যে কমিশন সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পারলো সে কেন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পারলো না? তার উত্তর খুব পরিষ্কার। একটি জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার চেয়েছিল বিরোধী দলগুলোকে আস্থায় নিতে। তারা চেয়েছিল বিরোধী দলকে বিভ্রান্ত করতে এমনভাবে যেন তারা দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে আসে। তাই জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগে আগে হওয়া সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো ঠিকঠাক মতো হতে পেরেছিল। দিন শেষে সরকারের ইচ্ছাই মুখ্য।  

তাত্ত্বিকভাবে ধরে নিই, এবারও জাতীয় নির্বাচনের আগের সব সিটি করপোরেশন নির্বাচন অসাধারণ সুষ্ঠু হবে। তাতে কি এই কমিশনের ওপরে আমাদের আস্থা তৈরি হবে, না হওয়া উচিত হবে? দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশনগুলো থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত প্রতিটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন যদি বিরোধী দল জয়লাভও করে তাতেও তো রাষ্ট্রক্ষমতার কোনও পরিবর্তন হয় না। আবার বিরোধী দল ঘোষিতভাবে এই সরকারের অধীনে আর কোনও নির্বাচনে যাচ্ছে না। সবদিক বিবেচনায় সরকার চাইতেই পারে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু হোক, যাতে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দলকে বিভ্রান্ত করা যায়।

একটি জাতীয় নির্বাচনে কোনও নির্বাচন কমিশন কেমন করছে সেটা না দেখে জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাকে সার্টিফিকেট দেওয়া যায় না। সমস্যা হচ্ছে এই দেশের প্রতিটি নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচন একবারই করবে। অর্থাৎ এই নির্বাচন কমিশন কেমন জাতীয় নির্বাচন করছে সেটার জন্য তাদের অধীনে একবার নির্বাচনটা হতে দিতে হবে। তারপর সেটা যদি আমাদের ভালো না লাগে সেটা নিয়ে কথা বলতে হবে। ততদিনে আওয়ামী লীগ আবার পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকবে। তাই তাদের পরীক্ষা করার কথা হাস্যকর।

নবনিযুক্ত সিইসি অবশ্য শপথ নেওয়ার আগে থেকেই তার নানা বক্তব্যে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার পরিস্থিতি খুব ভালোভাবে উন্মোচন করছেন। বাংলাদেশের নির্বাচন মানেই যে মল্লযুদ্ধ, সেটা জানতো সব বিরোধী দল, জানতো জনগণও। সিইসি তার স্বীকৃতি দিলেন তার অতি আলোচিত এই উক্তিতে - ‘আমি বলতে চাচ্ছি, মাঠ ছেড়ে চলে আসলে হবে না। মাঠে থাকবেন, কষ্ট হবে। এখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হয়তো দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু উনি পালাননি। তিনি বলছেন, ‘আমি রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করবো।’ তিনি রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরোধ যুদ্ধ করে যাচ্ছেন।’

রাজনীতি এবং নির্বাচনি মাঠের এই যুদ্ধক্ষেত্রের মতো পরিস্থিতিতে সরকারি দল তার রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিয়ে যখন ঝাঁপিয়ে পড়ে বিরোধী দলের ওপর তখন নির্বাচন কমিশনের যে আসলে তেমন কিছু করার নেই, সেটাও তিনি বলে ফেলেছেন। কমিশন নিয়োগের প্রজ্ঞাপনের পর শপথ নেবার আগেই তার বাসায় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি বলেন, ‘জোরের সঙ্গে বলবো- সব দোষ নির্বাচন কমিশনকে দিলে আমি গ্রহণ করবো না। রাজনৈতিক দলগুলোর রোল আছে, পুলিশ, আনসার, র‌্যাবকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমি ওদের কমান্ড করবো না। আমি এসপিকে বদলি করতে পারবো না। আমি কমান্ড করলে কেউ রাইফেল নিয়ে দৌড়াবে না’।  

সিইসি আরও বলেন, ‘সবাই সুন্দর নির্বাচন চাইছে। নির্বাচন কমিশন একা নির্বাচন করে না। অনেক স্টেকহোল্ডার থাকে। নির্বাচন কমিশন টপ লেভেলে থেকে পলিসিগুলো বলে দেয়। সব সেন্টারে নির্বাচন কমিশন থাকে না। প্রশাসনকে কতটা নিরপেক্ষ করা যায়, দায়িত্বশীল করা যায়, সেটাও কিন্তু বড় চ্যালেঞ্জ।’ আরেকটি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে লাঠি নেই, বন্দুক নেই’।

দেশের নির্বাচনি পরিবেশের কী অবস্থা আর একটা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ক্ষমতাসীন দলের বাইরের সব রাজনৈতিক দল এবং নাগরিকরা যা বলছেন দীর্ঘকাল থেকে, সেটাই স্বীকার করলেন সিইসি। এখন তাহলে প্রশ্ন ২০১৮ সালে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনের নামে যা হয়েছে, তারপর আগামী নির্বাচনে সরকার নির্বাচন কমিশনকে অসাধারণ সাহায্য করবে, সিইসি এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারের আস্থা হওয়ার কি কোনও কারণ আছে?

এই কমিশনের সব সদস্য এই সরকারের আমলেই চাকরি করেছেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও পেয়েছেন। খুব কাছ থেকে দেশের পরিস্থিতি জানার, দেখার পরও দলীয় সরকারের অধীনে শপথ নিয়েই নির্বাচন কমিশন জনগণের আস্থা হারিয়েছে। তাই তারা কী করেন, সেটা দেখার আর প্রশ্নও আসে না। বিএনপি বিশ্বাস করে, আন্দোলনের মাধ্যমে এই সরকারের পতন ঘটিয়ে একটা অন্তর্বর্তীকালীন নির্দলীয় সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে। তখন নিশ্চয়ই আগের সব বারের মতোই নতুন নির্বাচন কমিশনও গঠিত হবে। 
 

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ।

 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ