X
বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
১২ আষাঢ় ১৪৩২

আবারও এম টি হোসেন ইনস্টিটিউট দখলের পাঁয়তারা, এলাকাবাসীর নামে মানববন্ধন

মোয়াজ্জেম হোসেন, লালমনিরহাট
১১ জানুয়ারি ২০১৮, ০১:৩৫আপডেট : ১১ জানুয়ারি ২০১৮, ০৮:১৮

এম টি হোসেন ইনস্টিটিউট আবারও সেই লালমনিরহাটের শতবর্ষী এম টি হোসেন ইনস্টিটিউট দখল করে সেই জায়গায় বাণিজ্যিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। এ দাবিতে এলাকাবাসীর ব্যানারে এক মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাতে অংশ নিয়েছেন ইনস্টিটিউটের জমি দখলে নিয়ে স্কুল গড়ার উদ্যোক্তা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের নেতারাও। স্থানীয়দের অভিযোগ, এলাকাবাসীর নামে আয়োজিত মানববন্ধনের পেছনেও ছিলেন এই নেতারাই। রেলমন্ত্রীর লালমনিরহাট সফরের আগের দিনই কেন এই মানববন্ধন আয়োজন করা হয়েছে, সে প্রশ্নও তুলেছেন অনেকেই।
এদিকে, ঐতিহ্যবাহী এই ইনস্টিটিউট চত্বরের ৫শ গজ থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যেই অবস্থিত এক ডজনেরও বেশি নামি-দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে কোনও কোনোটি স্থাপিত হয়েছে ৫০ বছরেরও বেশি সময় আগে। আশপাশে এত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও কেন এম টি হোসেন ইনস্টিটিউটের জমিতেই নতুন স্কুল গড়ে তুলতে হবে— সেই প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিকর্মীরা।
এলসিসিআই স্কুল অ্যান্ড কলেজের দাবিতে বুধবার বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে অনুষ্ঠিত হয় মানববন্ধন বুধবার (১০ জানুয়ারি) লালমনিরহাট গোসলাবাজারের বাটামোড় থেকে পৌরভবন পর্যন্ত রাস্তায় এলাকাবাসী ও বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন লালমনিরহাট পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও লালমনিরহাট চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক কাজী নজরুল ইসলাম তপন। লালমনিরহাট চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ঠিকাদার এ কে এম কামরুল হাসান বকুল, রেলওয়ের একাধিক জমির লিজ নেওয়া চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক মোকছেদুর রহমান, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের সদস্য সাইফুল ইসলাম প্রমুখ।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, এলাকাবাসীর সহযোগিতায় এম টি হোসেন ইনস্টিটিউটের পরিত্যক্ত জায়গায় এলসিসিআই মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ নির্মাণ করা হবে। অবশ্যই বৈধভাবে রেলওয়ে কাছ থেকে জমি লিজ নিয়েই সেটা করা হবে। সেজন্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
এলাকাবাসীর ব্যানারে আয়োজিত মানববন্ধনে বক্তব্য রাখছেন লালমনিরহাট চেম্বার অব কমার্সের লালমনিরহাট চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক কাজী নজরুল ইসলাম তপন বলেন, এলাকার স্বার্থে এবং এলসিসিআই মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ স্থাপনে এলাকাবাসীর দাবির কথা জানাতে তারাই এই কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বুধবার রাতেই রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের লালমনিরহাট সফরে এসেছেন। তার সফরকে সামনে রেখেই কেন মানববন্ধন আয়োজন করা হলো, জানতে চাইলে কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
আবার, এলাকাবাসীর দাবির কথা বারবার বলা হলেও এই মানববন্ধনে লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ কোনও নেতাকেই উপস্থিত হতে দেখা যায়নি। স্থানীয়দের অভিযোগ, এলাকাবাসীর নামে মূলত চেম্বার অব কমার্সের নেতারাই এই মানববন্ধন আয়োজন করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলার প্রবীণ একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বও একই অভিযোগ করেন।
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সমিতিও অংশ নেয় স্কুলের দাবিতে আয়োজিত মানববন্ধনে! এম টি হোসেন ইনস্টিটিউট রক্ষায় আন্দোলনরত লালমনিরহাট সবুজ সংঘের অন্যতম সদস্য, কবি পিকে বিক্রম বলেন, ‘যারা আন্দোলন করছেন, তারা না বুঝে রেলের জমি দখলবাজদের পক্ষ নিয়েছেন। আশা করি, সংশ্লিষ্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এই অপতৎপরতা বন্ধে পদক্ষেপ নেবে।’
সরেজমিনে দেখা যায়, এম টি হোসেন ইনস্টিটিউটের আশপাশের দুই কিলোমিটারের মধ্যে দেখা মিলবে বেশকিছু স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। এর মধ্যে ১৯৪৫ সালে স্থাপিত নিজপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত রেলওয়ে চিলড্রেন পার্ক সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত লালমনিরহাট সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত লালমনিরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ও রয়েছে।
পিকে বিক্রম বলেন, ‘ইনস্টিটিউটের আশাপাশে এত স্কুল থাকার পরও কেন সেখানেই নতুন স্কুল স্থাপন করতে হবে, সেটা ভেবে দেখার বিষয়।’ আদৌ ওই স্কুলের প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা, সেই প্রশ্নই তিনি উদ্দেশে ছুঁড়ে দেন।
এই প্রবীণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এম টি হোসেন ইনস্টিটিউটর আশপাশেই অবস্থিত লালমনিরহাট ঐতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক সূফী মোহাম্মদ বলেন, ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লালমনিরহাট এম টি হোসেন ইনস্টিটিউটটি রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছেন। কিন্তু একটি স্বার্থান্বেষী মহল স্কুল করার নামে মূলত রেলের ওই জায়গাটি দখল করার পাঁয়তারা করছে। শতবর্ষী এই ইনস্টিটিউট নতুনভাবে চালু করার ব্যাপারে ঢাকায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ চলছে। আশা করছি, খুব শিগগিরই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় যৌথভাবে এটি সংস্কার করে চালু করবে।’
লালমনিরহাট উন্নয়ন আন্দোলন পরিষদের আহ্বায়ক সুপেন্দ্র নাথ বলেন, ‘মানববন্ধন আয়োজকদের ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। তবে এম টি হোসেন ইনস্টিটিউট হেরিটেজ চালুর দাবিতে আমাদের আন্দোলন অব্যাহত আছে, থাকবে।’
লালমনিরহাট শিল্পকলা একাডেমির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আব্দুল মজিদ মন্ডল বলেন, ‘অন্যায়ভাবে কিছুর জন্য আন্দোলন হয় না। লালমনিরহাট জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এম টি হোসেন ইনস্টিটিউট। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে অন্য কোনও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব না।’
এদিকে, লালমনিরহাটের ঐতিহ্যবাহী এই ইনস্টিটিউট সংরক্ষণের জন্য বিবৃতি দিয়েছেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরাও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক, নাট্যচিন্তক ও নির্দেশক সৈয়দ জামিল আহমেদ লিখেছেন, ‘আমি চাই, শতবর্ষী নাট্যমঞ্চ এম টি হোসেন ইনস্টিটিউট সকল সীমাব্ধতা কাটিয়ে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসাবে পরিণত হয়ে শিশু থেকে বৃদ্ধ সব মানুষের সাংস্কৃতিক চর্চার পীঠোস্থান হয়ে উঠুক। সেই সঙ্গে আশা করি, প্রজাতন্ত্রের শুভদৃষ্টিসম্পন্ন কর্তারা এই ঐতিহ্যকে যত দ্রুতসম্ভব পুনঃসংস্কার করে লালমনিরহাট জেলায় জঙ্গি, সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত প্রজন্ম তৈরি করতে কার্যকর ভূমিকা রাখবেন।’
ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের বিশ্ব সভাপতি, নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে কয়েকটি শতবর্ষী নাটমঞ্চের মধ্যে লালমনিরহাটের এম টি হোসেন ইনস্টিটিউট অন্যতম। কিন্তু সম্প্রতি এ ইনস্টিটিউটের জীর্ণ স্থাপনা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে ভূমি দখলের অপচেষ্টা হচ্ছে জেনে আমরা ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত হয়েছি। অবিলম্বে এ ধরনের কার্যকলাপ প্রতিহত করে এই ঐতিহ্যবাহী ভবনটি সংস্কার করে এখানে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপনের জোর দাবি জানাচ্ছি। যেকোনও মূল্যেই লালমনিরহাটের এই গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য রক্ষা করতে হবে।’

/টিআর/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
শহীদ মিনার ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রূপকারের ম্যুরাল ভাঙচুর
শহীদ মিনার ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রূপকারের ম্যুরাল ভাঙচুর
পাকা আমের আমসত্ত্ব বানানোর রেসিপি জেনে নিন
পাকা আমের আমসত্ত্ব বানানোর রেসিপি জেনে নিন
সাবেক মন্ত্রী ইমরান-প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
সাবেক মন্ত্রী ইমরান-প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ট্রাম্পকে আব্বাসের চিঠি
ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ট্রাম্পকে আব্বাসের চিঠি
সর্বাধিক পঠিত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকে কোপালেন এনসিপি নেতা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকে কোপালেন এনসিপি নেতা
সারজিস আলমের পোস্টের পর সেই সাব-রেজিস্ট্রারের অফিসে দুদকের অভিযান
সারজিস আলমের পোস্টের পর সেই সাব-রেজিস্ট্রারের অফিসে দুদকের অভিযান
মব না, এটি প্রেসার গ্রুপ: প্রেস সচিব
মব না, এটি প্রেসার গ্রুপ: প্রেস সচিব
প্রাথমিকে নতুন কারিকুলামই থাকছে, কারিগরি অনার্সে দেওয়া হবে দুটি সনদ
শিক্ষা সংস্কারপ্রাথমিকে নতুন কারিকুলামই থাকছে, কারিগরি অনার্সে দেওয়া হবে দুটি সনদ
কনা দিলেন বিচ্ছেদের খবর, স্বামী বললেন ‘না’!
কনা দিলেন বিচ্ছেদের খবর, স্বামী বললেন ‘না’!