বরিশাল আইন মহাবিদ্যালয়ের সভাপতি আনোয়ার হোসাইনের বিরুদ্ধে মহাদুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। আর তাকে সহযোগিতা করছেন অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অ্যাড. মোস্তফা জামাল খোকন। তাদের দুই জনের যোগসাজশেই চলছে লুটপাটের মহোৎসব। বিষয়গুলো অডিট রিপোর্টে চলে আসায় বাদ দেওয়া হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান শফিক অ্যান্ড মিজান আগস্টিন-এর অডিট কর্মকর্তাকে। এদিকে লুটপাট বন্ধে দুর্নীতিবাজদের অপসারণে নগরীতে মানববন্ধন করেছে শিক্ষার্থীরা।
কলেজ সূত্র থেকে জানা গেছে, প্রতি বছর আয়-ব্যয়ের হিসাবের অডিট প্রতিবেদন তৈরি করে তা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর নিয়ম রয়েছে। সেই নিয়মমাফিক গত বছরের অডিট রিপোর্ট তৈরির জন্য চিঠি দেওয়া হয় শফিক অ্যান্ড মিজান আগস্টিন প্রতিষ্ঠানটিকে। সেখান থেকে আলী হায়দার নামের এক কর্মকর্তাকে গত বছর ডিসেম্বরে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগ পেয়ে ওই কর্মকর্তা কলেজের আয়-ব্যয়ের হিসাব শুরু করেন। এ সময় আর্থিক ব্যাপক অনিয়মের বিষয় তার কাছে স্পষ্ট হয়। বিশেষ করে সভাপতির নামে চেক ইস্যু, যা কোনোভাবেই করা যাবে না। তাছাড়া উন্নয়ন ফান্ডের টাকা খরচ এবং অবৈধভাবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগসহ একাধিক অনিয়ম তার কাছে প্রতীয়মান হয়। বিষয়টি ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জানতে পেরে তারা তাকে স্বচ্ছতা দেখিয়ে রিপোর্ট তৈরিতে চাপ প্রয়োগ করেন। কিন্তু তিনি তাতে রাজি না হওয়ায় তাকে সরিয়ে অন্য একটি প্রতিষ্ঠান থেকে অডিট রিপোর্ট করিয়ে তা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরণ করা হয়। এমনকি প্রথমবার যারা দায়িত্ব পান, তাদের টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।
শফিক অ্যান্ড মিজান আগস্টিন-এর অডিট কর্মকর্তা আলী হায়দার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তারা চিঠির মাধ্যমে আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে অডিট কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার জন্য বলেন। প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত আইন মহাবিদ্যালয়ের অডিট কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর বরিশালে এসে কাজ শুরু করেন তিনি। সব কাজ যখন শেষ পর্যায়ে তখন সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চান। তাদের অবহিত করা হয় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ সঠিকভাবে হয়নি। তাছাড়া সভাপতির নামে চেক ইস্যুর বিধান নেই। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও কোনও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে করানো হয়নি। এভাবে বেশ কিছু অনিয়ম তুলে ধরেন তাদের কাছে। এ সময় সভাপতি সবকিছু সরিয়ে তাদের পক্ষে প্রতিবেদন দিতে বলেন। কিন্তু তা কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে জানালে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি অডিট প্রতিবেদনের জন্য তাদের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল, সেই মোতাবেক কোনও টাকাও দেয়নি কলেজ কর্তৃপক্ষ।
তিনি আরও বলেন, পরিশোধকৃত বিলে তার স্ত্রী নগরীর সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর সালমা আক্তার শিলার নির্বাচনি খরচের ভাউচারও রয়েছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে ব্যয়ের হিসাব মেলাতে বহু উল্টা-পাল্টা বিল জমা দেওয়া হয়। যার কোনও বৈধতা ছিল না।
শিক্ষার্থী বেল্লাল হোসেন বলেন, আনোয়ার হোসাইন সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর অভিজ্ঞ দুই জন শিক্ষককে বাদ দিয়েছেন। আর্থিক লেনদেনে শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন, যা নিয়মবহির্ভূত বলে দাবি করেন তিনি।
বেল্লাল আরও বলেন, অডিট কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হলে তিনি বেশ কিছু অনিয়ম ধরে ফেলেন। তার মধ্যে প্রধান ছিল তার স্ত্রীর নির্বাচন ভাউচার জমা দিয়ে বিল উত্তোলন এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে কোনও ঠিকাদার নিয়োগ না দিয়ে নিজেই সেই কাজের ঠিকাদার হয়ে কাজ করা। এমনকি সভাপতি তার নিজ নামে ৫ লাখ টাকার চেকসহ লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পান অডিট কর্মকর্তা। এ কারণে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ এ শিক্ষার্থীর।
দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জান্নাতুল মাহি বলেন, সভাপতি হিসেবে আনোয়ার হোসাইন আসার পর থেকে আর্থিক লুটপাট শুরু হয়। এ জন্য শিক্ষার্থীদের ওপর টাকার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়। ভর্তি থেকে শুরু করে ফরম পূরণে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। এমনকি রেজিস্ট্রেশন এবং প্রবেশপত্র নিতে গেলেও এক হাজার টাকা করে দিতে হচ্ছে। এসবের বাইরে ক্লাস চলাকালীন একাধিক খাত সৃষ্টি করে টাকা আদায় করা হয়। তবে এসব টাকার কোনও রসিদ সরবরাহ করা হয় না। প্রতিনিয়ত খাতওয়ারি টাকার পরিমাণ বাড়তেই আছে, কমছে না।
বিভিন্ন অভিযোগে গত ১৮ জানুয়ারি নগরীর প্রাণকেন্দ্র সদর সড়কে মানববন্ধন করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের অপসারণের দাবি জানান।
শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত আইন মহাবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অ্যাড. মোস্তফা জামাল খোকন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ভর্তি কিংবা ফরম পূরণে তেমন টাকা বৃদ্ধি করা হয়নি। তার মতে ৫০০ টাকা বেড়েছে। আর শিক্ষার্থীরা ব্যাংকে টাকা জমা দেন। ব্যাংকের মাধ্যমেই আবার শিক্ষকদের টাকা পরিশোধ করা হয়। এখানে দুর্নীতির কোনও সুযোগ নেই বলে দাবি করেন তিনি।
২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় বর্ষের মৌখিক পরীক্ষায় ১ হাজার টাকা করে আদায় করা হয়। এর উত্তরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বলেন, ভিজিলেন্স টিমের সদস্যদের হোটেলে রাখা এবং খাবার বাবদ খরচ রয়েছে। তাছাড়া পরীক্ষা চলাকালীন দুপুরে শিক্ষার্থীদেরও খাবার দেওয়া হয়েছে। ওই বাবদ ১ হাজার করে টাকা নেওয়া হয়েছে। এ খরচ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বহন করে না। প্রবেশপত্র, রেজিস্ট্রেশন কার্ড বাবদ নেওয়া টাকার রসিদ দেওয়া হয় না কেন? এর কোনও সদুত্তর মেলেনি। এমনকি তিনি পদটি কীভাবে পেয়েছেন তার উত্তরও দেননি।
সব অভিযোগ মিথ্যা-ভিত্তিহীন দাবি করে সভাপতি ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আনোয়ার হোসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কলেজে যে লুটপাট হতো তা বন্ধ করেছেন। সবকিছুই পরিচালিত হচ্ছে ব্যাংকের মাধ্যমে। এখানে টাকা আত্মসাতের কোনও সুযোগ নেই। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কলেজ থেকেই করা হয়। সেখানে ১০ সদস্যের টিম সবকিছু দেখভাল করে। এলাকায় লুটপাট চলতো। এমনকি কলেজ ক্যাম্পাস থেকে মাদক ব্যবসা এবং কলেজের চারপাশের জমি দখল বন্ধ করায় তার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ করা হচ্ছে বলে দাবি করেন।
তিনি বলেন, আমি যদি সরে যাই আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে কলেজ। আর একটি চক্র আমাকে সরানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ দিচ্ছে।
১৯৬৩ সালে নগরীর হাসপাতাল রোডে স্থাপিত কলেজটিতে বর্তমানে প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। শিক্ষক রয়েছেন ১২ জন। ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর আনোয়ার হোসাইনকে সভাপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।