X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘আমি রাইড শেয়ার করি না’

শাহরিয়ার রায়হান রমি
২১ জানুয়ারি ২০২০, ১৯:৩৩আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০২০, ২০:২২

শাহরিয়ার রায়হান রমি আমি একজন সাধারণ বেসরকারি চাকরিজীবী। প্রতিদিন নির্দিষ্ট একটি সময়ে বাসা থেকে বের হয়ে অফিসে আসি। আবার অফিস শেষে বাসায় ফিরে যাই। প্রতিদিনের এই সূচির মধ্যে একটি নতুন বিষয় আমার চোখে পড়ে।
আমার অফিস থেকে বাসার দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। এই পথ অতিক্রমের সময় কখনও কোথাও জ্যামে আটক পড়লে আমাকে প্রায়ই শুনতে হয়, ‘এই মামা যাবেন?’ প্রশ্ন শুনে আমি বিব্রত হই। কারণ, আমি আমার যাতায়াতের জন্যই মোটরসাইকেল ব্যবহার করি। কোনও রাইড শেয়ারিংয়ে আমার মোটরসাইকেলটি রেজিস্ট্রেশন করাইনি। অর্থাৎ আমার মোটরসাইকেলটি ‘ভাড়ায় চালিত মোটরবাইক’ নয়।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, দেশে এই রাইডশেয়ারিং চালুর আগে সিএনজি-অটোরিকশা চালকদের দৌরাত্ম্যে যাত্রীদের দুর্ভোগ ছিল সীমাহীন। এই রাইড শেয়ারিং চালুর পর কিছুটা হলেও রাজধানীবাসীর দুর্ভোগ কমেছে। রাইড শেয়ারিংয়ের ফলে অনেকেরই কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। বিষয়টিকে আমি ইতিবাচকভাবেই দেখি। কিন্তু আমার নিজের বাইক থাকার পরও রাইড শেয়ারিং করি না। এটি আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

এবার একটু পেছনের দিকে তাকানো যাক। যতদূর মনে পড়ে, প্রায় ২ বছর আগে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ‘পাঠাও’ নামের অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং। বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠান এখন এই ব্যবসায় এসেছে। কিন্তু এখন শুধু অ্যাপের মধ্যেই এই রাইডশেয়ারিং সীমাবদ্ধ নেই।

এর আগে বলে নেওয়া দরকার অ্যাপভিত্তিক রাইডশেয়ারিং প্রতিষ্ঠান ও রাইডারের মধ্যের সম্পর্ক কী। সাধারণত বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই ভাড়ার টাকার ৮০ ভাগ রাইডারকে দেয় এবং ২০ ভাগ কমিশন হিসেবে কেটে রাখে।

প্রথমদিকে অ্যাপসভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রচারণা চালাতো যে, ‘চলার পথে আপনার গন্তব্যের সঙ্গে কারও গন্তব্য মিলে গেলে তাকে ট্রিপ দিয়ে আপনি কিছু বাড়তি আয় করতে পারেন।’ ওই সময় আমিও কিছু রাইডারকে চিনতাম, যাদের রাইড শেয়ারের উদ্দেশ্যও এটাই ছিল। সেই পর্যন্ত সবই ঠিকঠাক এবং মানুষও শান্তিতে ছিল।

এর কিছু দিন পর অ্যাপভিত্তিক রাইডশেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রচার কৌশলে পরিবর্তন নিয়ে আসে। এবার তারা হিসাব করে জানালো, একজন তার মোটরবাইক ব্যবহার করে ফুলটাইমে মাসে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত রোজগার করতে পারবেন। আমাদের দেশের বেকার যুব সমাজের কাছে এটা লুফে নেওয়ার মতো প্রস্তাব।

এবার কিছু পেশাদার চালক সেবাদানকারী হিসেবে যুক্ত হলেন এই শেয়ারিংয়ে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে কেউ কেউ পুরনো মোটরসাইকেল কিনে সেগুলোকে সিএনজি অটোরিকশার মতো চুক্তিতে দিয়ে দিচ্ছেন চালকদের কাছে। যাদের মোটরসাইকেল কেনার সামর্থ্য নেই, তারা এই প্রস্তাব লুফে নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে রাইড শেয়ারিংয়ের কমিশন ভাগাভাগি নিয়ে রাইডারদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিলো। তারা প্রশ্ন তুললেন, এত বেশি কমিশন রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানকে কেন দেবেন তারা? তাদের এমন চিন্তা থেকে শুরু হলো নতুন পরিকল্পনা। তারা চুক্তিভিত্তিক রাইড শেয়ারিংয়ের পথে পা বাড়ালেন।

এই নতুন পদ্ধতির কারণে অ্যাপস ছাড়াই অনেকে রাইড শেয়ারিং ব্যবসা করছেন। যখন-তখন মোড়ে মোড়ে বাইকারদের বলতে দেখা যায়, ‘ভাই যাবেন নাকি?’ একইসঙ্গে এ প্রবণতা যাত্রীদের মধ্যেও দেখা যায়। তারাও বাইকার দেখামাত্রই বলেন, ‘মামা যাবেন নাকি’? যারা কোনও রাইডশেয়ারিংয়ে সংযুক্ত নন, তারা এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিব্রত হন। অনেক সময় অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়।

এ তথ্য অনেকেই জানেন, প্রাইভেট সিএনজি অটোরিকশা ও ভাড়ায় চালিত সিএনজি-অটোরিকশার মধ্যে দুটির রঙ দু’রকম। এই হিসাবে কেউ যদি মোটরসাইকেলকেও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করতে চান, তাহলে সিএনজি-অটোরিকশার মতোই দুটি দুই ধরনের রঙ থাকা উচিত। এছাড়া রাইড শেয়ারিংয়ের গাড়িতে ‘ভাড়ায় চালিত’ শব্দযুগলও লিখে রাখা উচিত বলে মনে করি।

অ্যাপভিত্তিক রাইডশেয়ারিং সিস্টেমে নগরবাসীর স্বস্তির নিশ্বাস ছিল। আর এটা ছিল এ কারণে যে, ভাড়া নিয়ে সিএনজি অটোরিকশার যে সিন্ডিকেট ছিল, অ্যাপভিত্তিক রাইডে সেটি ছিল না। অ্যাপে যা ভাড়া দেখাতো তা দিয়ে চলে আসা যেতো। কিন্তু এখন? কোনও মিটার না থাকলে কীসের ভিত্তিতে ভাড়া লেনদেন হবে? সেই অটোরিকশার মতোই সিন্ডিকেট আবার তৈরি হচ্ছে, এতদিনে হয়তো সেটা হয়েও গেছে। তাহলে নগরবাসীর স্বস্তির ব্যাপারটাও শেষ হয়ে যাচ্ছে।

এখন অবশ্যই আপনাকে একটি সিএনজি অটোরিকশার মতো মিটার বসাতে হচ্ছে এবং তাদের সংখ্যা যদি এই হারে বাড়তে থাকে, তাহলে অটোরিকশা স্ট্যান্ডের মতো বাইকেরও স্ট্যান্ড দরকার হবে।

এবার আসি লাইসেন্স প্রসঙ্গে। যদি একজন বাণিজ্যিকভাবে বাইক চালান, তাহলে সেটি অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়ে কীভাবে সম্ভব? আর বাইকের রেজিস্ট্রেশনেও বাণিজ্যিক কথাটি উল্লেখ থাকতে হবে। প্রশ্ন আসতে পারে, প্রাইভেটকারের রেজিস্ট্রেশনেও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হওয়ার কথা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে বলবো, আপনি যদি প্রাইভেটকারকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করেন, তাহলে রেজিস্ট্রেশনও সেভাবেই করতে হবে। এর ফলে বাণিজ্যিক রুট পারমিটের বিপরীতে বড় অঙ্কের রাজস্বও পাবে সরকার। সবচেয়ে বড় কথা, সরকারের কাছে একটি পূর্ণ তালিকা থাকবে ঢাকা শহরে কী সংখ্যক বাণিজ্যিক মোটরসাইকেল বা প্রাইভেটকার আছে। সেক্ষেত্রে এই খাতের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতেও কিছুটা ভূমিকা পালন করবে।

সিএনজি অটোরিকশার কথাই যদি বলি, ঢাকা শহরে কয়টা বাণিজ্যিক সিএনজি অটোরিকশা রেজিস্ট্রেশন পাবে, তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করতে পারে। এছাড়া কেউ যদি নারায়ণগঞ্জের রেজিস্ট্রেশনে ঢাকা শহরে সিএনজি অটোরিকশা চালাতে চান, তাহলে সেটা যেমন চালাতে পারেন না, তেমনি ঢাকার বাইরের রেজিস্ট্রেশনে কোনও বাইকও ঢাকায় বাণিজ্যিকভাবে চালাতে পারবেন না। একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার পরে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে আর কোনও বাণিজ্যিক মোটরসাইকেলকে রেজিস্ট্রেশন দেওয়া যাবে না, তখন তারা বন্ধ করে দিতে পারবেন। এটা তাদের যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্যও সহজ হবে। আর এই উদ্যোগ যানজট নিরসনেও ভূমিকা রাখবে।

আর একটি বিপজ্জনক ব্যাপার হচ্ছে, আপনি যখন অ্যাপের মাধ্যমে বাইকে চড়ছেন তখন সেই প্রতিষ্ঠানের কাছে ওই রাইডারের সব তথ্য থেকে যাচ্ছে। কিন্তু রিকশার মতো চুক্তিতে আপনি যখন বাইকে চড়ছেন তখন শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। আল্লাহ না করুন কোনও অঘটন ঘটলে ওই বাইকারকে শনাক্ত করাও কঠিন হবে। এছাড়া যে হারে চুক্তিভিত্তিক রাইডাররা দ্রুত বাইক চালিয়ে যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে পরবর্তী ট্রিপ ধরার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, তাতে প্রতিদিন অসংখ্য মোটরবাইক দুর্ঘটনার খবর যে আমরা পাবো না– তার নিশ্চয়তাই বা কে দেবে।

আমি বাণিজ্যিকভাবে বাইক চালানোর বিপক্ষে নই কিন্তু সেটা অবশ্যই রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির নিয়ন্ত্রণে থাকাটা জরুরি। এবং তার জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিগত বাইকাররা যাতে বিড়ম্বনায় না পড়েন সেটা দেখা এবং ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক বাইক আলাদা করা। যদি শুরু থেকে যেভাবে অ্যাপভিত্তিক রাইডশেয়ারিং হচ্ছিল সেভাবে চলতো তাহলে এই আলোচনারই দরকার হতো না। কারণ, তাতে অ্যাপভিত্তিক রাইডশেয়ারিং প্রতিষ্ঠানই এসব নিয়ন্ত্রণ এবং সরকার চাইলে তাদের কাছ থেকে তথ্য নেওয়া, নিয়ম পরিবর্তন ও প্রয়োগ করতে পারতো। সর্বশেষ কথা হচ্ছে, সড়কে শৃঙ্খলা একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমারও কাম্য। তবে উপরোক্ত বিষয় অগ্রাহ্য করে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো অসম্ভব। সর্বোপরি নগরবাসীর যাতায়াতে স্বস্তি এবং একজন বাইকার হিসেবে বিড়ম্বনা থেকে পরিত্রাণ চাওয়াটা কি অন্যায়?

লেখক: ওয়েব ডেভেলপার, বাংলা ট্রিবিউন

 

/এসএএস/এমএনএইচ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
পরিবারের অভাব দূর করতে সিঙ্গাপুরে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন রাকিব
পরিবারের অভাব দূর করতে সিঙ্গাপুরে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন রাকিব
কেমন চলছে ভারতের লোকসভার দ্বিতীয় দফার ভোট?
কেমন চলছে ভারতের লোকসভার দ্বিতীয় দফার ভোট?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ